ঘনবসতিপূর্ণ চট্টগ্রামে দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে নগরায়ণ, এখানে গড়ে উঠছে গার্মেন্টসহ অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান। স্বাভাবিকভাবেই এখানে জমির দাম বাড়ছে। একইসঙ্গে আবাসন ও দোকান স্থাপনের জন্য বাড়ছে জমির চাহিদাও। এ কারণে জমি দখলের হিড়িক পড়েছে চট্টগ্রামে। প্রশাসন ও প্রভাবশালীদের যোগসাজশে গড়ে উঠেছে ভূমি দখলের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। বন্দর নগরে ভূমি দখলের সংস্কৃতি কতটা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে তা সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি শিল্প গ্রুপের জমি দখলের অভিযোগের ঘটনায় পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, আকবর শাহ ও বায়েজিদ থানা এলাকায় চলছে শিল্প গ্রুপগুলোর দখল উৎসব। এজন্য নির্বিচারে কাটা হচ্ছে পাহাড়ও। তাদের আগ্রাসন থেকে বাদ যাচ্ছে না ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি থেকে সরকারি পাহাড়। হাজার হাজার একর পাহাড় দখলের পর তা কেটে পরিণত করা হয়েছে সমতল ভূমিতে। সেখানে তৈরি হচ্ছে শিল্পকারখানা। এমনকি প্লট তৈরি করে বিক্রির ঘটনাও ঘটছে। দখলের প্রতিযোগিতায় সবার আগে রয়েছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো।
সম্প্রতি নগরের আকবর শাহ থানাধীন ইস্পাহানী ১নং গেট এলাকায় পাহাড়িকা সিএনজি পাম্পের পূর্বপাশে তিন একর জমি দখলের অভিযোগ ওঠে রতনপুর গ্রুপের প্রতিষ্ঠান রতনপুর রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের বিরুদ্ধে। এতে আকবর শাহ থানা পুলিশ ও স্থানীয় কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসীম সহযোগিতা করে বলেও অভিযোগ। এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজিপির কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন জমির মালিক নুর উদ্দিন, নুর বাহার, হাজী শহীদুল্লাহ, হুমায়ন কবির, রুস্তম আলী ও আলী তাহের হাওলাদার। এতে উল্লেখ করা হয়, নিজ মৌরশি সম্পত্তিতে অনেক বছর ধরে বসবাস করে আসছিলাম। গত ২-৩ বছর আগে এসব সম্পত্তির ওপর কু-নজর পড়ে স্থানীয় কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসীমের। তিনি এসব সম্পত্তি বিক্রি করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু মালিকপক্ষ জমি বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় এলাকাবাসীকে দেখে নেয়ার হুমকি দেন কাউন্সিলর জসীম।
অভিযোগ করে তারা জানান, পরে গত ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসব জায়গা দখলের ষড়যন্ত্র হিসেবে রতনপুর রিয়েল এস্টেট, কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসীম ও আকবর শাহ থানার ওসি মো. আলমগীর একটি জোট করেন। রতনপুর রিয়েল এস্টেটকে জায়গাগুলো দখল করে দেবে এমন শর্তে তাদের মধ্যে আর্থিক লেনদেন হয়। গত ১২ মার্চ রাতে পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা আমাদের মৌরশি সম্পদের ওপর রতনপুর রিয়েল এস্টেটের সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেয়। এ সময় আমরা প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা আমাদের হত্যার হুমকি দেয় এবং বেঁধে রাখে। পরে ভোরে কাজ শেষ করে তারা ওই এলাকা ত্যাগ করে এবং সেখানে কিছু নিরাপত্তা কর্মী রেখে যায়। পরে ১৩ ও ১৪ মার্চ একই কায়দায় পর্যায়ক্রমে জায়গাগুলো দখল করতে থাকে। এ সময়ে কি মূলে জায়গাগুলো দখল করা হচ্ছে—এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে তারা কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি।
