অনলাইন ডেস্ক: ১২ বছরে বিসিএস পরীক্ষাসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী। ঢাকায় একটি ছয়তলা বাড়ি, তিনটি ফ্ল্যাট ও একটি গাড়ি রয়েছে তার। আর গ্রামের বাড়িতে রয়েছে ডুপ্লেক্স বাড়ি।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছেন আবেদ আলী। সিআইডি আরও জানিয়েছে, অন্তত ৫০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। তবে সিআইডির কর্মকর্তাদের ধারণা, আবেদ আলীর আরো সম্পদ রয়েছে।
মঙ্গলবার (৯ জুলাই) সকালে মিরপুর থানার পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ওয়াসা রোডে গিয়ে জানা যায়, বিসমিল্লাহ টাওয়ার নামের একটি ৯তলা ভবনে সপরিবারের বসবাস করেন আবেদ আলী । ওই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী সোহেল খান জানান, আবেদ আলী পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাটে দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে থাকেন।
সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেছেন, শেওড়াপাড়ার ভবনটির পঞ্চম তলায় দুটি ও চতুর্থ তলায় একটি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। পাইকপাড়ায় তার একটি ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। ব্যাংকে তার নগদ টাকা রয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী সিআইডির কর্মকর্তাদের বলেন, গত বছরের শেষের দিকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ৩ হাজার ১০০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের অনেকের কাছে ফাঁস করা প্রশ্ন বিক্রি করেছেন এবং তাদের চাকরিও হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত অভিযোগে গতকাল সোমবার রাজধানীর শেওড়াপাড়ার ওয়াসা রোডের নিজ ফ্ল্যাট থেকে সৈয়দ আবেদ আলী ও তার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান ওরফে সিয়ামকে গ্রেপ্তার করা হয়।
একই সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় পিএসসির দুজন উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালকসহ আরও ১৫ জনকে। আজ মঙ্গলবার পল্টন থানায় তাদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্ম কমিশন আইনে মামলা করেছেন সিআইডির এক কর্মকর্তা।
আবেদ আলীর ছেলে সোহানুর রহমান ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। গতকাল ওই সংগঠন থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
অনলাইন ডেস্ক: ১২ বছরে বিসিএস পরীক্ষাসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী। ঢাকায় একটি ছয়তলা বাড়ি, তিনটি ফ্ল্যাট ও একটি গাড়ি রয়েছে তার। আর গ্রামের বাড়িতে রয়েছে ডুপ্লেক্স বাড়ি।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছেন আবেদ আলী। সিআইডি আরও জানিয়েছে, অন্তত ৫০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। তবে সিআইডির কর্মকর্তাদের ধারণা, আবেদ আলীর আরো সম্পদ রয়েছে।
মঙ্গলবার (৯ জুলাই) সকালে মিরপুর থানার পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ওয়াসা রোডে গিয়ে জানা যায়, বিসমিল্লাহ টাওয়ার নামের একটি ৯তলা ভবনে সপরিবারের বসবাস করেন আবেদ আলী । ওই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী সোহেল খান জানান, আবেদ আলী পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাটে দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে থাকেন।
সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেছেন, শেওড়াপাড়ার ভবনটির পঞ্চম তলায় দুটি ও চতুর্থ তলায় একটি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। পাইকপাড়ায় তার একটি ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। ব্যাংকে তার নগদ টাকা রয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী সিআইডির কর্মকর্তাদের বলেন, গত বছরের শেষের দিকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ৩ হাজার ১০০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের অনেকের কাছে ফাঁস করা প্রশ্ন বিক্রি করেছেন এবং তাদের চাকরিও হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত অভিযোগে গতকাল সোমবার রাজধানীর শেওড়াপাড়ার ওয়াসা রোডের নিজ ফ্ল্যাট থেকে সৈয়দ আবেদ আলী ও তার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান ওরফে সিয়ামকে গ্রেপ্তার করা হয়।
একই সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় পিএসসির দুজন উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালকসহ আরও ১৫ জনকে। আজ মঙ্গলবার পল্টন থানায় তাদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্ম কমিশন আইনে মামলা করেছেন সিআইডির এক কর্মকর্তা।
আবেদ আলীর ছেলে সোহানুর রহমান ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। গতকাল ওই সংগঠন থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
ছোট্ট একটি তালায় ঘরবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন কাটছে সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোস্তফা কামালের। অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত এই কর্মকর্তার ভালো চিকিৎসা হয়নি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থতাও বেড়েছে। অন্ধকার কক্ষে থাকেন বিবস্ত্র হয়ে। খাবার খান নিজের ইচ্ছা মতো। প্রলাপ বকেন শুধু কর্মস্থলের প্রতি অনিহার বিষয় নিয়ে।
সর্বশেষ সাভার পরমাণু শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে ২০১৬ সালে বাধ্যতামূলক অবসরে যান মোস্তফা কামাল। এরপর থেকে ছোট ভাইয়ের কাছে গ্রামের বাড়িতে বসবাস করছেন তিনি। বিনা চিকিৎসায় অযন্তে অবহেলায় অন্ধকার কক্ষে জীবন কাটছে তার। পরিবারের অভিযোগ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। আর জনপ্রতিনিধিরা বলছেন তার চিকিৎসার বিষয়ে পরিবারের অবহেলা রয়েছে।
খোকসা উপজেলার বেতবাড়িয়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের চান্দট গ্রামের স্কুলশিক্ষক আফতার মন্ডল ও জহুরা খাতুন দম্পতির ৯ সন্তানের মধ্যে মোস্তফা কামাল দ্বিতীয়। ছেলেবেলা থেকে দারুন মেধাবী ছিলেন। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শেষ করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছেন শৈলকুপা উপজেলায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করার পরের বছর ১৯৯১ সালে পরমাণু শক্তি কমিশনের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে সরকারি চাকরি পেয়ে যান। এরপর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের পারমাণু চিকিৎসা কেন্দ্রে যোগদান করেন।
অল্প সময়ের মধ্যে কর্মস্থলে সুনাম অর্জন করলেও বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। মানসিক সমস্যার কারণে ৪ বছরের মাথায় ১৯৯৪ সালে তাকে পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাভারে বদলি করা হয়। মানসিক অবস্থা ক্রমাগত জটিল আকার ধারণ করায় ২০১৬ সালে তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। পেনশনের অর্ধকোটি টাকা ব্যাংকে রাখা হয়। এছাড়া প্রতিমাসে পেনশন হিসেবে প্রায় ১৯ হাজার টাকা পান।
কিন্তু ভাইদের পাওয়া না পাওয়ার হিসাবের গড়মিলে সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার চিকিৎসা ও পরিচর্যায় ভাটা পড়ে। টানা তিন বছর রাখা হয়েছে ঘরবন্দি করে। শুধু দু’বেলা দু’মুঠো খবার দেওয়ার জন্য ঘরের দরজার তালা খোলা হয়। ঘরের মেঝেতেই প্রাকৃতিক কার্য সারেন। অনাদর আর অবহেলায় ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছেন মেধাবী এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
মানসিকভাবে অসুস্থ সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার দেখ-ভালের দায়িত্ব পড়েছে ছোট ভাই আমজাদ হোসেনের ওপর। মা জহুরা খাতুন ছেলের চিন্তায় প্রায় ৬ বছর আগে মারা গেছেন। একদিকে বিনা চিকিৎসা অন্যদিকে অবহেলায় মানসিক বিকারগ্রস্ত মোস্তফা কামালে শারীরক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। এখন সুযোগ পেলেই ঘর থেকে বেরিয়ে কৃষককের ফসল তছরুপ করেন। যেকোনো বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েন। এতে বাড়ির নারীরা ভয় পান। এমন অভিযোগেই তাকে ঘরবন্দি করে রাখা হয়েছে।
ঘরবন্দি বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার খোঁজ নিতে চান্দট গ্রামে তার গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয়। বাড়ির একটি আধাপাকা ঘরের দরজায় ছোট্ট একটি তালা দিয়ে তাকে বন্দি রাখা হয়েছে। অসুস্থ সাবেক এই কর্মকর্তার দেখ-ভালের দায়িত্বে থাকা আমজাদ হোসেন দরজা খুলে দিলেন। সাংবাদিক আসছে শুনে বললেন, ‘জানালায় আসতে বলো।’
পরিবারের লোকদের সঙ্গে ঘরে ঢুকে দেখা গেলো, অনেকটা আয়াশী ভঙ্গিতে তিনি চৌকির ওপর শুয়ে আছেন। পাশেই সারিবদ্ধ কয়েকটি টিনের বাক্স রাখা। ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা এমনকি আলোর ব্যবস্থাও রাখা হয়নি। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও কোমর থেকে পা পর্যন্ত একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে শুয়ে আছেন। শুদ্ধ ভাষায় সব প্রশ্নের স্বাভাবিক উত্তর দিচ্ছিলেন। চাকরি সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই অনেকটা প্রতিবাদের সঙ্গেই বলে উঠলেন, ‘চাকরিতো করা যাবে না। চাকরি করা মহাপাপ। পৃথিবীর মানুষ যারা তারাতো চোর ডাকাত পিচোট। আমি কেবল ভালো মানুষ। আর সব চোর ডাকাত পিচোট। এইজন্যই চোর ডাকাত পিচোটদের সঙ্গে চাকরি করা এটাতো আমার উচিত না। অফিসের সঙ্গে সরকারের সঙ্গে সমস্ত কিছু বাদ।’
স্বাভাবিক কথপোকথনের ফাঁকে এক সময় উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, বললেন ‘বেরিয়ে যাও’।
সাবেক এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার বড় ভাই নজরুল ইসলামও সাবেক সেনা সদস্য। তিনি দুষলেন তার ভাইয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। তিনি বলেন, মোস্তফা কামাল কী কারণে অফিস করছেন না। তার সমস্যা কোথায়। এসব অনুসন্ধান না করে তার চাকরি খাওয়ার বন্দোবস্ত করেন তারা।
তিনি আরও জানান, পদস্থ কর্মকর্তাদের অনৈতিক চাপে তার ভাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। একবার অফিসের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এরপর থেকে অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দেন। তবে তাকে উল্লেখযোগ্য চিকিৎসা করাতে পারেননি বলে স্বীকার করেন। এছাড়া তাকে ওষুধও খাওয়ানো যায় না। ওষুধ ফেলে দেন। বছর দু’য়েক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তার চিকিৎসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সে উদ্যোগ কিছু দূর এগিয়ে হোচট খেয়েছে।
ছোট ভাই আমজাদ হোসেন বলেন, মায়ের মৃত্যুর পর মোস্তফা কামাল বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। কৃষকের বিভিন্ন ফসল তছরুপ শুরু করেন। এমন ঘটনায় কয়েক দফায় জরিমানাও গুনেছেন। অনেক সময় অন্যের বাড়িতে ঢুকে পড়েন, মেয়েরা ভয় পায়। এখন মানুষের সঙ্গে খুবই খারপ আচরণ করেন। ফলে তাকে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। ঘরের মধ্যে প্রস্রাব-পায়খানা করার ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু সেখানে না গিয়ে মেঝেতেই প্রকৃতির ডাক সারেন। শীত মৌসুমে কাপড় পরলেও খাওয়ার সময় সব কাপড় খুলে ফেলেন।
তিনি আরও জানান, মোস্তফা কামালকে ডাক্তাররা চিকিৎসা দিতে চান না। যে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় সেই বলেন, ‘স্যার তো আমাদের ডাক্তার, তাকে কী চিকিৎসা দেবো।’ এছাড়া তার পেনশনের ৩৯ লাখ ৭৮ হাজার টাকা ব্যাংকে তার নামে জমা রয়েছে। শুধু মাসিক পেনশনের টাকা তুলে খরচ করা হয়।
বনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও বেতবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম জমির বলেন, সম্প্রতি জাতীয় সংসদ ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় তিনি ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন। মোস্তফা কামালের অবস্থা দেখে তারও হৃদয়ে দাগ কেটেছে। স্ত্রী-সন্তান না থাকা ও নগদ টাকা সম্পত্তি নিয়ে ভাইদের মধ্যে কিছু বিরোধ সৃষ্টি হওয়ায় তার চিকিৎসা ও সেবা দুটোই ব্যাহত হচ্ছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
দেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় দুর্নীতি। মানুষের মুখে মুখে সরকারের আমলা, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, সরকারদলীয় নেতা, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের কারও কারও বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ কান পাতলেই শোনা যায়।
দুর্নীতির অভিযোগগুলো এত দিন সরকারবিরোধীদের অপপ্রচার বলে চালানো হলেও এখন বিষয়টি সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেকের কাছেও অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। আগুনে ঘি ঢালার মতো কয়েকটি ঘটনার পর এখন এটা মুখরোচক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মো. মতিউর রহমানসহ বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতির নানা অভিযোগ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে নিয়মিত খবর প্রকাশিত হচ্ছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা চার মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে বলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে। অবশ্য কয়েক বছর ধরেই এটা বলা হচ্ছে যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সরকার জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে চলছে। প্রশ্ন উঠেছে, সরকার জিরো টলারেন্স নীতি নিলেও দুর্নীতি না কমে বাড়ছে কেন? কারণ আমার কাছে অতি পরিষ্কার, যে সরকার গছতন্ত্র হত্যা করে, অবৈধভাবে সরকার গঠন করে, তার পক্ষে দুর্নীতি বন্ধ করা সহজ না।
মন্ত্রি-সভার বৈঠক-পরবর্তী সংবাদ ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন জানিয়েছেন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের প্রতি সরকার কোনো সহানুভূতি দেখাবে না এবং দেখানো হচ্ছেও না বরং সরকার নিজেই দুর্নীতি করে টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের উপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে।রূপকল্প ২০৪১-এর মূল লক্ষ্য হলো—দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ জন্য সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোরভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে। নির্বাচনী ইশতেহারেও স্বচ্ছ ও জবাবদিহির কথা বলা হয়েছে।কিন্তু সরকারী নেতাকর্মীদের দিতে তাকালে দেখা যায় তারা নিয়মের বাহিরে গিয়ে প্রতিনিয়ত দুর্নীতি করে চলচ্ছে।
রূপকল্প ২০৪১-এর মূল লক্ষ্য হলো দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ জন্য সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোরভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে। নির্বাচনী ইশতেহারেও স্বচ্ছ ও জবাবদিহির কথা বলা হয়েছে।কিন্তু সরকারী নেতাকর্মীদের দিতে তাকালে দেখা যায় তারা নিয়মের বাহিরে গিয়ে প্রতিনিয়ত দুর্নীতি করে চলচ্ছে।আমাদের দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিচারের প্রক্রিয়াটাই জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সংসদ সদস্য সহ আওয়ামিলীগের নেতাকর্মী অর্থ পাচারে মরিয়া হয়ে উঠচ্ছে। ২০১৯ সালের ক্যাসিনো-কাণ্ডের কথাও উল্লেখ করা যায়। অবৈধভাবে ক্যাসিনো পরিচালনা করচ্ছে আওয়ামিলীগের নেতাকর্মী প্রসাশন এই ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না।বি এন পির চ্যায়ারপাসন খালেদা জিয়ার শাসন আমল, ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ এই দুইভাগে ভাগ করেন অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক।
আমেরিকার পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের শিক্ষক ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বলেন, খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে দুর্নীতি তেমন একটা বিস্তার লাভ করেনি।এই কথা দিয়া প্রমান হয় আওয়ামিলীগ সরকার দুর্নীতি উৎসদাতা সরকার। বর্তমান সরকারের অধিনে যে দুর্নীতি হয়েছে যা বাংলাদেশের ইতিহাসের রেকর্ড ব্রেক করেছে।খালেদা জিয়ার তৃতীয় মেয়াদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল: রপ্তানি আয় ও বিদেশ থেকে প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিটেন্স দ্রুত বৃদ্ধি, শিল্প ও টেলিযোগাযোগ খাতের দ্রুত বিকাশ, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বমুখী ধারা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নকল্পে অপারেশন ক্লিন হার্ট। এই সকল কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করেও বিএন পি নেতাকর্মীরা বর্তমান সরকার আওয়ামিলীগের মিথ্যা ও দুর্নীতি মামলায় কেউ কারাগারে কেউবা পালিয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে।
এমতাবস্থায় একজন উন্নায়ন কর্মী ও রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে বর্তমান সরকারকে আওয়ামিলীগকে সরিয়ে নতুন সরকার নিয়ে আসা জনগনের সময়ের দাবী।এখনি সময় এই দুর্নীতি বাজ আওয়ামী লীগ সরকারকে বর্জন করে নতুন সরকার গঠন করতে হবে। আগামীর দেশকে একমাত্র সঠিক দিশা দিতে পারে বিএনপি । এখনি সময় সরকার গঠনে তাদের পাশে থাকতে হবে জনগনকে।
লেখক- মোঃ আওলাদ হোসেন; উন্নয়নকর্মী ও রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব|
Online Desk(DTV BANGLA NEWS): রাজধানীর মুগদায় সিএনজি পাম্পে ট্রাকে গ্যাস নেওয়ার সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় একজন আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার (২১ মার্চ) ভোর ৫টার দিকে মুগদা স্টেডিয়াম সংলগ্ন বেস্ট ইস্টার্ন সিএনজি পাম্পে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতের নাম সাদ্দাম হোসেন (২৫)। তিনি ওই ট্রাকের হেলপার ছিলেন। মুগদা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামাল উদ্দিন মীর ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ভোরে বেস্ট ইস্টার্ন সিএনজি পাম্পে ট্রাকটি গ্যাস নিচ্ছিল। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন চালকের সহযোগী। এমন সময় বিকট শব্দে ট্রাকের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়। এতে সাদ্দামের শরীর প্রায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় সে। আহত হয় ট্রাকেরর এক শ্রমিক। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে সিলিন্ডারে গ্যাসের প্রেশার অনেক বেশি হয়ে গিয়েছিল অথবা সিলিন্ডারটি মেয়াদ উত্তীর্ণ ছিল। তাই দুর্ঘটনা ঘটে। তবে বিস্তারিত জানার জন্য কাজ চলছে। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) মর্গে পাঠানো হয়েছে।
শ্রষ্টার সৃষ্টি আমরা। নির্মাতা এবং আকৃতিদাতা তিনি। বয়সের তারতম্য, রোগ-বালাইয়ের কারণে আমাদের আকৃতি বিভিন্নরূপ দেখা দেয়। ভেঙে যায় সব কিছু। আমরা নশ^র। কর্মগুণে আমাদের পরিচিতির ভালোমন্দের নানান দিক উঠে আসে। অনন্য সাধারণ মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষদের ভারি ওজনদার করে তোলে। মানুষের মৌলগুণ হলো বুদ্ধিবৃত্তি এবং বিবেক আর তাদের চরিত্রটার অনুরূপ পরিস্ফুটন ঘটুক- এটাই কাম্য। শক্তিশালী রাজারা শক্তির মহড়া দেয়। জয় করতে চায় পুরো বিশ^। নির্যাতন, শোষণ চলে দুর্বলদের ওপর এবং সংখ্যালঘিষ্ঠদের ওপর। রাজশক্তির পরিবর্তন হয়ে রাজা প্রজা বনে যায়। অহংবোধ আর গর্বের তর্জনীর শেষ পরিণতি চাক্ষুষ করে সবাই কিন্তু সাময়িক লোভ আর মোহের বশে বিপথগামী হয়ে ওঠে তখন বুদ্ধিবৃত্তি হয়ে যায় খাটো। ওজনটাও কমে আসে তখনই। নমরুদের মতো দাপুটে বাদশার নাকে ঢোকা মশা মস্তকে পৌঁছালে শেষ হবার করুণ কাহিনি সবারই জানা। তারপরও ভোগবাদীদের দৌরাত্ম্য কমে না। ভালো মানুষ পাওয়া এখন স্বপ্নলব্ধ বিষয়। এমপি শহিদ ইসলাম পাপুল, নাঈমুর রহমান দুর্জয় এবং এনামুল হকদের দুর্নীতি আর পাহাড়সম সম্পদের যে খবর পাওয়া যাচ্ছে তা কিন্তু সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। দলটির ঐতিহ্যের ইতিহাস আর অর্জনের ইতিহাস খাটো না। আবার নানাবিধ ষড়যন্ত্রের কবলে থাবা খেয়ে দুর্ভোগটাও পোহাতে হয়েছে কম না। দুর্জয় এবং এনামুল হকের আমলনামা কেন দলটির হাতে নেই, কেনইবা সরকার-প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নখদর্পণে নেই- তা বোধগম্য হবার নয়। কাউয়া, ফেউর কোন পথ দিয়ে দলে ঢোকে- এসব ভাবতেই মন বিষন্ন হয়ে যায় নিজের অজান্তেই। ৭১তম জন্মবার্ষিকী এবং মুজিব শতবর্ষ উদযাপনের পূর্বেই সংগঠন এবং কজন সাংসদের পুরোটাই বিশুদ্ধকরণে আত্মনিয়োগ করাটা প্রয়োজন ছিল বলে আমরা মনে করি। আত্মমর্যাদা রক্ষার জ্ঞান যাদের নেই তাদেরকে সাংসদ হবার সুযোগ দেওয়া কি সঠিক? অসম্ভব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি করে স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করতে বলেছিলাম। এখন ঘরে ঘরে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চাই। বঙ্গবন্ধুকে আমরা শ্রদ্ধা করি, তাঁর নির্দেশনা মানতে পারব না? প্রশ্নটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কেন করতে পারব না? করোনার কিট তথ্যে লুকোচুরি, করোনায় আক্রান্ত তথ্যে এবং মৃতদের তথ্যেও গোঁজামিল- এসব কেন হচ্ছে! কারা এটার দেখভাল করছে? তারা কি রাষ্ট্রের শত্রæ? সবকিছুতেই হযবরল হতে থাকলে করোনা নিবৃত্তকরণে সরকারের পদক্ষেপ তো কার্যকরী হবে না। নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি একরামুল চৌধুরী স্বাস্থ্যখাতের অনিয়মের কথা ফেসবুকে স্টেটাস দিয়েছিলেন, এটা কিন্তু একজন এমপির বিচক্ষণহীনতার লক্ষণ। তিনি সংসদীয় কমিটিতে কথা বলতে পারতেন- পারতেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও জানাতে। তাছাড়া রাশেদ খান মেননও সরকারের শরিক, ‘দুর্নীতিতে বেহাল স্বাস্থ্যখাত’ এই মর্মে তিনিও পত্রিকায় কথা বলেছেন। ঘরের মানুষ যদি বাইরে কথা বলেন- তাতে কিন্তু সরকারের গৃহীত কার্যক্রম অবশ্যই ম্লান হয়ে যাবে। একরামুল চৌধুরীকে এমপি হিসেবে রাখলে তার ভিডিও ভাইরালের দায় সরকারকেই নিতে হবে? এবং প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠবে জনমনে- সরকার কি করোনা সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অর্বাচীন কিছু এমপি কি আওয়ামী লীগের খুবই প্রয়োজন? বড় দুশ্চিন্তায় থাকেন তারা, যারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে শ্রদ্ধা করেন। যারা তাঁর নেতৃত্বের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখেন। জোট শাসকদল দু’শ এর অধিক পদে নির্বাচনী কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছিল। তারা কিন্তু তাদের কোনোই কাজে আসেনি বা আসছে না। প্রত্যেক এমপি-মন্ত্রীর পেছনে কাউয়া বা ফেউর রয়েছে, তারা মধু আহরণের পর উড়ে যাবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য বিভাগে ‘মিঠু সিন্ডিকেট’, এমনকি সিন্ডিকেট হোতার নামও পত্রিকান্তরে এসেছে- এখনই সময় স্বাস্থ্য বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত এবং দালালদের বিদায় করবার। করোনাকালে বিদ্যুৎ বিল নিয়েও কথা উঠেছে। পূর্বের বিদ্যুৎ বিলের তুলনায় ডিজিটাল বিদ্যুৎ বিল দ্বিগুণ আসছে। সাধারণ মানুষের আয় কিন্তু দ্বিগুণ হয়নি। গ্যাসবিলও বাড়তি। যারা এসব নিয়ে মুখ খুলেছেন তাদেরকে রাষ্ট্রের শত্রু মনে করার কোনো কারণ নেই। ধীরে ধীরে জনমনে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে। আস্থা কমে গেলে ওই ফাটল পথে বিরোধীরা ঢোকার চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। দলীয় এমপি যারা চেইন অব কমান্ডের বাইরে কথা বলেছেন তারা মানুষের মনে আশাহত অবস্থার সৃষ্টি করছেন। অন্যদিকে করোনার থাবায় দিশেহারা মানুষ, তারা নানা প্রতিশ্রুতি চায়। আতঙ্ক আর ভয় যদি তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে যায় এবং জীবনযুদ্ধে যদি পরাহতভাবের উদয় হয় তারা ষড়যন্ত্রকারীদের উস্কানিমূলক কথাকেই অন্তকরণ করতে থাকবে- তখন নিশ্চয়ই বিপজ্জনক অবস্থার অবতারণা ঘটতে পারে। ষড়যন্ত্রকারীরা অতীতে খুনীদের প্রকাশ্যে মঞ্চে উঠিয়ে বলাতে পেরেছে- ‘আমিই মুজিবের খুনি’; তখন কিন্তু আমজনতা হ্যাঁ করে দেখেছে। বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ আনন্দিত হয়ে দোলনায় দোল খেয়েছে। সমাজের আমজনতা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ চায়। তাইতো ২০০৮ সালের নির্বাচনে অকল্পনীয় বিজয় হয়েছিল মহাজোটের। সমাজ রাষ্ট্রের অধিকাংশের স্বপ্ন ভালো শাসকের। জনগণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর মাত্রাতিরিক্ত ভরসা রাখে। প্রধানমন্ত্রীর উপলব্ধিটা জনমানসে অটুট থাকুক- প্রত্যাশা আমাদের অনুরূপই। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এক নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছে। প্রশাসনিক দক্ষতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনিই বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোডম্যাপে বিকশিত করে বিশে^র দেশে দেশে নতুন মাত্রায় আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আপনি দেশের মানুষকে ভালোবাসেন। দেশবাসীও আপনাকে ধারণ করেছে হৃদয়ে; কিন্তু তার পরও মানুষ নিজের জীবনকেও বেশি ভালোবাসে। করোনা সংকটকালীন সময়ে আত্মীয়-পরিজনরা লাশ দাফনে অংশ নিচ্ছে না। আবার বৃদ্ধ মাতা-পিতাকেও জীবনের মায়ায় ফেলে রেখে আসছে জঙ্গল বা রাস্তায়। জীবন বিপন্ন মানুষদের পুঁজি করা খুবই সহজ। ওঁৎ পেতে থাকা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী বলয় কোন ফাটল পথে ঢুকে যাতে দেশটাকে ক্ষত-বিক্ষত করতে না পারে সেভাবে সমাজ-রাষ্ট্রের বন্ধনকে সরল সমীকরণে হৃদয়ে গেঁথে রাষ্ট্র পরিচালনার বিকল্প কিছুই নেই।
