খালেদ মাহামুদ (দিপু): বাংলা এবং বাঙালির ঐতিহ্যের প্রতীক, প্রাণের উৎসব ‘বৈশাখ’। বৈশাখ মানেই বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। বৈশাখের ছন্দ-উচ্ছ্বাস রবিঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটিও যেন মিশে গেছে বাঙালি আর বৈশাখী উৎসবে। পহেলা বৈশাখ বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে উৎসবকে অস্বীকার করা যায় না। কারণ, সব জাতি-গোষ্ঠী ও মতাদর্শের লোকের কাছেই সমান গুরুত্বের দিন এ পহেলা বৈশাখ।
বৈশাখকে ঘিরে বাঙালির চেতনাজুড়ে রয়েছে অন্য রকম আবেগ। উৎসাহ ও দেশীয় সংস্কৃতিকে ধারণ করার আবেগ-অনুভূতি এ বৈশাখী আনন্দকে অর্থবহ করেছে। বৈশাখ মানে উত্তাপ আর উৎসবের আমেজ। চারদিকে সাজসাজ রব। দেশের সব প্রান্তের মানুষের মনকে আলোড়িত করে, করে উচ্ছ্বসিত। বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস বৈশাখের আগমন ঘটে শুচি-শুভ্র-নির্মল-পবিত্রতায়। সারা বছরের যত জঞ্জাল ধুয়ে-মুছে নতুন করে দিন শুরু করা। যেখানে নতুন ভাবনায় সময়, সমাজ ও জীবনকে রাঙিয়ে তোলা যায়।
‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ/তাপস নিঃশ্বাসে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,/অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।/মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা/রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,’ প্রাণের এই উৎসবকে নিয়ে কবিগুরুর অসাধারণ একটি গান। যে গানটি না হলে বৈশাখ পালনে যেন অপূর্ণতাই থেকে যেত। দেশজুড়ে বৈশাখজুড়েই মেলা আর আনন্দ মানেই ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটি। সুরের মূর্ছনায় আলোড়িত করে যায় বাঙালি হৃদয়।
বছর ঘুরে প্রতিটি বাঙালির আঙিনায় বৈশাখের আগমন ঘটে আলাদা আবেগ আর চেতনা নিয়ে। যেখানে বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ বিভেদহীন সমাজ গঠনের ডাক দিয়ে যায়। বৈশাখের এ সর্বজনীন উৎসব দেশের প্রতিটি মানুষকে নানাভাবে ঐতিহ্যের ভাবনায় সমৃদ্ধ করে। উৎসব আর আনন্দ-উল্লাসে মাতোয়ারা বাঙালি জাতি প্রতিটি উৎসবকেই উদযাপন করে আন্তরিকতার সবটুকু বিলিয়ে দিয়ে। বৈশাখের বেলায় এর ব্যতিক্রম তো নয়ই, বরং আরো একদাপ এগিয়ে নিয়ে যায় ঐতিহ্যকে ধারণ করে। বাংলা নতুন বছর মানেই বাঙালির প্রাণের স্পন্দন, নতুনের আহ্বানে জেগে ওঠা। সত্য ও সুন্দরের জয়গান।
তবে বৈশাখজুড়ে শুধুই কি আনন্দ-উৎসব? মোটেই না, সারাদেশে অনুষ্ঠিত বৈশাখী মেলা বাংলার সংস্কৃতি ও লোকশিল্পকে ছড়িয়ে দিতে অবদান রেখে চলেছে যুগ যুগ ধরে। ওইদিন বাঙালি নারী আর শিশুদের নানা রঙের পোশাকের সাজ ও ছেলে-বুড়োদের পোশাকে চেতনাকে জাগিয়ে দেয় অন্য রকম স্বাদে। পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ রাজধানীর শাহবাগে মঙ্গল শোভাযাত্রা। বর্তমানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশ গ্রহণে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে এই শোভাযাত্রা। অশুভ শক্তির বিনাশ, শুভশক্তির উদয়ের এ আয়োজন অসাম্প্রদায়িক চেতনাকেই যেন লালন করে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর দেশপ্রেমের এ শোভাযাত্রায় শুদ্ধতা চর্চাকে উৎসাহিত করে আগামীর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে চলতে পথ দেখায়। যদিও নিরাপত্তার কারণে এবারও এ শোভাযাত্রায় রয়েছে সরকারি নির্দেশনা, রয়েছে বিধিনিষেধ। এতে উৎসবের সীমাবদ্ধতা এলেও নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের সচেতন ও সোচ্চার হওয়া জরুরি।
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রার শুভসূচনা হয়। বিশাল আয়োজনের এ মঙ্গল শোভাযাত্রায় হাতি, বাঘ, ঘোড়া, পাপেট, ময়ূর, লক্ষ্মীপেঁচা, কুমিরসহ নানা ধরনের মুখোশ শোভা পায়। এসবের মধ্য দিয়ে হাজার বছরের বাঙালির চলমান রাজনীতি থেকে শুরু করে নানা রকম সংগতি-অসংগতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, সামাজিক, অর্থনৈতিক বাস্তবতা রূপকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। শিল্পী, কবি-সাহিত্যিকদের স্ব-প্রতিভ পদচারণে এদিনটি থাকে উৎসবমুখর। বৈশাখের আগমনে প্রাণের জোয়ার জাগে বাঙালির প্রাণে প্রাণে। জাতি-ধর্ম-বর্র্ণ নির্বিশেষে পহেলা বৈশাখ বাঙালির মন ও মননে অন্যরকম আনন্দ-উৎসবের ভাবনাকে নাড়া দিয়ে যায়। এ ছাড়া পহেলা বৈশাখের আরেক আকর্ষণ রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ। অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এ অনুষ্ঠানটি এখনো স্বচেতনায় অটুট রয়েছে, যা আমাদের জন্য এক বিশাল প্রেরণা।