অভিযোগে তারা উল্লেখ করেন, জমি দখলের ঘটনার পর আমরা আকবর শাহ থানার ওসি মো. আলমগীরের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি আমাদের মিথ্যা মামলা দেয়ার হুমকি দেন এবং এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি না করতে বলেন। ওসি আরো বলেন, জায়গা দখলের ঘটনা সিটি মেয়রের নলেজে আছে। পরে আমরা সিটি মেয়রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিষয়টি অবহিত করলে মেয়র ঘটনা জানেন না বলে জানান এবং তারা বার বার একটি অভিযোগ দিতে বলেন। আমরা ১৫ মার্চ অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু গত ২৫ মার্চ রাত থেকে তারা দখল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বাধা দিতে গেলে আকবর শাহ থানার এসআই শফিউল আলম মুন্সী আমাদের মা-বোনদের শ্লীলতাহানির চেষ্টা ও মারধর করেছে।
অভিযোগকারী নুর উদ্দিন বলেন, নগরীর আকবর শাহ থানা পুলিশ ও কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসীমের সহযোগিতায় রতনপুর রিয়েল এস্টেট জোরপূর্বক আমাদের জমি দখল করছে। বুধবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে আমরা আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করব।
এদিকে অভিযোগের বিষয়ে আরএসআরএমের সহ-মহাব্যবস্থাপক (মানবসম্পদ ও প্রশাসন) মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ২০১১ সালের ১৮ অক্টোবর ও ২০১৪ সালের ২০ মার্চ রেজিস্ট্রিকৃত সাফকবলা দলিল মূলে কেনার ফলে আরএসআরএম ওই জমির মালিক। জমিটি কেনার পর সেখানে কেয়ারটেকার নিয়োগ করে রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করে আসছি আমরা। কিছু কিছু পরিবার সেখানে ভাড়াটিয়া হিসেবে অবস্থান করে আসছে। তাদের ঘর ছেড়ে দিতে বললে তারা উল্টো নিজেদের দখলদার হিসেবে দাবি করছে এবং আমাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করছে।
এদিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে রেলওয়ের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া ২ একর জায়গা নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি শিল্প গ্রুপ পিএইচপি ও কেএসআরএম। ইজারা সূত্রে দুইপক্ষই জায়গাটি নিজেদের বলে দাবি করছে। চলছে দখল-পাল্টাদখল। গত বৃহস্পতিবার এ ঘটনা ঘটার পর রোববার দখলের অভিযোগ এনে পিএইচপি গ্রুপ সীতাকুণ্ড থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে। অন্যদিকে কেএসআরএম গ্রুপ এক বিবৃতিতে বলেছে, বিরোধপূর্ণ ওই জায়গা নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে সমঝোতা প্রক্রিয়া চলমান আছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ডে পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস কারখানার পাশে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন ঘেঁষে থাকা ১৬০ একর জায়গা লিজ নিয়ে বনায়ন করেছে পিএইচপি গ্রুপ। এর মধ্যে পাঁচ একর জায়গায় দেশের বিলুপ্তপ্রায় বনজসম্পদ রক্ষায় ব্যতিক্রমী একটি (আরবোরেটম) প্রকল্প রয়েছে। এখানে রয়েছে সেগুন, মেহগনি, গর্জন, গামারি, চাপালিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির লক্ষাধিক গাছ। এই বনায়নের প্রবেশ পথে রেলওয়ের ১ দশমিক ৬৪ একর জমি আছে যেটা পার হয়ে সেই প্রকল্পে যাওয়া যায়। মূলত এই ১ দশমিক ৬৪ একর জমি নিয়েই বিরোধের সূত্রপাত।
পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ সুলতান মিয়া রোববার সীতাকণ্ড থানায় একটি করা জিডিতে উল্লেখ করেছেন, গত ২৯ মার্চ আনুমানিক সকাল ৯টায় পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রির পূর্বপাশে রেলওয়ের কাছ থেকে পিএইচপি ফ্লোট ইন্ডাস্ট্রির নামে লিজকৃত ভোগদখলীয় ভূমি কেএসআরএমের ৪০০ থেকে ৫০০ ভাড়াটে সন্ত্রাসী এসে জোরপূর্বক দখল করে নেয় এবং পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রির ৪ নম্বর গেটে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।