মোঃ ফজলুল হক মাস্টার জামালপুর মোবাইল: ০১৭২১-৫৭৫৪৯৩
পৃথিবীতে মার্চ ২০২০ থেকে কোভিড ১৯ এর মহামারীর কারণে অর্থনীতিতে যে ধ্বস সৃষ্টি হয়েছে তাতে এই বিপর্যয় ঠেকাতে বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের জনগণকে কিভাবে পুষিয়ে দেবে সেই কাজে ব্যস্ত। সরকারের কোনো প্রণোদনা বা ঋণ ২০২০ সনের এই করোনাকালে দেশের অতি ধণী ১ কোটি ৩০ লক্ষের জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিত না। কারণ কোভিড জনিত কারণে পৃথিবীর অর্থনৈতিক মন্দা অতি ধনীদের স্পর্শ করবে না। পাশাপাশি দেশের গন্ডি ছেড়ে যারা বিদেশে ব্যবসা ও স্থাপনা করেছে; তাদের বিষয়ে দেশের ব্যাংকের কোন দায়িত্ব থাকা উচিত না। বিশিষ্ট্য অর্থনীতিবিদদের মতে, ৬ কোটি ১৫ লক্ষ লোক এই করোনা কালে দরিদ্র সীমার নীচে নেমে গেছে। দেশের রপ্তাণী বাণিজ্য এক বছর আগে থেকেই অবনমন চলছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মার্শাল প্ল্যান গ্রহণ করে ইউরোপের দেশগুলো তাদের অর্থনীতিকে আগের চেয়ে উন্নত করেছিল। ক) পৃথিবীব্যাপী কোভিড ১৯ এর প্রাক্কালে: বৃটেনের সরকার যাদের নূন্যতম ১৬ হাজার পাউন্ড ব্যাংকে জমা ছিল; অন্যদেরকে প্রণোদনা দিয়ে তাদেরকে বলেছে যে, আগে সেখান থেকে খরচ করে চলতে হবে। খ) আমেরিকার সরকার যাদের ১০ হাজার ডলারের নিচে আয় তাদেরকে প্রথম স্ল্যাবে টাকা দিয়েছে। এরপর প্রয়োজন ও আবেদন অনুযায়ী স্ল্যাব বাড়িয়েছে। গ) পাকিস্তান সরকার কমিউনিটি বেইজড ফ্রি ওয়েব পোর্টাল আপলোড করেছে। যাদের যা সমস্যা তারা তা সেখানে আপলোড করার জন্য। তারা ১ কোটি ২০ লক্ষ লোককে ৪ মাস ধরে মাসিক ১২ হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ঘ ) বাংলাদেশ সরকার অতি দরিদ্রদের জন্য ঘর করে দেয়া সহ অর্ধকোটি লোককে সরাসরি তাদের মোবাইলে টাকা দিয়েছে। কারা পেয়েছে সেটা একটা ওয়েব পোর্টালে দিয়ে দিলে কিংবা প্রিন্ট মিডিয়ায় দিয়ে দিলে অনেক প্রশ্ন কমে যেতো। একটা দেশের অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত হয় তখন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সেই দেশের শিল্পখাত ও সেবাখাতকে পৃষ্ঠপোষকতা করা। প্রধানমন্ত্রী ১৩ এপ্রিল, ২০২০ ইং তারিখে একটা পরিপূর্ণ প্যাকেজ ঘোষণা দেন। যা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় দেশের ব্যাংকসমূহকে। ব্যাংকগুলোর কর্তারা সমানে বলে যাচ্ছেন যে, ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের টাকা মেরে দিচ্ছে। তাহলে কি করতে হবে ? ব্যাংকগুলো কি তাহলে ঋন দেয়া বন্ধ রাখবে। আর কর্তারা কি তাহলে শুধু বসে বসে বেতন খাবে? ব্যবসা হচ্ছে অর্থনীতির রক্ত প্রবাহ। আর ব্যবসায়ী হচ্ছে তার হৃদপিন্ড। সেই ব্যবসায়ীকে জীবন দেয়া, বাঁচানো, অক্সিজেন দেয়া একটি সরকারের কাজ বা দায়িত্বের অংশ। একজন ব্যবসায়ী হচ্ছে একজন উদ্যোক্তা। একজন ব্যবসায়ী কখনো বসে থেকে জীবন অতিবাহিত করে না। সে সরকারকে কর দেয়, কর্মসংস্থান করে। করোনাকাল শুরুর প্রথম থেকেই সরকার ঘোষিত প্যাকেজের মাধ্যমে সরকার বুঝিয়ে দেয় যে, এই বিষয়ে সে সজাগ। একজন ব্যবসায়ীকে ঋণ দেয়ার আগে ও পরে ব্যাংক তার উপর বিভিন্ন রকম দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান, ঘোষিত ও অঘোষিত খরচের কাঁচি চালাতেই থাকে। এটা করে তারা কিছু বাড়তি আয় করে নেয়। পৃথিবীব্যাপী কোভিড ১৯ জনিত কারণে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়লেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আগে থেকেই মন্দা চলছিল। বেশীর ভাগ গার্মেন্টস আগে থেকেই বন্ধ হয়ে পড়ছিল। সরকার ১ লক্ষাধিক কোটি টাকার ১৯টি প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছে। যার সিংহভাগ হবে ব্যাংকের মাধ্যমে। জনগণকে প্রণোদনা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখাও সরকারের কাজ। সরকার নিজে খাদ্য সাহায্য দিয়েছে ও দিচ্ছে। যেহেতু সরকারের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। সরকার জনগণকেও দরিদ্রদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে আহবান জানিয়েছে। এই প্যাকেজ মোট জিডিপির সাড়ে তিন (৩.৫) ভাগের বেশী না। অতি ধনীদের অন্যান্য দেশের মতো দরিদ্রদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়াতে তেমন একটা দেখা যায় নাই। যা করেছে তা হচ্ছে, সমাজের মধ্যবিত্ত সচেতন অংশ থেকে। ব্যাংকের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো যে, সে মর্টগেজ চায়। মর্টগেজ খুবই অযৌক্তিক একটা শর্ত। যে কোন লোন দেয়ার আগে ব্যাংক সেই লোন ফেরত পাওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাই করে নেয়। যে কোন লোক মর্টগেজ নিয়ে ব্যাংক হাজির হলেই ব্যাংক তাকে ব্যাংক লোন দেয় না। আবার কোন উদ্যোক্তাকেও লোন দেয় না। গাড়ির জন্য বা গৃহ ঋণ দেয়ার আগে বা অন্য কোন ব্যবসার জন্য ঋণ দেয়ার আগে; ব্যাংক যাচাই করে নেয় সেই ঋন গ্রাহক ঋন শোধ করতে পারবে কিনা। ১৩ এপ্রিল, ২০২০ ইং তারিখে সরকার শিল্পখাত ও সেবা খাতের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছে। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি শাখা থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে । শিল্পখাত তার ফ্যাক্টরির জায়গা, অন্যান্য জায়গা, তার নতুন ও পুরাতন আমদানি করা মেশিন বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে লোন নিতে পারে। সেবা খাত যদি এটা দিতে পারতো তাহলে তো তারা শিল্পই স্থাপন করে ফেলতো। সেবা খাত হচ্ছে মেধা ও অভিক্ততা। এই অভিক্ততা অর্জন করতে অর্থ ও সময়ের প্রয়োজন হয়। বন্ধকি বাড়ি, গাড়ি, জায়গা ২০-৩০ ভাগ দামে নিলামে বিক্রি করে খেলাপী ঐ গ্রাহককে পথে বসিয়ে তারপর তাকে জেলে ঢোকানোর ব্যবস্থা করে। যা অযৌক্তিক। বিভিন্ন কারণে একজন উদ্যোক্তা তার ব্যবসা হারিয়ে ফেলতে পারে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যার কারণে এটা হতে পারে। অতি খরচ বা অতি বাকি দিয়ে। বা অতি সুদের কারণেও হতে পারে। মূলত যাদের মর্টগেজ দেয়ার মতো সম্পদ রয়েছে, তারাই শুধু ব্যাংকের কাছে ঋণের জন্য আবেদন করতে পারে। তৃতীয় জনের জায়গাও বন্ধক দেয়া যায়। একজন গ্যারান্টরও লাগে। বেচারা গ্যারান্টর কোন লাভের অংশীদার না। তথাপি ব্যাংক কর্মচারীরা গ্যারান্টরের জীবন ওষ্ঠাগত করে ফেলে। আবার হেনস্তা করার জন্য ভাড়াটে লোকজন ও রাখে। একজন অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীকে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে সরকারের কর্তব্য। যারা মর্টগেজ দিতে পারবে না। রাজস্ব বিভাগে দেয়া তাদের স্থিতিপত্র ও ব্যাংকে লেন-দেনের উপর ভিত্তি করে; সরকারের তাদেরকে ঋণ দেয়ার জন্য একটা নূন্যতম বরাদ্দ রাখতে হবে। মর্টগেজ রাখার ব্যাংক মানসিকতা কোনো কোনো পর্যায়ের জন্য শিথিল না হলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পরবে। সৎ মানসিকতায় সরকার ঘোষিত প্যাকেজ ব্যাংক মানসিকতার কারণে বাস্তবায়ন হওয়ার সুযোগ নেই। যদিও আয়কর বিভাগে পাশ হওয়া স্থিতিপত্র যাচাই করার কথা বলে এবং ক্রেডিট রেটিং করতে উদারতা পোষণ করে সরকার খুবই যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। একজন ব্যবসায়ী ব্যাংক বহির্ভূত লেনদেন করার পরে ব্যাংকে যা লেনদেন করে তা না করলে কর বিভাগ তাকে ধরবে। এটা তাকে করতেই হবে। ব্যাংকে এই লেনদেনের উপর ভিক্তি করে তার ঋণ প্রাপ্যতা নির্ধারিত হবে। এই ঋণ প্রাপ্যতার ৩০ ভাগ সে ৩ বছরের জন্য ঋণ হিসাবে দিলে আশা করা যায় যে, গ্রাহক টাকা শোধ করতে পারবে। একমাত্র সমস্যা হচ্ছে এখন, মর্টগেজ। সরকারকে তার ঘোষিত নীতি মালার উপর ভিত্তি করে মর্টগেজ বিহীন লোন দিতে হবে। ঋণ শোধ করার নিয়মে ব্যাঘাত ঘটলে ১২ মাস পর্যন্ত সরকারের গ্রাহককে সময় দেয়া উচিত। কারণ ব্যবসার গতি সব সময় এক রকম থাকেনা। সরকার প্রায় ১৬,৫৫০ কোটি টাকা এপ্রিল ও মে ২০২০ এর দুই মাসের সুদ মওকুফ করেছে। পাশাপাশি ৯ মাসের জন্য যে কোন ঋণের শ্রেণীমান নির্ধারণ করতে বলেছে।এটা স্বস্তিদায়ক হবে। তবে এটা ১২ মাসের জন্য করলে আরও স্বস্তিদায়ক হবে। কি কারণে জানি না আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এটা প্রযোজ্য হয় নাই। ভুল করে কিনা কে জানে। এক দেশে দুই নীতি। প্রত্যেক গ্রাহককে অনধিক ১ কোটি টাকা করে সুদ+আসল মওকুফ করলে ১৬,৫৫০ জন গ্রাহক এই টাকা মওকুফ পেতো। বা ৫০ লক্ষ টাকা করে মওকুফ করলে দ্বিগুন প্রান্তিক গ্রাহক সুযোগ পেতো। সরকার দুই মাসের সুদ মওকুফ করেছে। কে কতোটুকু লাভবান হয়েছে বোঝা মুশকিল। কিন্ত ব্যাংকগুলির কর্তারা টিভি ফাটিয়ে ফেলছে। এই বলে যে, ব্যবসায়ীরা আবারও কিছু সুবিধা নিয়ে নিলো। ব্যাংক কর্তাদের কাছে প্রশ্ন, সুবিধাগুলো কার জন্য বা কাদের জন্য হবে ? যারা কর দেয় ও কর্মসংস্থান করে তাদের জন্য ? নাকি যারা সুবিধার মধ্যে বসে আছে তাদের জন্য আরো আরো সুবিধা ? ১ কোটি টাকা তো স্বয়ংক্রিয় ভাবে গাড়ি কেনার জন্য এই কর্তারা পেয়ে থাকেন। সাথে আরো অনেক সুবিধা ওনারা পান। তাতে জনগণ কখনো কোন আপত্তি করে নাই। কর্তারা সমস্বরে বলছে যে, মোট ঋণের পরিমাণ ১২ লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে আসল কতো? সুদ কতো? মোট ঋণ গ্রাহক কতো জন ? কতো জন কতো টাকা খেলাপি ? তার হিসাব আছে। কিন্তু রেখে ঢেকে প্রকাশ করা হয় । ব্যাংক থেকে যাদের অনেক বেশি টাকা নেওয়া আছে, সরকার ঘোষিত এই দুই মাসের সুদ মওকুফ তাদের জন্য কোন প্রণোদনা হবে না। উদ্দেশ্য থাকতে হবে যেন কোন একটা প্রান্তিক গ্রুপ যাদের এই মওকুফ কাজে লাগবে। এই জন্য আমার প্রস্তাবটি হচ্ছে, সবার জন্য সমান মওকুফ (২ মাসের সুদ ঢালাওভাবে মওকুফ দিয়ে নয়) তাহলে কম ঋণ নেয়া প্রান্তিক গ্রুপটি সরাসরি সুবিধা পাবে। সেটা ১ কোটি হতে হবে তা আবশ্যিক নয়। অনধিক ১ কোটি হতে পারে। শেষ কথা হচ্ছে, যে, স্থিতিপত্র ব্যাংক লেন-দেন ও ব্যবসা বা কোম্পানীর বয়সের উপর বন্ধক বিহীন ঋণ অপরিহার্য।
- নুরুল আমিন বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের স্থবিরতায় চরম সঙ্কটে দিন কাটাচ্ছে দেশের অন্যতম সেবা খাত ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং। ২০১৯ সনের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহান শহর থেকেভাইরাসটির সংক্রমনের প্রভাবে পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়া এবং সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ায় অর্থনীতির অন্যতম এই সেবা খাতটির আর্থিক সমস্যা শুরু হয়। পরবর্তীতে ভাইরাসটি বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নেয়ার কারণে বিশ্ব-বাণিজ্যে যে ধ্বস নামে। তার প্রভাবে দেশের আমদানি-রফতানিকারকদের ক্ষয়ক্ষতির সাথে সাথে ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং কোম্পানিগুলো একইভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে। দেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাকের যে পরিমাণ ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে, সে কারণে যে পরিমান আমদানি কমেছে, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডাররা ঠিক সে পরিমান পণ্য পরিবহণের আয় হারিয়েছেন। একইভাবে সবজি, মাছ, কাঁকড়া, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া, চামড়াজাত পণ্য, হস্তশিল্পসহ সকল রপ্তানিতে ভাটা জনিত কারণে ঐ সব পণ্যের হ্যান্ডলিং আয়ও হারিয়েছেন। ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত না হলে এসব পণ্যের প্রায় ৮৫ ভাগ পরিবহণ ও হ্যান্ডলিং ফরওয়ার্ডারদের মাধ্যমে সম্পন্ন হতো ।