মুসলমান সমাজে বৈশাখ বরণে তেমন নিয়ম-কানুন না থাকলেও হিন্দু ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রেওয়াজ। তবে পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে অন্য রকম আনন্দে উদযাপিত হয়ে থাকে। বৈশাখী মেলায় বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে রাখা হয় নাগরদোলা, পুতুলনাচ, সার্কাসসহ মেলার ক্লান্তি দূর করতে যোগ হয় নানা ধরনের সংগীত। গ্রাম ও শহরে উৎসবের ভিন্নতা থাকলেও আনন্দের মাত্রাটা সবখানে সমান। গ্রামাঞ্চলে বৈশাখকে বিভিন্ন রীতিনীতিতেও পালন করতে দেখা যায়। বৈশাখের আগের দিন গ্রামের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় গরু-খাসি জবাই করে মাংস বিলাতেও দেখা যায়। বৈশাখ মানে শুধু মেলা আর খেলাই নয়, বাঙালি খাবার-দাবারেও থাকে উৎসবের আমেজ।
পার্বত্য এলাকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও নানা আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়ে থাকে। বর্ষবরণে চাকমা ও মারমারা উৎসব পালন করে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে। বৈশাখী পূর্ণিমা উদযাপনেও নৃ-গোষ্ঠীর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা বহুকাল থেকে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে আদিবাসী সমাজ এই বৈশাখে ঐতিহ্যবাহী পিঠা উৎসব, খেলাধুলার আয়োজন, বৌদ্ধ মন্দিরে বুদ্ধ প্রণাম, ধর্ম উপদেশ প্রার্থনাসহ নানা ধরনের কর্মযজ্ঞ করে থাকে। অন্যদিকে কোঁচ, সাঁওতাল, ওরাও, গারো, ম্রো, মোরাং, মান্দাই, হাজংসহ অন্য আদিবাসীরা তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতি অনুযায়ী বৈশাখ উদযাপন করে থাকে।
বাংলা নবর্বষ আসে ১২টি মাসের তেরো পার্বণ নিয়ে। এই ১২ মাস নিয়েও রয়েছে নামকরণের ঐতিহ্যগাথা ও কথকতা। বছরের পহেলা মাস বৈশাখকে ঘিরে যতটা উত্তাপ, অন্য মাসগুলোয় তেমনটা না হলেও ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যে ভরপুর বাংলায় বারোটি মাসে উৎসবের কোনো কমতি থাকে না। বাংলা আর বাঙালি মানেই উৎসব ও আনন্দে উল্লসিত জাতি। ঐতিহ্যকে লালন করে এ জাতি বিশ্বের দরবারে তাদের গৌরবগাথাকে তুলে ধরে আপন স্বকীয়তায়।
বৈশাখ আসে নতুনের আগমনে, পুরোনো বিদায় করে বাংলা এবং বাঙালির জীবন ও সময়কে রঙিন-মঙ্গলময় করে দিতে। যত পাপ-তাপ-গ্লানি মুছে দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে বৈশাখ। বাঙালি সারা বছরের জীর্ণতা শেষে নতুন দিনের প্রত্যাশায় বরণ করে নেয় বছরের প্রথম দিন, পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষকে। পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রেরণা। এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়কে শানিত করে, করে উজ্জীবিত। শত ব্যস্ততায়ও, মহাকালের চিরায়ত নিয়মে বৈশাখ বরণে, নববর্ষের উদ্দীপনায় মেতে উঠে বাংলার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। বৈশাখ যে বাঙালির সর্বজনীন উৎসব তার প্রমাণ এই বৈশাখের প্রথমদিন এবং বৈশাখ বরণে সবার অংশগ্রহণ। বলতে দ্বিধা নেই, পহেলা বৈশাখই হতে পারে বাঙালির জাতীয় উৎসবের দিন, কারণ সব বাঙালির জন্য এ উৎসব একই অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত।
অবিরাম শুভ কামনায় বাংলা নববর্ষ মঙ্গলময় হোক সত্য-সুন্দরের চর্চায়। সবাইকে শুভ নববর্ষে অকৃত্রিম শুভেচ্ছা। শুভ হোক প্রতিটা ভোর, প্রতিটা প্রহর, প্রতিটা ক্ষণ—এ কামনা, এই শুভক্ষণে। আনন্দ আর উদ্দীপনায় জাগরিত হোক দেশ আর মানুষের কল্যাণে। নিরন্তর সময়ের স্রোত হোক শুধুই কল্যাণ আর মঙ্গলের বারতায়। সত্য আর সুন্দরের জয়গানে আমাদের আগামী দিনগুলো পূর্ণতা পাক সুখ-সমৃদ্ধিতে। শুভ হোক বাংলা নতুন বছর ১৪২৫।
|