পুলিশের সার্জেন্ট নিয়োগে লিখিত পরীক্ষার ফলাফলে নাম ছিল না তার। অথচ মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি। ডাক্তারি পরীক্ষাও সম্পন্ন হয়েছে। শিগগিরই প্রশিক্ষণে যাওয়ার কথা তার। ভাগ্যবান এ হবু পুলিশ কর্মকর্তার নাম তরিকুল ইসলাম শিমুল। বাবার নাম আবদুর রব মাতাব্বর। রাজধানীর সবুজবাগের মাদারটেকের বাসিন্দা শিমুলের বাড়ি বরগুনা জেলার বেতাগী থানার মেহের গাজী করুনা গ্রামে। চলমান সার্জেন্ট নিয়োগ পরীক্ষায় তার রোল নম্বর-১৫২৬৮। লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ (মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করা) একাধিক চাকরি প্রার্থীর অভিযোগ, শিমুলকে নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে।
কেবল শিমুল নয়, সার্জেন্ট নিয়োগে টাকার খেলা হয়েছে। মোটা টাকার বিনিময়ে অনেকেই চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন। সূত্র বলছে, বিষয়টি নিয়ে আদালতে রিট করার প্রক্রিয়া চলছে।
তবে পুলিশের দাবি, শতভাগ স্বচ্ছতার সঙ্গে সার্জেন্ট নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। এখানে কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি। ভুলক্রমে লিখিত পরীক্ষার ফলাফলে শিমুলের নাম বাদ গিয়েছিল। পরে ফলাফল আপডেট করে তার নাম সংযুক্ত করা হয়। সে অনুযায়ী মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সম্পূর্ণ যোগ্যতার ভিত্তিতেই শিমুল চাকরির জন্য বিবেচিত হয়েছেন। শিমুল জানান, তিনি খুবই নিরীহ ও দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার পক্ষে অর্থিক লেনদেন করা সম্ভব নয়। প্রভাব খাটানোর মতো কোনো স্বজনও তার নেই। যথেষ্ট মেধা থাকার পরও তার চাকরি হচ্ছিল না। এবার নিছক ভাগ্যের জোরে তার চাকরি হয়েছে।
বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর লিখিত পরীক্ষার ফলাফলটি পুলিশ সদর দফতরের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। পরে অবশ্য কোনো রকম সংশোধনী ছাড়াই অনুত্তীর্ণ চাকরি প্রার্থী শিমুলকে উত্তীর্ণ দেখিয়ে ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
কথা হয় ২০ লাখ টাকা দেয়ার পরও চাকরি না হওয়া ১১৩৩৮ রোল নম্বরধারী ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার সৈয়দ আমানত আলীর সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘সার্জেন্ট নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবহিত করেছি।’
আমানত আলীর অভিযোগ, অনিয়মের মাধ্যমে যে জায়গায় শিমুলের রোল নম্বর প্রবেশ করানো হয় তার আগে পাঁচটি রোল নম্বর (১৫২৫৮, ১৬২৬০, ১৫২৬১, ১৫২৬৬ এবং ১৫২৬৭) ছিল। পরে ১৩টি রোল নম্বর (১৫২৭২, ১৫২৭৩, ১৫২৭৪. ১৫২৭৬, ১৫২৭৭, ১৫২৭৮, ১৫২৭৯, ১৫২৮০, ১৫২৮১, ১৫২৮২, ১৫২৮৬, ১৫২৮৭ এবং ১৫২৮৯) ছিল। তাদের কেউই মৌখিক পরীক্ষায় পাস করেনি। অথচ লিখিত পরীক্ষার ফলাফলে যার রোল নম্বরই ছিল না তিনিই মৌখিক পরীক্ষায় টিকে গেলেন। বিষয়টি রহস্যজনক উল্লেখ করে আমানত আলী বলেন, শিমুলের আগে-পরের এতগুলো রোল নম্বরের কেউই মেধাবী ছিলেন না? কেবল শিমুল একাই মেধাবী ছিলেন?’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিমুলকে ভাগ্যবান উল্লেখ করে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (রিক্রুটমেন্ট অ্যান্ড ক্যারিয়ার প্লানিং) মনিরুল ইসলাম বলেন, লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয় ১৫ জুন। এতে দুই হাজার ২৫টি রোল নম্বরের কথা বলা হলেও গণনার পর দেখা যায় রোল নম্বর আছে দুই হাজার ২৪টি। যে নম্বরটি বাদ পড়েছিল সেটি খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। পরে ওই রোল নম্বরটি বের করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আপডেট ফলাফল প্রকাশ করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ দেয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, মন্ত্রীকে এ ব্যাপারে ব্যাখা দেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে তরিকুল ইসলাম শিমুল যুগান্তরকে বলেন, ‘লিখিত পরীক্ষার ফলাফল দেখে হতাশ হয়েছিলাম। কারণ, ভালো পরীক্ষা দেয়ার পরও আমার রোল নম্বর ছিল না। কোনো উপায় না পেয়ে কেবল আল্লাহকে ডেকেছি। আমি এবং আমার মা এক লাখ ২৫ হাজার বার সুরায়ে ইউনুস পড়েছি। ফলাফল প্রকাশের ৫-৬ দিন পর শবেবরাতের দিন বিকাল ৪টার দিকে পুলিশ সদর দফতর থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান আল মামুন আমাকে ফোন করে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকেন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ার কথা তাকে জানালে তিনি বলেন, ফলাফল আপডেট করা হয়েছে। সেখানে আপনার নাম আছে। আপনি আপডেট ফলাফল দেখুন। এরপর পুলিশ সদর দফতরে গিয়ে আপডেট ফলাফল দেখে ১৩ আগস্ট মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিই।’
তরিকুল ইসলাম শিমুল জানান, ‘আমি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। এর আগে ১৯৯৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আমার মা পঙ্গু হয় এবং তিনি এখন হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। পরে আমার বাবা আবদুর রব মাতাব্বর দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বাবা কাজীরহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মাসে তিন হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন। ২০০৮ সালে তিরি অবসর নেন। তার বাবা আওয়ামী লীগ ও তিনি ছাত্রলীগের সমর্থক। তিনি সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে ২০১৫ সালে হিসাববিজ্ঞানে অনার্স ও ২০১৬ সালে মাস্টার্স পাস করেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেজ। বড় ভাই জসিম উদ্দিন শামীম ও ছোট ভাই মো. আলম এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। শামীম গাজীপুরে একটি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাকর্মী এবং আলম মিরপুরের একটি গার্মেন্টে কাজ করেন।
শিমুল জানান, ঢাকায় তিনি টিউিশনি করে চলেন। মা-কেও টাকা পাঠাতে হয়। জানতে চাইলে বরগুনা বেতাগীর ৩ নম্বর হোসনাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আলতাব হোসেন যুগান্তরকে জানান, শিমুলদের পবিবার খুবই নিরীহ। অভাব-অনটনের মধ্যেই তাদের সংসার। টাকার বিনিময়ে চাকরি নেয়ার মতো পরিস্থিতি তাদের নেই। প্রভাবশালী কোনো স্বজনও নেই।