অন্যদিকে বিদেশি এজেন্টদের কাছ থেকে পরিবহণের টাকা এবং দেশের রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে প্রিপেইড শিপমেন্টের টাকা না পাওয়ার কারণে অনেক কোম্পানি চরম আর্থিক সংকটে পড়ে। যথাসময়ে এয়ারলাইন ও শিপিং লাইনের পাওনা পরিশোধ এবং কর্মচারীদের বেতনভাতা, ব্যাংক ঋণের সুদ, অফিস ভাড়া ও রক্ষণাবেক্ষন খরচ নির্বাহ করতেনা পেরে সংকটে পড়ে দেশের অর্থনীতির অন্যতম এই সেবা খাতটির সবাই, যারা এখন কমবেশি এই সংকটের সম্মুখীন। ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা ও চলতি মূলধনের অভাবে অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করার কথা ভাবছেন। বিশ্বব্যাপী যাত্রীবাহী বিমান চলাচল সীমিত হওয়া, কার্গো বিমান স্বল্পতার বিপরীতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী পরিবহণের চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং বিশ্বের দীর্ঘায়িত লকডাউনের সুযোগে একচ্ছত্র উৎপাদন সামর্থ্য ও বিশ্ববাজার দখলের প্রতযেগিতায় চীন বেশীর ভাগ কার্গো বিমান অগ্রীম লিজ নিয়ে রাখে। ফলশ্র“তিতে পরিবহণ ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ফরওয়ার্ডারদের এখন অতিরিক্ত চলতি মূলধনের প্রয়োজন। করোনা পূর্ববর্তী সময়ে যেখানে ঢাকা থেকে ইঊরোপে প্রতি কিলোগ্রাম পণ্যের ভাড়া ছিল ১.৬৫ ডলার, তা এখন ৫.৫০ থেকে ৭.০০ ডলার। আর আমেরিকা ও কানাডায় আগের ১২.০০ স্থলে ১৫.০০ ডলার। এমতাবস্থায় কিছু কিছু এয়ারলাইন জিএসএ প্রচলিত পাক্ষিক বাকি প্রদানের নিয়ম লংঘন করে পরিবহণ ভাড়া অগ্রীম নগদ প্রদান ছাড়া অনেক ফরওয়ার্ডারের বুকিং নিচ্ছে না। এ কারণেও পর্যাপ্ত চলতি মূলধন না থাকায় অনেকে ব্যবসা করতে পারছেন না । করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী পাঁচটি প্যাকেজের আওতায় মোট ৭২ হাজার৭৫০ কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, তা নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী । আশা করি এই প্রণোদনা প্যাকেজ সহ সরকারের নেয়া অন্যান্য পদক্ষেপের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যআবার স্বাভাবিক হবে, দেশের রপ্তানি বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়াবে। দেশের রপ্তানি খাতের উন্নয়ন হলে তথা আমদানি-রপ্তানি খাত চাঙ্গা হলে তাদের সেবা প্রদানের জন্য সাপ্লাই চেইন পার্টনার হিসেবে ফরওয়ার্ডারের বিকল্প নেই। বৈদেশিক বাণিজ্য হ্যান্ডলিং করার যদি লজিস্টিকস সক্ষমতাই যদি না থাকে, তাহলে এসব প্রণোদনার কাঙ্খিত ফসল অর্জন সম্ভব হবে না।
তাই, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিংখাতকে বর্তমান ক্ষতি থেকে উত্তরণের জন্য ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে হবে। সেজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকারের কাছে কিছু প্রস্তাব তুলে ধরছি।
১। গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতার জন্য সরকার ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জে যে প্রণোদনা দিয়েছে, একইভাবে ফরওয়ার্ডিং খাতের কর্মচারিদের বেতন-ভাতা ও ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় নির্বাহের জন্য বিনা শর্তে ৬ মাসেরজন্যআর্থিক সহায়তা দেওয়া।
২। চলতি মূলধন সহায়াতার জন্য সেবা খাতে সরকার ঘোষিত ৩০,০০০ কোটি টাকা থেকে ফরওয়ার্ডারদের জন্য একটি ফান্ড নির্দিষ্ট করে দেওয়া। বাংলাদেশফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের তদারকিতে সেই ফান্ড থেকে ঋণের জন্য আবেদনকারী কোম্পানিকে ২০১৯ সালের মোট বার্ষিক ব্যাংক লেনদেনের ৩০শতাংশ পরিমাণ অথর্ ৪শতাংশ সুদে প্রদান করা।
৩। ঋণ প্রাপ্তির প্রতিটি ধাপ সহজ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া। জামানতের পরিবর্তে ব্যবসার বয়স, আকার, পরিচালনা খরচ, সদস্য সনদ ও লাইসেন্সের মূলকপি জামানত, ব্যক্তিগত গ্যারান্টি চেক ও এয়ার লাইন্সে দেয়া গ্যারান্টি ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে ঋণ দেয়া। বিদেশী পার্টনারদের কাছে পাওনা টাকা ও স্থানীয় কাষ্টমার থেকে অনাদায়ী বকেয়াও একটি মাপকাঠি হতে পারে। ৪। যেহেতু কোম্পানিগুলোর লোকসান কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে, সেহেতু উপরোক্ত ঋণ সমুহের কিস্তি পরিশোধ প্রদান ৬ মাস পর থেকে শুরু করা। এই সময়ের মধ্যে ফরওয়ার্ডাররা ব্যবসা গুছিয়ে নিতে পারবে বলে বিশ্বাস করি। এই সময়ে ঋণ গ্রহনকারী কোম্পানি শুধু ঋণের সুদ প্রদান করবে, কিস্তি নয় । ৫। চলমানঋণের সুদ মওকুপ করা।
৬। এআইটি নেয়া বন্ধ করা ও কর্পোরেটকরের হার কমানো ।
ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিংখাতকে বর্তমান প্রতিকুল আবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এবং লজিস্টিকস খাতে সক্ষমতা রক্ষার জন্য উপরোক্ত সুপারিশ সমুহ বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে গুরুত্ব বিবেচনা করে এব্যাপারে প্রয়োজনীয় জরুরি নির্দেশনা প্রদানের প্রত্যাশা করছি।
নজরুল ইসলাম তোফা: বাংলা ভাষা বাংলাদেশের মানুষের মাতৃভাষা। এই মায়ের ভাষাকে রক্ষা করতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে বাঙালি জাতি। তাইতো ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির চেতনার দিন, নবজাগরণের দিন। কবিরাও বলেছে, মায়ের ভাষা, সেরা ভাষা খোদার সেরা দান। মাতৃভাষা বা ভাষা হলো সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের বাহন। শিল্পকর্ম ও অগ্রগতির ধারক। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় ও ঐতিহ্যবাহী দিন। বাঙালির জাতীয় জীবনের সকল চেতনার উৎস হচ্ছে এ দিনটি। বাংলা ভাষাকেই রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার ঐতিহাসিক দিন এটি। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি। এমন গান শুনলেই মনে হয় আমরা ১৯৫২ সালের সেই দিনটিতে ফিরে যাই। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত এমন গান চির অম্লান হয়ে রবে। প্রত্যেক জাতির জীবনে বিরল কিছু স্মরণীয় দিন থাকে, ইংরেজিতে যাকে বলে- রেড লেটার ডে। সুতরাং একুশের ফেব্রুয়ারি দিনটা অনন্য স্বতন্ত্রতায় ইতিহাসের পাতায় পাতায় কালজয়ী সাক্ষী হয়েই থাকবে। এই দেশের সকল চিত্রশিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সুরকার এবং গীতিকাররা একুশকে ধারণ করেছিল তাদের লেখায়, সুরে, কণ্ঠে আর শিল্পীর তুলিতে। আর সেসব গান, কবিতা বা শিল্পকর্ম আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়। একুশকে সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলতে পথ দেখায়। ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির সময় একজন ভাষা সৈনিক:- মাহবুব উল আলম চৌধুরী একুশের কবিতা লিখে খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বলা যায় তিনিই অমর একুশের প্রথম কবিতার জনক। এই দিবসের তাৎপর্য উল্লেখ করে বিশিষ্ট ভাষা বিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদ বলে ছিল, আমি মুগ্ধ আমি প্রীত, আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, আমার প্রাণের কথা আমার ভাষায় জানাতে পারব বলে আমার হৃদয় স্পন্দন বেড়েছে। সত্যিই গর্বিত আমি। তাই তো ভাষা আন্দোলন জাতি গোষ্ঠীর সর্ব বৃৃৃহৎ চেতনার ইতিহাস। ভাষার অধিকার আদায়ের সেই রাজপথ রঞ্জিত করা ইতিহাস। এখন বাংলাদের বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক ভাবেই স্বীকৃত। একুশ এখন সমগ্র বিশ্বের। কিন্তু কেমন ছিল একুশের প্রথম প্রহর বা একুশের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের প্রথম সেই বারুদের সংযোজন। আর তখনকার সেই বিদ্রোহের অনুষঙ্গটাই বা কি ছিল? তা ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনার চেষ্টা করা মাত্র। সেই দিনের প্রথম কিছু বা প্রথম সৃষ্টি কিংবা তার অবদানকে নিয়েই লেখা। আজকের তরুণ প্রজন্ম আগামী দিনের স্বপ্ন দেখতে পারে এই লেখাটি বিশ্লেষণ করে। আসলেই এ আলোচনায় অনেক দিকই চলে আসেতে পারে, সব কিছু তো তুলে ধরা সম্ভব হবে না। তবুও মৌলিক কিছু কথা না বললেই নয়। এই ভাষার সঙ্গেই যেন সংশ্লিষ্ট জীবনবোধ, সাহিত্য-সংস্কৃতি স্বাতন্ত্র্য, জাতির আধ্মাতিক সত্তা সংরক্ষণের সংগ্রামের মূর্ত রূপ ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের জনগণের কাছে তাই এমন দিনের গুরুত্বটা অবশ্যই হৃদয়গ্রাহী। প্রথমে এই ভাষার জন্যে এদেশের ছাত্ররাই যেন আন্দোলন চালিয়ে নিলেও পরবর্তীতে গোটা দেশবাসী ছাত্রদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে ছিল। ফলে সেই সময়র ছাত্রদের মনোবল অনেক বেড়ে যায় এবং তারা সামনের দিকে দৃঢ় মনোবলে এগোতে শুরু করে। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে সেই ছাত্রসমাজ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মিছিলও করে ছিল। পুলিশ মিছিলের উপর গুলী চালায়। এতে অনেকে নিহত হয়েছিল, আজ তাদেরকেই শহীদ বলা হয়। এ হত্যাযজ্ঞের জন্য ছাত্র সমাজসহ সকল শ্রেণীর মানুষেরা ভাষার আন্দোলনকে আরো বেগবান করে। ভাষার জন্যেই যেন আন্দোলনের প্রথম লিফলেট প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি বর্ষণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। লিফলেটটির আকার ছিল প্লেট অনুযায়ী ১/১৬। গুলি বর্ষণের অল্প কিছুক্ষণ পর পরই হাসান হাফিজুর রহমান, আমীর আলী সহ অনেকেই যেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের উল্টোদিকে ক্যাপিটাল প্রেসে চলে যান। সেখানে গিয়ে হাসান হাফিজুর রহমান লিফলেটের খসড়া তৈরি করেন। দুই তিন ঘণ্টার মধ্যেই মন্ত্রী মফিজউদ্দীনের আদেশে গুলি শীর্ষক লিফলেটটি ছাপার কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। হাসান হাফিজুর রহমান লিফলেটটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসেন। প্রায় দুই/তিন হাজার লিফলেট ছাপানো হয়েছিল। উৎসাহী ছাত্ররাই এমন লিফলেটগুলো চারদিকে ছড়িয়ে দিয়ে ছিল। বলা যায় যে, চকবাজার, নাজিরা বাজার এবং ঢাকার অন্য সব এলাকাতেও লিফলেটগুলো কর্মীদের মাধ্যমে ঐদিনই ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এই স্মৃতি মতো অনেক স্মৃতিই যেন আমাদের ভাষা আন্দোলনকে অমর ও অক্ষয় করে রেখেছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত হত্যাকান্ডের খবর সারা দেশেই পৌঁছে যায়। অতঃপর পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর ইউনেস্কো এর সাধারণ পরিষদের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতভাবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতির মাঝে যে চেতনার উন্মেষ হয়, তার চরম বিস্ফোরণ ঘটে ছিল ঊনসত্তর থেকেই একাত্তরে।বাংলাদেশের সমস্ত আন্দোলনের মূল চেতনা একুশে ফেব্রুয়ারি। তখন থেকেই বাঙালি উপলব্ধি করেছিল তার বাঙালি জাতীয়তাবোধ, তার সংস্কৃতির অতন্দ্র প্রহরী। এমন এই সংগ্রামী চেতনাই বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক আন্দোলন এই দুধারাকে একসূত্রে গ্রথিত করে মুক্তি সংগ্রামের মোহনায় এনে দিয়েছে। আর এই পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির জীবনে একটি গুরুত্ব পূর্ণ দিন। একুশের চেতনাই যেন বাঙালি জাতিকে দিয়েছে অন্যায় ও অবিচার, অত্যাচার এবং শোষণের বিরুদ্ধেই আপোষহীন সংগ্রামের প্রেরণা।একুশের প্রথম নাটক কবর, তা মুনীর চৌধুরী রচনা করেছিল। এমন এই ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার অপরাধেই যেন ৫২ সালে জেলে আটক ছিলেন মুনীর চৌধুরী সহ রণেশ দাশগুপ্ত। তাদের পাশাাপাশি অনেক লেখক বা সাংবাদিকরাও জেলে আটক হয়ে লাঞ্ছিত হয়েছিল। রণেশ দাশ গুপ্ত জেলের এক সেলে আটক, আর অন্য একটি সেলেই মুনীর চৌধুরীকে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি নাটক লিখে দেওয়ার অনুরোধ করে চিরকুট পাঠান। সে চিরকুটের লেখাটি ছিল- শহীদ দিবসে রাজবন্দিরাই নাটকটি মঞ্চায়ন করবেন, জেলে মঞ্চসজ্জা ও আলোর ব্যবস্থা করা যাবে না। এমন কথাগুলো কৌশলে মুনীর চৌধুরীকে বলা হয়, নাটকটি এমনভাবে লিখতে হবে, যাতে খুব সহজে কারাগারেই এটি অভিনয় করা যায়। মুনীর চৌধুরী ৫৩ সালের ১৭ জানুয়ারি নাটকটি লিখে শেষ করেন। ওই বছরের একুশে ফেব্রুয়ারি, রাত- ১০টায় কারাকক্ষগুলোর বাতি নিভিয়ে দেওয়ার পর শুধুমাত্র হ্যারিকেনের আলো-আঁধারিতেই কবর নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। অভিনয়ে অংশ নেন বন্দি নলিনী দাস, অজয় রায় প্রমুখ। ভাষার আন্দোলনটি জাতীয়তাবাদেরই প্রথম উন্মেষ।
আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল ছিল বাঙালি জাতির আপন সত্তার উপলব্ধি এবং ঐক্যবদ্ধ হওবার প্রেরণা। এমন আন্দোলন বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার আন্দোলনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। এমন আন্দোলনে প্রথম ছাপচিত্র অঙ্কন করেছিলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী, বায়ান্নর ভাষাকর্মী- মুর্তজা বশীর। ছাপচিত্রটির শিরোনাম হলো রক্তাক্ত একুশে। মুর্তজা বশীর ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ছাত্রহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীও ছিলেন। শহীদ বরকতের রক্তে তার সাদা রুমাল রঞ্জিত হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আঁকা তাঁর এমন ছাপচিত্রটিতে তিনি একুশের ঘটনা অঙ্কিত করেছিল। একজন গুলিবিদ্ধ ছাত্রনেতাকে একেঁছেন সেখানেই ফুটে উঠে- মিছিলে গুলি বর্ষণের ফলে পড়ে যান, তার স্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ডটি পড়ে যায় এবং তার হাতে থাকা বইটিও মাটিতে পড়ে রক্তাক্ত হয়ে যায়। অমর একুশে আজও বাংলাদেশে শহীদ স্মরণে গ্রন্থমেলার আয়োজন করেই যেন মাতৃভাষার জন্যে বিভিন্ন শহীদ ও বুদ্ধিজীবীদেরকে স্মরণ করা হয়। অমর একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য বিশ্লেষণে শুধু শহীদ দিবস কিংবা গ্রন্থমেলা পালনেই সরকার সীমাবদ্ধ থাকেনি, তাকে এই বাঙালির জাতীয় জীবনের সর্বত্র প্রভাব বিস্তারেও আগ্রহী ভূমিকা পালন করছে। একুশে ফেব্রুয়ারির পূর্ণ ইতিহাস কিন্তু সাধারণ ছাত্র-জনতার ইতিহাস। এমন এ ইতিহাসের নায়ক অথবা মহানায়ক তারাই। কোনো দল অথবা দলীয় নেতার নেতৃত্বে এর জন্ম হয়নি। এই দেশের চিন্তাবিদ-বুদ্ধিজীবীরা তাদের যুক্তিবাদী সৃজনশীল লেখনীর দ্বারা সমাজজীবনে এর ক্ষেত্র রচনা করেছিল। দেশের স্বাধীনচেতা মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণরা সেই উর্বর ক্ষেত্রেই রক্তবীজ বপন করেছিল। ফলেই আজকের এই সোনালি ফসল। এই তরুণদের সংগ্রামী চেতনা সমগ্র সমাজে ছড়িয়ে পড়ে এবং গড়ে তোলে এক অজেয় শক্তি। তাই তো পরবর্তী সময়েই রাজনীতিতে প্রদান করে নতুন দ্যোতনা। সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই যেন সৃষ্টি হয় এক নতুন শক্তি। সৃষ্টি হয় নতুন ইতিহাস। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি ওই সব শহীদ এবং বীর যোদ্ধাদের রক্ত, অশ্রু ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারির মতো এই স্মরণীয় দিবসটি লাভ করতে পেরেছি। এমন দিনের সৃষ্টিতে তরুণরা রক্তাক্ত অবদান রাখলেও এখন তা বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলে শাসক চক্র বাঙালী জাতিকে দুর্বল করতেই বাংলার মাতৃভাষা বা মায়ের ভাষার উপর চক্রান্ত শুরু করে। এর প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের শুরুতে মায়ের ভাষা রক্ষার আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। আন্দোলন ঠেকানোর জন্য সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই প্রাণের দাবীতে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র যুব সমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে মিছিল করে। এ মিছিলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ নাম না জানা অনেকেই যেন সেই দিন শহিদ হয়েছিল। আর বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত হওয়া মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে দেশবাসী প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। উপায় না দেখে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতেই বাধ্য হয়ে ছিল। একটু ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে পরিস্কার ভাবে জানা যাবে, তা হলো পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় এর তৎকালীন উপাচার্য- ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিল। আর পূর্ববঙ্গ থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। এইভাবেই যেন ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চক্রান্ত চলতে থাকে। ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেছিল উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর ফলেই তুমুল প্রতিবাদের ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছিল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণার পর পরই এদেশের ভাষা আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই বাঙালিদের মাতৃভাষার উপর চরম আঘাত হানে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই যেন রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন শুরু হলেও ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নেই বাঙালি জাতি আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়। কেউ কবিতা লিখে, কেউ গান বা নাটক লিখে, কেউ বা চলচ্চিত্র কিংবা চিত্রাঙ্কন করে। ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বটা যে, এ সবের মাধ্যমেই এ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামী শিক্ষা নিয়ে থাকে। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই যেন জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শাসকচক্রের প্রতিটি ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়ে ছিল। জানা প্রয়োজন তা হলো, একুশে ফেব্রুয়ারির পরের দিন অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় একুশের প্রথম ক্রোড়পত্র এবং প্রথম অঙ্কিত চিত্র। ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে ছিল তৎকালীন দিলরুবা পত্রিকার প্রকাশক এবং এতে স্কেচ আঁকেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম আর লেখেন ফয়েজ আহমদ এবং আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন। সেই গুলোকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে কাগজে ছাপা হয়ে যায় এবং পত্রিকার কর্মীরাই রাজপথে কাগজ গুলো বিলি করে ছিল। সেই দিন সন্ধ্যা ৬ টা থেকে কারফিউ ছিল বলে ৬ টার আগেই হাতে হাতে কাগজ বিলি করা হয়ে যায়। তাইতো ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে প্রেরণা দিয়েছিল একুশ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের রক্ত রাঙ্গা ইতিহাস। বলা যায় যে, সর্ববস্তরে মানুষ ও ছাত্র সমাজের তীক্ষ্ম মেধা দ্বারাই মাতৃভাষার জন্যে সংগ্রাম করেছিল। তাই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গৃহীত হওয়ার ব্যাপারটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। এখন আমাদের কর্তব্য বাংলা ভাষা চর্চার মাধ্যমে উন্নত জাতি হিসেবে নিজেকে দাঁড় করানো। ভাষার জন্য জীবন দান এ বিরল আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কো ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সম্পূর্ণ ভাবে ঘোষণা করে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় এ দিনটিকে প্রতি বছর পালন করে আসছে। জাতিসংঘে এর আগেও ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতি সংঘের সংস্থা ইউনেস্কো আনুষ্ঠানিক ভাবেই এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের ৩০ তম অধিবেশনে এক পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবটির খসড়াও পেশ করেছিল। বাংলাদেশকে সমর্থন জানায় ২৭টি দেশ। দেশ গুলো হলো:- সৌদি আরব, ওমান, বেনিন, শ্রীলঙ্কা, মিশর, রাশিয়া, বাহামা, ডেমিনিকান প্রজাতন্ত্র, বেলারুশ, ফিলিপাইন, কোতে দি আইভরি, ভারত, হুন্ডুরাস, গাম্বিয়া, মাইক্রোনেশিয় ফেডারেশন, ভানুয়াতু, ইন্দোনেশিয়া,
এক ব্যক্তি আর এক দল এই নীতেতে বেপরোয়া হয়ে উঠছে আওয়ামী লীগ। ফলে রাষ্ট্রের মেশিনারিজ ভুয়া ভোটের সরকারের অনুকুলে এখন বিভৎস চেহারায় জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ‘এক ব্যক্তি, এক দল’ নীতির বেপরোয়া আস্ফালন জনগণকে আতঙ্কিত করে রেখেছে। জনগণকে পরাধীন করে এখন আওয়ামী লীগ উপনিবেশ কায়েম করেছে। দেশে এখন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে, মানুষ নিজের ছায়া দেখলেই চমকে উঠে।
তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রতিবেদন বিএনপির আমলে ঠিক ছিল। কিন্তু এখনকারটি মনগড়া। তথ্যমন্ত্রী তার তথ্যযন্ত্রের মাধ্যমে এমন তথ্য দেন, যাতে শুধু দেশবাসীই নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও সবিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ে। টিআইয়ের প্রতিবেদনে স্বীকার করে নিলে তো তথ্যমন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব থাকে না। এ জন্য টিআইয়ের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে তাকে অপতথ্য দিতে হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতির মাত্রা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত বলে সব তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে না। কেবল টিআই নয়, ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) গত সোমবার অর্থ পাচারের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে এক বছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন যে, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মতোই উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে সাহায্য করে তিনি বড় ধরনের অপরাধ করার পরও তার ওই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক কালের সেরা রসিকতা করলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কতিপয় কমিশনার নিজেদের জীবন গড়ে তুলেছেন ভোটারবিহীনভাবে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করার জন্য। তারা মূলত আওয়ামী লীগের ইচ্ছায় নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। মন্ত্রিসভা ও সংসদ বহাল রেখে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে বলে তারা দাবি করেছেন। অথচ এটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দূরে থাক, বরং এটি খানাখন্দে ভরা মাঠ, সেই বিষয়টি দেখেও নির্বাচন কমিশন তা উপেক্ষা করেছে। তারা ন্যূনতম সুষ্ঠু একটি নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে উঠতে দিলেন না আওয়ামী সরকারের মোসাহেবী করতে গিয়ে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যে এটি সুস্পষ্ট হলো- এই কমিশনের তদারকিতে উপজেলা নির্বাচনগুলোও ভুয়া ভোটের নির্বাচনেরই মহৌৎসবে পরিণত হবে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রক্ত ঝরেছে ধানের শীষের প্রার্থী ও সমর্থকদের। সুতরাং নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে চেয়েছে কিন্তু সুষ্ঠু করতে নয়। ভোট ডাকাতির সাক্ষ্যপ্রমাণ তারা নিজেরাই রেখে দিয়েছে। এসব মন্তব্য বিভিন্নজন বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ সহ প্রকাশ করলেও সরকারের এতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে এই একনায়ক তান্ত্রিক আস্ফালন দেশকে চুড়ান্ত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।
লেখক: মোঃ আওলাদ হোসেন রাকিব; উন্নয়নকর্মী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ই-মেইল: aowladyouth@gmail.com