এই হামলার কারণে আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী ও ফ্যাক্টরির নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত আনসার সদস্যসহ বেশকিছু কর্মরত শ্রমিক আহত হয়। তারা খুঁটি গেড়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে পিএইচপির ১৬০ একর জায়গায় গড়ে তোলা ভোগদখলীয় বনায়ন এলাকায় যাওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছে।
সীতাকুণ্ড থানার ওসি মো. ইফতেখার হাসান বলেন, বিরোধপূর্ণ এ জায়গা কেএসআরএম গ্রুপ দখলে নিতে যায়। তখন পিএইচপি ও কেএসআরএম গ্রুপের লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। সেখানে যাতে ফের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না হয় সেজন্য অতিরিক্ত পুলিশ টহল রাখা হয়েছে। নতুন করে আর কোনো সমস্যা হয়নি।
এদিকে জমি দখলের বিষয়ে রোববার সকালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে কেএসআরএম গ্রুপের সিইও মেহেরুল করিম বলেন, কেএসআরএম গ্রুপ প্রচলিত আইন-কানুন মেনে ব্যবসা পরিচালনা করছে। অদ্যবধি এই গ্রুপের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বা জমি দখলের অভিযোগ কেউ উত্থাপন করতে পারেনি। পিএইচপি গ্রুপ যে জমি দখলের কথা বলছে, সেই জমির জন্য কেএসআরএম ও পিএইচপি উভয়পক্ষ আবেদন করলে রেলওয়ে নিজস্ব সার্ভেয়ার দিয়ে তদন্ত করে। পরে রেলওয়ের বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা ত্রিপক্ষীয় শুনানির মাধ্যমে কেএসআরএমের পক্ষে পরিচালক সেলিম উদ্দিনের নামে লাইসেন্স দেয়। ২০১৭ সাল থেকে এ জমি কেএসআরএমের দখলে আছে।
এর আগে কেএসআরএম বিষয়টি সমাধানের জন্য চট্টগ্রাম চেম্বারের দ্বারস্থ হয়। চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য এম এ লতিফ চেম্বার ভবনে দুইপক্ষকে নিয়ে মধ্যস্থতা বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকে উভয়পক্ষকে ইজারা নেওয়ার কাগজপত্র দাখিলের জন্য বলা হয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত উভয়পক্ষকে ওই জায়গা নিয়ে আর কোনো বিরোধে না জড়াতে বলা হয়। কিন্তু ২৯ মার্চ আবারও কেএসআরএমের পক্ষ থেকে খুঁটি গেড়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে জায়গাটি দখলে নেওয়া হয়। তবে এ জমিসংক্রান্ত বিরোধের বিষয় নিয়ে উভয় গ্রুপের মালিক পক্ষের মধ্যে সমঝোতার প্রক্রিয়া চলমান আছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে পিএইচপি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (এস্টেট) আমির হোসেন বলেন, কারো সঙ্গে শুধু শুধু বিরোধ সৃষ্টি করেছে, এমন রেকর্ড পিএইচপির নেই। রেলওয়ের কাছ থেকে বরাদ্দ (কৃষি লাইসেন্স) নিয়ে ওই জায়গায় বনায়ন করে পিএইচপি গ্রুপ। এখানে সমঝোতার কিছুই নেই। কেএসআরএম সমঝোতার কথা বলে মিথ্যাচার ও ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে।
এর আগে গত বছর ১৭ মে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়নের সুলতানা মন্দির দাশপাড়া এলাকায় পুলিশের সহযোগিতায় প্রায় ৫৪ শতক জমি দখল করার অভিযোগ উঠে জিপিএইচ ইস্পাত কারখানার বিরুদ্ধে। সেদিন জমি দখলে নেওয়া নিয়ে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। ২০১৬ সালের শুরুতে সীতাকুণ্ডের বড় কুমিরা এলাকায় পাহাড় কেটে ইস্পাত কারখানা নির্মাণের অভিযোগ উঠে স্থানীয় সাংসদ দিদারুল আলমের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গোল্ডেন ইস্পাত লিমিটেড বিরুদ্ধে। পরে তদন্তে নেমে পাহাড় কাটার সত্যতা পায় পরিবেশ অধিদফতর।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন বলেন, পাহাড় কেটে ও সরকারি জমি দখল করে ব্যবসায়িক স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে আমরা তৎপর আছি। এসব কাজে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পরিবেশ অধিদফতরকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এসব কাজ করব।