ক্ষমতাসীন সরকার যখনই কিছু করে, তার একটি কেতাবি ভাষা থাকে। জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় চমক থাকে। তার সাথে সাথে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করে। রাজনীতিকেরা যেমন বলে থাকেন- ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। তার উল্টোটি আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন দলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তারা মনে করেন- রাষ্ট্রের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ বা ব্যক্তিক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ। আর গণতন্ত্র সম্পর্কে আব্রাহাম লিঙ্কনের সেই বহুল উচ্চারিত প্রবাদটি এভাবে বলা যায়- ‘ডেমোক্র্যাসি অব দ্য পার্টি, বাই দ্য পার্টি অ্যান্ড ফর দ্য পার্টি।’ ইতোমধ্যে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা যদি সত্যি হয়, তবে তার সর্বশেষ নমুনা হলো মাদক দমনের নামে দেশব্যাপী তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধের’ বেপরোয়া পাঁয়তারা। এটা যে জনগণকে প্রতারিত করার একটি কৌশল, তা বোঝা যায় মাদকবিরোধী অভিযানের লক্ষ্য ও প্রক্রিয়া দেখে। গাছের গোড়া উপড়ে না ফেলে দৃশ্যমান শাখা-প্রশাখা কেটে নেয়া যেমন নিরর্থক, তেমনি মাদক সেবনকারীদের ধরে ধরে নিধন করাও অর্থহীন। চলমান অভিযানে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গত ১০ দিনে মাদক কারবারিদের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৪১ জন নিহত হয়েছে। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ মাসের ১৫ তারিখে দুইজন, ১৭ তারিখে তিনজন, ১৮ তে একজন, ১৯ শে তিনজন, ২০ শে চারজন, ২১-এ ৯ জন, ২২ শে ১২ জন ও ২৩ শে সাতজন নিহত হয়েছে। এ কলামে একবার শিরোনাম ছিল ‘বন্দুকযুদ্ধ : যে গল্পের শেষ নেই’, সেই একই গল্প প্রতিদিন নানা রঙে, নানা ঢঙে বয়ান করা হচ্ছে। ২৩ তারিখ রাতের ‘বন্দুকযুদ্ধ’কে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য বলা হয়েছে, এ ঘটনায় কিছু পুলিশও আহত হয়েছে। মিথ্যাকে সত্য করার জন্য যদি ১০০ মিথ্যা কথা বলা হয়, তাহলে মিথ্যাটি সত্য হয়ে যায় না। চলমান অভিযানবিরোধী একটি জাতীয় ঐকমত্য ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। ডান-বাম, পূর্ব-পশ্চিমের সব মত ও পথের ধারকেরা একবাক্যে এর প্রতিবাদ করছে। কিন্তু সরকার অন্যসব বিষয়ের মতো এ ব্যাপারেও অনড়। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, আরো ৫০০ জনের নাম রয়েছে হিট লিস্টে। সেই সাথে ঈদের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘মাদকবাণিজ্য’-এর অভিযোগ বেশ জোরেশোরেই গণমাধ্যমে উত্থাপন হয়েছে। এরা বিরোধী দল ও স্থানীয় অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের হুমকি-ধমকি দিয়ে বেপরোয়া চাঁদাবাজি করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ। তাই বলা দরকার, মাদক দমন অভিযান যেন প্রতিপক্ষ দমন অভিযানে পরিণত না হয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “বিএনপি মাদকবিরোধী অভিযান চায়; কিন্তু সেটি অরাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হতে হবে। তাই ক্রসফায়ার নয়, আইনের আওতায় এনে তাদের বিচার করতে হবে। ২৩ মে ঠাকুরগাঁওয়ে নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে তিনি এ কথা বলেন। এর আগে তিনি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তাদের নেতাকর্মী হত্যার অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা খন্দকার মোশাররফ হেসেন অভিযোগ করেছেন, ‘আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসায়ী, এমনকি উপজেলা পর্যায়ের নেতারাও এই ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।” অপর দিকে ‘বন্দুকযুদ্ধ’সহ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে মাদকের ভয়াবহতা নিরসনে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি- সিপিবি। দলটি বলেছে, যারা বিদেশ থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে মাদক এনে বিস্তৃত চক্রের মাধ্যমে গ্রামপর্যায়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে, সেই উৎসমূল বন্ধ না করে, তাদের বিচারের আওতায় না এনে কিছু চুনোপুঁটি মাদকবিক্রেতাকে হত্যা করে এই মারাত্মক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। বিবৃতিতে মাদক দমন অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করা হয়। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, সমস্যা সমাধানের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। সিপিবি পরোক্ষভাবে এক দিক নির্দেশ করলেও জাতীয় পার্টি প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অনেকটা প্রত্যক্ষভাবেই বলেছেন : ‘মাদক সম্রাট সংসদেই আছে, তাদের ফাঁসিতে ঝুলান।’ সিভিল সোসাইটিতে এ ধরনের নির্বিচার হত্যায় তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘মানুষের জীবন কেড়ে নেয়ার অধিকার কারো নেই।’ সরকারি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এ হত্যাকাণ্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘মাদকবিরোধী অভিযানের সময় মানবাধিকারের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাথায় রাখতে হবে।’ কমিশন বলেছে, ‘বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ড তারা সমর্থন করে না।’ মাদক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘বন্দুকযুদ্ধে’র মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে মাদকের ব্যবহার নির্মূল করা সম্ভব নয়। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনুরূপ মত পোষণ করেন, তবুও কার্যক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি এর ব্যতিক্রম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার ও কারাদণ্ড দিচ্ছে; কিন্তু অভিযানদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা মাদক ব্যবহারকারী ও বিক্রয়কারী সাধারণ মানুষকে হত্যা করাই আসল কাজ মনে করছে। সাধারণভাবে বোঝা যায়, মাদকদ্রব্যের তিনটি স্তর রয়েছে। প্রথমত উৎপাদন, দ্বিতীয়ত সরবরাহ এবং তৃতীয়ত মাদক ব্যবহারকারী। মাদক উৎপাদন বাংলাদেশে হচ্ছে না। প্রতিবেশী মিয়ানমার এর মূল উৎস। ভারত থেকে ইয়াবা না হলেও মদ-ফেনসিডিল ব্যাপক হারে আসছে। তাহলে বোঝা যায়, সরকারের খোলা সীমান্ত নীতি মাদক উৎপাদনে সহায়তা দিচ্ছে। আকস্মিকভাবে দেশের অভ্যন্তরে মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালিত হলেও সীমান্তে কঠোরতম ব্যবস্থার কথা জান যায়নি। যদিও মাঝে মধ্যে ছিটেফোঁটা অভিযানের খবর প্রকাশ হয়েছে। এবার আসা যাক সরবরাহকারী, যারা ইয়াবা ও অন্যান্য নেশাদ্রব্য সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। এরা নানাভাবে কারবার করছে। প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বলছে, বেশির ভাগ সরবরাহকারী বা কারবারী ক্ষমতাসীন দলের লোক। ক্ষমতাসীনদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কারবার পরিচালিত হচ্ছে। সম্প্রতি যেসব লোক ধরা পড়েছে, এদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। কারো নাম উল্লেখ না করেই বলা যায়, আপনার এলাকায় কারা এর সাথে জড়িত। এ কথার অর্থ এই নয় যে, আওয়ামী লীগ দল হিসেবে নেশাকে অনুমোদন করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচার অনুযায়ী, অপরাধীরা ক্ষমতাসীন দলে নাম লেখায় এবং তাদের সহায়তা পায়। অপরাধী যদি ক্ষমতাসীন দলের লোক হয়, তাহলে তার সাত খুন মাফ। বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি তারা চালু করেছে, মাদক কারবারিরা তার ষোলআনা সুযোগ নিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে দক্ষিণের মাদক সম্রাট বদি মিয়ার নাম এসেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বদির বিরুদ্ধে তথ্য আছে; প্রমাণ নেই। এ কথার অর্থ কি এই সরকার তার বিরুদ্ধে প্রমাণ দিতে অক্ষম? অথচ অসংখ্য ক্ষেত্রে তারা প্রমাণ ছাড়াই মামলা এমনকি হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। এমন লোকদের ক্রসফায়ারে দিচ্ছে, যারা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতসীন দলের বিরোধী। ‘বন্দুকযুদ্ধের’ মুখোমুখি যুবকের পিতা-মাতা তার সন্তানকে নিরপরাধ দাবি করেছেন, এমনকি মামলা করেছেন- এ রকম উদাহরণ বিরল নয়। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে খবর এসেছে, ৪৫ মাদক গডফাদার ঢাকায়। এর মধ্যে পৃষ্ঠপোষক পাঁচ আওয়ামী লীগ নেতা ও তিন পুলিশ কর্মকর্তা। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- এ রকম খবর জনগণ এখনো পায়নি।
অস্বীকার করার উপায় নেই- সরকার যখনই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড অতীতে পরিচালনা করেছে, বিরোধী দলের ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এর কবলে পড়েছে। জঙ্গিবিরোধী অভিযান, সন্ত্রাস দমন ও মানবতাবিরোধী অপরাধ- সব ক্ষেত্রেই স্থানীয় উল্লেখযোগ্য নেতাকর্মীরা পুলিশের অন্যায় সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হয়েছে। কী মনে করে রমজান মাসেই এ অভিযানগুলো বেশি পরিচালিত হয়। এ সময় ভালো মানুষ নিশ্চিন্তে ঘরে ফেরে আর এ সুযোগটি হেলায় হারাতে চায় না সরকার। মানুষ মারার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের জুড়ি নেই। স্বাধীনতার প্রাথমিক সময়ে জাসদ অভিযোগ করেছিল, তাদের ৪০ হাজার নেতাকর্মী হত্যা করেছে রক্ষীবাহিনী। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত যারা এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, তাদের গরিষ্ঠ অংশই আওয়ামী জামানায়। বিশেষ করে এ সময়ে যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে, স্বাধীনতার বিগত সময়ে একত্র করলেও তত হত্যাকাণ্ড ঘটেনি। অপরাধ যত বড়ই হোক না কেন, তাকে এভাবে হত্যা করা যায় না। কোনো সভ্য সমাজের আইনকানুন তা অনুমোদন করে না। বর্তমানে মাদকপ্রবণ ও মাদক প্রবেশদদ্বার বাদ রেখে যে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে, তা আইনের চোখে অচল হতে বাধ্য। সমাজতত্ত্ব বলে, এ ধরনের ব্যবস্থায় প্রতিশোধের হিংসা প্রজ্বলিত হয়। সন্ত্রাস উৎসাহিত হয়। সুতরাং এই অন্যায় ‘বন্দুকযুদ্ধ’ অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে। এর স্থায়ী সমাধানের জন্য- ১. রাষ্ট্রকে নৈতিক হতে হবে, ২. শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে, ৩. মাদক বেচাকেনার পরিবেশের পরিসমাপ্তি ঘটাতে হবে, ৪. উৎসমূল : উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধ করতে হবে, ৫. বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান হতে হবে। আশু ব্যবস্থা হিসেবে পুলিশি জরিপ নয়, নিরপেক্ষ গবেষণা সংস্থার মাধ্যমে নেশার কারণ, ব্যাপ্তি ও গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করতে হবে। গণমাধ্যম ও শিক্ষক-অভিভাবককে কাজে লাগাতে হবে। রাজনীতি নয়, সমাজকে জাগ্রত করার মধ্যে এর সমাধান খুঁজতে হবে।
বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা অধ্যাপক ক’দিন আগে ঢাকার প্রেস ক্লাবের এক সভায় বলেছেন, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি ফারাক্কা ব্যারাজ তৈরি হলে বাংলাদেশ পানির অভাবে পড়বে বলে উপলব্ধি করেছিলেন। তার বক্তব্য মনে হয় ঠিক ঐতিহাসিক নয়। কেননা, ভারত ফারাক্কা ব্যারাজ তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ১৯৫৪ সালে। এ সময় সাবেক পাকিস্তান সরকার ফারাক্কা ব্যারাজ তৈরির বিপক্ষে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। অন্য দিকে ভাসানী কেবলই করে চলেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা। তিনি এ সময় ছিলেন একজন কড়া বিপ্লবী। তিনি ফারাক্কা ব্যারাজ নিয়ে এ সময় কোনো কথাই বলেননি। অনেক পরে তিনি করেছিলেন ফারাক্কা মিছিল। আর এই মিছিল করতে পেরেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিশেষ সহযোগিতায়। এটা তার একক প্রচেষ্টার ফল ছিল না। কিন্তু এখন কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবী বলতে চাচ্ছেন, এই মিছিল ছিল কেবলই ভাসানীর একক উদ্যোগের ফল।
অনেকেই জানেন না যে, ভাসানীর মিছিলের একদিন আগে তিনি রাজশাহীতে ঘরোয়া সভায় প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, তড়িঘড়ি করে সাবেক পাকিস্তান ভেঙে দেয়া ভুল হয়েছে। ভেঙে দেয়া না হলে গঙ্গার পানি পাওয়া অনেক সহজসাধ্য হতো। কেননা ভারতের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হতো পূব ও পশ্চিম থেকে, যা এখন আর সম্ভব নয়। ভাসানীর রাজনৈতিক চেতনার ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন আসা অনেককে বিস্মিত করেছিল। কারণ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় ভাসানী বলেছিলেন, তিনি ভোটে বিশ্বাস করেন না। তিনি চান ভোটের আগে ভাত। কিন্তু সেই তিনি, আবার ভোট হবার পরে বলেছিলেন, ভোট আসলে হয়েছে গণভোট। পশ্চিম পাকিস্তানকে জানাতে হবে ‘স্লামালেকুম’। ভাসানীকে সবাই জানত চীনপন্থী কমিউনিস্টদের পক্ষে। কিন্তু তিনি একাত্তরে যান ভারতে। কলকাতায় বন্দী হয়ে থাকেন ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে। ভাসানীর রাজনীতি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল খুবই কঠিন। এই ভাসানী দেশে ফিরে হয়ে ওঠেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের একজন সহযোগী। আর তার নির্দেশেই তিনি দেন ফারাক্কা মিছিলের নেতৃত্ব। এই হলো বিখ্যাত ফারাক্কা মিছিলের পটভূমি। আমি তাই ব্যক্তিগতভাবে খ্যাতনামা অধ্যাপকের বচনের সাথে ঐকমত্য পোষণ করতে পারছি না। সে সময় থেকে এখন নদীর পানির সমস্যা হয়ে উঠেছে আরো অনেক জটিল।
আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি পানি আসে গঙ্গা নদী দিয়ে নয়, ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে। ব্রহ্মপুত্র নদের দৈর্ঘ্য ২৬৭০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তিস্থল হল চীনে তিব্বতের মানস সরোবর থেকে। যেসব নদীর উদ্ভব হ্রদ থেকে হয়, তাদের আমরা বাংলায় নদী না বলে উল্লেখ করি নদ বলে। যেমন সিন্ধু নদ, ব্রহ্মপুত্র নদ, নীলনদ। গঙ্গা নদী কোনো হ্রদ থেকে হয়নি। এর উদ্ভব হয়েছে হিমালয়ের তুষার নদী গঙ্গোত্রী থেকে। ব্রহ্মপুত্র নদকে তিব্বতে বলা হয়, সাং-পো (ঞংধহম-চড়)। ব্রহ্মপুত্র নদের ১৪৪৩ কিলোমিটার পড়েছে তিব্বতের মধ্যে। একে তাই প্রায় বলা চলে তিব্বতের নদী। চীন সরকার চাচ্ছে এই নদীর ওপর ব্যারাজ নির্মাণ করে তিব্বতে পানি সেচব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষি উন্নয়ন। চীন এটা করলে বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে পানি আসা অনেক কমে যাবে। আগে ছিল কেবল গঙ্গার পানির সমস্যা। কিন্তু এখন আমাদের ভাবতে হবে ব্রহ্মপুত্রের পানি সমস্যা নিয়েও। চীনের সঙ্গে আমাদের হওয়া উচিত পানি সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষ চুক্তি। না হলে আমাদের পানি-সমস্যা নিকট ভবিষ্যতে হয়ে উঠবে খুবই জটিল।
ভারত ফারাক্কা ব্যারাজ করেছিল তিন কারণে। কলকাতা বন্দরে নাব্যতা রক্ষা; ফারাক্কা ব্যারাজের ওপর দিয়ে রেলপথ ও সড়কপথ নির্মাণ করে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশের যোগাযোগ স্থাপন এবং ফারাক্কা ব্যারাজের মাধ্যমে গঙ্গার পানি আটকিয়ে যুদ্ধের সময় সাবেক পাকিস্তানকে যুদ্ধে কাবু করা। চীন সাং-পো নদীর ওপর যে ব্যারাজ তৈরি করছে, তার লক্ষ্য কৃষি-উন্নয়ন। তাই ফারাক্কা ব্যারাজ আর সাং-পো ব্যারাজ উদ্দেশ্যের দিক থেকে তুলনীয় নয়। ভারতের সাথে আমাদের যেরকম ঐতিহাসিক বিরোধ আছে, চীনের সাথে তা নেই। তাই চীনের সাথে একটা পানি চুক্তি অনেক সহজেই হতে পারে। অবশ্য চীনের সাথে ভারতের আছে চরম বিরোধ। ব্রহ্মপুত্র নদ তিব্বত থেকে সরাসরি বাংলাদেশে বয়ে আসছে না, বয়ে আসছে ভারতের মধ্য দিয়ে। তাই এই নদীর পানি বিরোধ নিষ্পন্ন হলে লাগবে তিনটি দেশের সম্মতি। এই সম্মতির ব্যাপারটা নিতে পারে জটিল রূপ। ফারাক্কা ব্যারাজ যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল, তাতে তার কার্যকারিতা আর থাকছে বলে আমার মনে হয় না। কেননা, গঙ্গা নদী এখন মুর্শিদাবাদের দিকে না ভেঙে, ভাঙছে উত্তরে মালদহের দিকে। অর্থাৎ গঙ্গা নদীর নতুন খাত সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। গঙ্গা নদীর প্রবাহ বিশেষভাবেই বদলে যেতে চলেছে।
ভারতে যা গঙ্গা নদী, বাংলাদেশে তার নাম হয়েছে পদ্মা। গঙ্গা নদী ফারাক্কা ব্যারাজের উত্তরভাগ ঘুরে এসে যুক্ত হতে চাচ্ছে পদ্মা নদীর সাথে। নদীর ঢাল যে দিকে থাকে, নদীর পানি সেদিকেই গড়ায়। স্বাভাবিকভাবেই গঙ্গার পানি তাই গড়িয়ে আসবে বাংলাদেশের মধ্যে। এরকমই আমার ধারণা। ফারাক্কা ব্যারাজ চালু হয় জিয়া যখন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজি দেশাই। মোরারজি দেশাইয়ের পানিসম্পদমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারি বাজপেয়ী। বাজপেয়ী আমাদের যথেষ্ট পানি দিয়েছিলেন। কিন্তু মোরারজি দেশাইয়ের মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। ক্ষমতায় আবার আসেন ইন্দিরাগান্ধী। তিনি আমাদের পানি দিতে চান না। এরপর আবার ইন্দিরা সরকারের পতন হয়। দেবগৌড়া হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর দেবগৌড়া প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় গঙ্গার পানি বণ্টন-চুক্তি। এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পেছনে ছিল পশ্চিমবঙ্গের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসুর আন্তরিক প্রচেষ্টা। আমরা অবশ্য এখনও বাস্তবে প্রতি বছর শুকনো মওসুমে (১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে) চুক্তি অনুসারে পানি পাচ্ছি না। কিন্তু এই চুক্তির ফলে একটি লাভ হয়েছে, তা হলো ভারত নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছে যে, গঙ্গা নদীর পানির ওপর বাংলাদেশেরও অধিকার আছে।
ভারতের সাথে নতুন করে পানি বিরোধ দেখা দিয়েছে তিস্তার পানি নিয়ে। তিস্তা নদীর উদ্ভব হয়েছে সিকিমে। সেখান থেকে তা বয়ে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশে। সেখান থেকে সে বয়ে এসেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে এটি বয়ে এসে পড়ছে বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্রে। তিস্তা এক সময় এসে পড়ত পদ্মা নদীতে। কিন্তু ১৭৭৭ সালে প্রবল বন্যার সময় তিস্তা তার খাদ বদলায়। এসে তিস্তা পড়তে আরম্ভ করে ব্রহ্মপুত্রে। ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশে দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এক ভাগকে বলে নতুন ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা। আর অন্য ভাগকে বলা হয় পুরাতন ব্রহ্মপুত্র। যা প্রবাহিত হয়েছে ময়মনসিংহ শহরের মধ্য দিয়ে। এই ধারাকে বলা হয় পুরাতন ব্রহ্মপুত্র। ভারতের সাথে নদীর পানির বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে বরাক নদীর পানি নিয়ে। এই নদীর উদ্ভব হয়েছে নাগা-মণিপুর জলপ্রপাত থেকে। সিলেট বিভাগের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় বরাক নদী বিভক্ত হয়েছে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দু’টি শাখায়। পরে সুরমা ও কুশিয়ারা একত্র হয়ে ভৈরব বাজারের কাছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। নাম ধারণ করেছে মেঘনা। যমুনা ও পদ্মা নদী গোয়ালন্দের কাছে একত্র হয়ে পদ্মা নামে পরিচিত হয়েছে। এই পদ্মা ও মেঘনা একত্র হয়েছে চাঁদপুরের কাছে। এই একত্রিত ধারা মেঘনা নামে পরিচিত হয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে।
ভারত চাচ্ছে বরাক নদীর ওপর আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে। কিন্তু এ রকম বাধ নির্মাণ করলে বাংলাদেশ আর আগের মতো বরাক নদীর পানি পাবে না। এ ক্ষেত্রেও তাই দেখা দিয়েছে একটা পানি বণ্টন চুক্তির প্রয়োজন। বাংলাদেশ ছিল একটা নদীমাতৃক দেশ। কিন্তু সে আর আগের মতো নদীমাতৃক দেশ থাকছে না। তাকে এখন অধিক নির্ভরশীল হতে হবে বর্ষার বৃষ্টির পানির ওপর। বর্ষাকালে বাংলাদেশে যথেষ্ট বৃষ্টি হয়। এই বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে পানির অভাব পূরণে। সাধারণত মরুময় অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হয় বছরে ৫০ সেন্টিমিটারের কম। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো অংশেই বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এত কম নয়। বর্ষার পানি ধরে রেখে তাই পানির অভাব পূরণ করা সম্ভব। বাংলাদেশে শীতকালে বৃষ্টি হয় না। কিন্তু শীতকাল এ দেশে থাকে মধ্য অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষভাগ পর্যন্ত। বাংলাদেশে দক্ষিণ-পশ্চিম মওসুমি বাতাসের প্রভাবে যথেষ্ট বৃষ্টি হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম মওসুমি বাতাসে বঙ্গপোসাগরীয় শাখা বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচুর জলীয়বাষ্প বহন করে আনে। যা জমে পরিণত হয় মেঘে। মেঘ থেকে হয় বৃষ্টি। মেঘ থেকে বৃষ্টি হওয়ার একটা কারণ হলো, জলীয় বাষ্পপূর্ণ বাতাস হিমালয় পর্বতমালায় ধাক্কা খেয়ে উপরে উঠতে থাকে। ফলে সহজে মেঘের উদ্ভব হয়। পাহাড় আছে বলেই এরকম বৃষ্টি হওয়া সম্ভব হয়। না হলে হতো না।
দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর ভাগের যে অংশে থর মরুভূমি অবস্থিত, সেখানে আড়াআড়ি পাহাড় নেই বলে জলীয়বাষ্পপূর্ণ বাতাস তাতে ধাক্কা খেয়ে উপরে উঠে মেঘে পরিণত হতে পারে না। এই অঞ্চল তাই বৃষ্টি বিরল অঞ্চল। বাংলাদেশের পরিস্থিতি এরকম হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশের উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা থাকছেই। যাতে মওসুমি বাতাস ধাক্কা খেয়ে উপরে উঠে মেঘ সৃষ্টি হবেই। হিমালয় পাহাড় পেরিয়ে মওসুমি বাতাস যখন তিব্বতে যায়, তখন তাতে জলীয়বাষ্প থাকে না বললেই হয়। তিব্বত তাই একটা বৃষ্টি-বিরল অঞ্চল ((Rain Shadow)। আমি প্রাথমিক ভূগোলের এসব কথা বলছি, কেননা অনেকেই বলছেন বাংলাদেশ ভবিষ্যতে হয়ে উঠবে একটা মরুময় অঞ্চল। কিন্তু তার সম্ভাবনা নেই। ভৌগোলিক বাস্তবতার বিচারেই সেটা বলা যায়।
গত সংখ্যার সংশোধনী : গত লেখায় (১৯ মে ২০১৮) ভুলবশত ছাপা হয়েছে : ‘কার্ল মার্কস বলেছিলেন, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রথমে প্রবর্তিত হল বিলাতে।’ সেখানে আসলে হবে ‘কার্ল মার্কস বলেছিলেন, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রথমে প্রবর্তিত হবে বিলাতে।’
চিঠির উত্তর : নয়া দিগন্তের ২৩ মে ২০১৮ সংখ্যায় ফরিদ মুন্্শী, ঢাকা থেকে জানতে চেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের জমিদারি পতিসরে একটি সমবায় কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন। এ সম্পর্কে আমি কিছু জানি কি না। আমি এই সম্পর্কে বিশদ কিছু জানি না। যা জানি তাও কতটা নির্ভরযোগ্য সেটা নিয়ে আমার নিজের মনেই সংশয় আছে। তাই এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করা সমীচীন হবে বলে মনে করছি না। রবীন্দ্রনাথ পতিসরের জমিদারি লাভ করেছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর নওগাঁর কালিগ্রাম মৌজার জমিদারি কিনেন ১৮৩০ সালে। পতিসর কালীগ্রাম মৌজায় অবস্থিত একটি গ্রাম। রবীন্দ্রনাথ এই জমিদারি উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন। এ বিষয়ে যথাযথভাবে জানতে হলে পড়–ন সিদ্ধার্থ ঘোষ লিখিত প্রবন্ধ ‘প্রিন্স দ্বারকানাথ’ (দেশ, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪, পৃষ্ঠা ২৫)। শাহজাদপুর রবীন্দ্রনাথের জমিদারি নয়। শাহজাদপুর হলো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারি। শিলাইদহ হলো গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারি। এরা যখন নাবালক ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তখন এই দুই জমিদারি এদের পক্ষ হয়ে দেখাশোনা করতেন। তাই ভুল ধারণা জন্মেছে যে, এ দুটিও ছিল রবীন্দ্রনাথের জমিদারি। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির জমিদারি ছিল বহু ভাগে বিভক্ত। এর ছিল অনেক শরিক। ১৮৬৩ সালে রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বোলপুর স্টেশনের কাছে জায়গা কিনে শান্তিনিকেতন আশ্রম স্থাপন করেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে এখানে ‘ব্রহ্মাচার্যাশ্রম’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এতে কেবল হিন্দু ও ব্রাহ্মণ ছাত্ররাই পড়তে পারত। পরে রবীন্দ্রনাথ এখানে বিশ্বভারতী নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। রবীন্দ্রনাথ এই অর্থের জন্য সে সময়ের ভারতে বিভিন্ন দেশীয় রাজাদের কাছে চাঁদা চেয়ে পাঠান। কিন্তু কোনো দেশীয় রাজা চাঁদা দেন না, একমাত্র হায়দ্রাবাদের নিজাম ছাড়া। তিনি এক লাখ টাকা চাঁদা দেন। এক লাখ টাকা সে সময় ছিল একটা বড় রকমের অঙ্ক। এই চাঁদা পাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীতে কিছু হাতেগোনা মুসলমান ছাত্রের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন। এসব ছাত্রের মধ্যে বিশেষ খ্যাত হলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। যা ছিল ব্রহ্মাচার্যাশ্রম, তাকে বলা হতে থাকে শান্তিনিকেতন। অর্থাৎ শান্তিনিকেতন হলো স্কুল আর বিশ্বভারতী হলো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে। এখন শান্তিনিকেতন অথবা বিশ্বভারতীতে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘বাংলাদেশ ভবন’। যা নিয়ে খুব সোরগোল করা হচ্ছে। বিশ্বভারতীয় লেখাপড়ার ব্যাপারে তেমন কোনো নামকরা প্রতিষ্ঠান নয়। বিশ্বভারতী খ্যাতি অর্জন করেছে চিত্রকলা, সঙ্গীত ও নৃত্যকলায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালের জুলাই মাসে। এই বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ববঙ্গে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে খুবই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে ও করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলেই পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজে একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব সম্ভব হয়েছিল। যারা হলেন আজকের বাংলাদেশের উদ্ভবের ভিত্তিভূমি। ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে পালন করেন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে তার মৃত্যুর পরে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাংলাদেশের একদল বুদ্ধিজীবী বোঝাতে চাচ্ছেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, আসলে বিশ্বভারতীই হচ্ছে বাংলাদেশের সংস্কৃতির উৎসভূমি। আমি জনাব ফরিদ মুনশীর চিঠির উত্তরে এসব কথার অবতারণা করছি এ জন্য যে, রবীন্দ্রনাথ কেমন জমিদার ছিলেন, সেটা আর আমাদের আলোচ্য হওয়া উচিত নয়। আলোচ্য হওয়া উচিত রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাংলাদেশে যে বিশেষ রাজনীতি করা হচ্ছে, সেইটাই; যদি আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে চাই।
হায়রে বাংলাদেশ! আজ যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন লজ্জায় মাথা লুকতেন কোথায় ? এই লজ্জা বঙ্গবন্ধুর ; এই লজ্জা সমগ্র বাঙ্গালী জাতির। ছাত্র রাজনীতির উদার পাঠশালা থেকে নেতৃত্বের গুনাবলি বিকাশিত করে একটি জাতিকে স্বাধীনতা উপহার দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। আর বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি হয়ে উঠেছে কিছু বিবেক-বুদ্ধিহীন, চাটুকার, তেলবাজ, সন্ত্রসী, ধর্ষণকারী তৈরির কারখান। যেই রাজনীতি ছাত্রদের লাভ বুঝতে পারে না, ছাত্রদেও যৌকিক্ত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় না, বরং সেই ছাত্র আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রের লাঠিয়াল বাহিনী কাজ করে, সেই রাজনীতি ছাত্রদের জন্য তো নয়ই, সর্বোপরি দেশের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।
বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করেছিলেন বেশির ভাগ মানুষ তাকে ভুল বুঝেছিলেন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের অনেকেই না বুঝে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা কখনোও বাকশালের মর্মার্থ বুজতে পারেনি এবং বাকশালের চেতনা দেশের মানুষের কাছে পৌছে দিতে পারেনি। যার মূল্য বঙ্গবন্ধু দিয়ে গেছেন জীবন দিয়ে। এমনকি বর্তমানেও বাকশালকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গালি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের ভায়েরা তো এরিয়ে যান অথবা কুতর্কে জড়িয়ে পরেন। আজ ছাত্রলীগের মেধা -মননের চর্চা না থাকায় আওয়ামী লীগ কে বার বার লজ্জিত হতে হয়।
চীনের কিংবদন্তি নেতা মাও সে তুং ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে আজ চীন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ, যাকে নিয়ে চীনা কমিউনিষ্ট পার্টি এবং সমগ্র চীন গর্ব করে। অথচ একই উদ্দ্যেশে একই প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে তার জীবন উৎসর্গ করতে হল। আর আওয়ামী লীগ আজও বয়ে বেড়াচ্ছে বাকশালের অপবাদ। এই ব্যার্থতা কার ? অনেকের অনেক ধরনের উত্তর থাকতে পারে। কিন্ত আমি মনে করি এই ব্যর্থতা সম্পূর্ন রূপে ছাত্রলীগের , যারা তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য ভূলে আওয়ামী লীগের লেজুড় এবং সরকারের পেটুয়া বহিনীতে পরিণত হয়েছে। মেধার চর্চা না থাকলে ছাত্ররাজনীতি তার উদ্দেশ্য হাসিল ব্যর্থ হয় তা আমরা বাঙ্গালীরা ছারা কেই বা ভাল বুজবে?
ছাত্রলীগের রয়েছে এক গৌরবময় ইতিহাস, অথচ আজ ছাত্রলীগের বদনামের অন্ত নেই। কোটা পদ্ধতি সংষ্কারের মত একটি যৌকিক্ত ছাত্র আন্দোলন দমনে আজ ব্যবহৃত হচ্ছে ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগের ভাইদের রাজপথের এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গত কয়েকদিনের কর্মকান্ডে জাতি বাকরুদ্ধ। বিশেষ করে লন্ডনে সেচ্ছা নির্বাসিত একজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতার অনলাইন কর্মকান্ড জাতিকে ব্যাথিত করেছে। তবে তাদের মনে রাখা উচিত ছাত্রদের বিরুদ্ধে গিয়ে ছাত্র রাজনীতি করা যায় না। আর ছাত্রলীগ যদি এই পথেই হাটে তবে তা আওয়ামীলীগের বোঝা ভারি করা ছাড়া কোন ইতিবাচক ফলাফল দিতে পারবে না। আওয়ামী লীগ বিরোধী নিন্দুকেরা একটা হাস্যকর প্রবাদের জন্ম দিয়েছিল বহু আগে “তুই মানুষ না, তুই আওয়ামী লীগ” আর এখন সমগ্র বাংলাদেশ বলে “তুই ছাত্র না, তুই ছাত্রলীগ”।
ওয়াসার মহামান্য এমডি ঢাকাবাসীর উদ্দেশে যে আশ্বাস বাণী উচ্চারণ করেছেন তাকে আশ্বাস বাণী না বলে সতর্কবার্তা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। তিনি বলেছেন, ঢাকায় টিপটিপ বৃষ্টি হলে পানি জমবে না। তা সে বৃষ্টি যদি টানা ১০ দিন ধরেও হয়। তবে ঘণ্টায় ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিকে কিছুটা সমীহ করে বলেছেন, ‘একটু জলজট হতে পারে’। এই একটু জলজট বলতে কতটুকু বোঝায় তাও পরিষ্কার করেননি তিনি।
টিপটিপ বৃষ্টিপাতের কথা বলে যে মহাকাব্যিক ব্যাখ্যা এই ব্যবস্থাপক উপস্থাপন করেছেন, সম্ভবত বিষয়টি আজকের শিশুটিও জানে। তবে জানেন না ওয়াসার এমডি তাসকিম এ খান। আমাদের জ্ঞানের স্বল্পতার কথা ভেবেই তিনি হয়তো টিপটিপ বৃষ্টির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এ কথা স্মরণ না করিয়ে দেওয়াটাই বোধহয় শোভন ছিল। তবে শোভন-অশোভনের বাইরে তিনি বেশকিছু কঠিন ও বাস্তব কিছু চিত্র তুলে ধরেছেন, যা সত্যিকার অর্থেই প্রশংসার দাবি রাখে।
তিনি বলেছেন, একসময় ঢাকায় ৬৫টি খাল ছিল। এখন তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ভার। এখন মাত্র ২৬টি খালের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। যদি শহরের এই ৬৫টি খাল এবং শহর ঘিরে যে পাঁচটি নদী প্রবাহিত ছিল তা জীবিত থাকত, তাহলে যেকোনো অবস্থায় আজ আর জলজট নিয়ে এত দুশ্চিন্তায় পড়তে হতো না। তিনি বলেছেন, খাল দখল হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। তবে খাল দখলে ওয়াসার কেউই জড়িত নন। আর এটা কোনো চুনোপুঁটির কাজও নয়। যারা দখল করেছেন এবং করছেন তাদের হাত অনেক লম্বা। ক্ষমতাও অনেক।
রাজধানীর জলজট হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি জল সংরক্ষণের জন্য যে পরিমাণ জলাভূমির প্রয়োজন, তা নেই বলে উল্লেখ করেন। তিনি জানান, রাজধানীতে জলজট নিরসনের জন্য প্রয়োজন ১২ শতাংশ জলাভূমি। সেখানে আমাদের হাতে এখন রয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। যার অধিকাংশই চলে গেছে ভূমিদস্যুদের দখলে। এসব কারণে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন কিছুটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
ওয়াসার এমডির উল্লিখিত ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হয়ে বলতে চাই, আমরা ঢাকা মহানগরকে জলজটমুক্ত একটি শহর হিসেবেই দেখতে আগ্রহী। যা হারিয়েছি তা ভুলে গিয়ে, যা আছে তাই নিয়ে নতুন করে শুরু করতে চাই। যেটুকু আছে তা বাঁচাতে চাই। সেটুকু বাঁচাতে পারলে রাজধানীবাসীও রক্ষা পেতে পারে— এটাই তাদের প্রত্যাশা।
প্রাণের উৎস পানি। এক ফোঁটা পানির কাছে তৃষ্ণার সময় সব খাবার অপ্রয়োজনীয়। পানির অস্তিত্ব খোঁজার জন্য বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বাইরে চাঁদ ও মঙ্গলে অভিযান চালাচ্ছে। কারণ, পানির সন্ধান পেলেই সেখানে প্রাণের খোঁজ মেলা সম্ভব। আবার পৃথিবীর পরবর্তী মানুষের বাসস্থান এসব গ্রহ হতে পারে, যদি সেখানে পানি পাওয়া যায়। আমাদের এই ভূমণ্ডলের বেশির ভাগ অংশই পানি হলেও খাওয়ার উপযোগী পানির পরিমাণ কম। সেই কম থেকে আরো কমে আসছে।
নিরাপদ পানির উৎসস্থল ক্রমেই আশঙ্কাজনকভাবে কমে আসছে, যা আমাদের জীবন ও জীবিকার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। বিশ্বেরর অনেক বড় শহর আজ পানির তীব্র সংকটে ভুগছে। কয়েকটি শহর তো রীতিমতো পানিশূন্য হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছে। আমাদের তিলোত্তমা শহর ঢাকা সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে। গরমের সময় এ সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করে। ক্রমেই ঢাকার আশপাশের নদনদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়াতে এবং তার সাতে পানি সংরক্ষণের কোনো সুবিধাজনক উপায় না থাকায় গত কয়েক বছরে পানির স্তর নষ্ট হচ্ছে।
কোনো সুপেয় পানির অভাব তার পেছনে অপরাপর বেশ কিছু কারণ জড়িত রয়েছে। আমাদের জনসংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা বেড়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে নদীনালা ভরাট হচ্ছে। নদীনালা, খালবিল ভরাট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ পানির উৎস নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি দ্রুত জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে দ্রুত নগরায়ণ ঘটছে। কৃষিজমি ভরাট হয়ে গড়ে উঠছে শিল্প-কারখানা। এসব শিল্প-কারখানার বিষাক্ত পদার্থ নদীতে পড়ার ফলে দূষিত হচ্ছে পানি। তা ছাড়া বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য পানির জোগান দেওয়া কর্তৃপক্ষের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। পানির জন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিভেদ, উপমহাদেশীয় আন্তকলহ। বাংলাদেশের সথেঙ্গ ভারতের পানিবন্টন নিয়ে অমীমাংসিত ইস্যু বহুদিন ধরেই ঝুলন্ত রয়েছে। তাই প্রয়োজন পরে পানির সঠিক সংরক্ষণ ও সঠিক ব্যবহার।
সুপেয় পানি কাকে বলে এর সজ্ঞায় জানা যায়, পনিতে লবণাক্ততার মাত্রা ৫০০ পিপিএম বা এক মিলিয়নের পাঁচশত ভাগের চেয়ে কম থাকে তাকে সুপেয় পানি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী গোটা বিশে^র সিংহভাগ মানুষের নিরাপদ পানি সুযোগ নেই। নিরাপদ পানির অভাবে বিশ্বে প্রতিদিন এক হাজার চারশ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। এর অধিকাংশই দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। সারা বিশ্বেই এই এক চিত্র। অথচ পানির অপচয় কমাতে পারলে এবং সুষ্ঠু বণ্টন করতে পারলে এই দরিদ্র্র শ্রেণির অনেকেই পানি থেকে বঞ্চিত হতে পারে না। আমাদের দেশে বৃষ্টি বা এ রকম উৎস থেকে যে পানি আসছে তার অধিকাংশই নষ্ট হচ্ছে। অর্থ্যাৎ তা মাটিতে ফিরে যেতে পারছে না। অধিকাংশ নদীর পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে পানির সংকট ঘনীভূত হচ্ছে।
গেল পানি দিবসেও বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বিশ্বে যে পরিমাণ পানি রয়েছে তার মধ্যে মাত্র .০১৪ ভাগ খাবার পানি রয়েছে। পানি মানুষের জীবন-জীবিকা ও উন্নয়নের সব বিষয়ের অত্যাবশ্যক উপাদান। তাই পানির সঠিক হিসাব হওয়া উচিত। মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হলে পানির ন্যায্য হিসাব একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য সুপেয় পানি এবং মোট জনসংখ্যার অন্তত ৯০ শতাংশের জন্য পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধ পরিকর। বাংলাদশের জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতিতে পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের কষিকাজ, শিল্প-কলকারখানা, মৎস্য চাষ, জলজ সম্পদের আরোহণ থেকে শুরু করে আমাদের ঐতিহ্য এর সঙ্গে জড়িত। বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই পানির সংকটের ব্যাপারে সতর্ক করে আসছেন। আমাদের দেশে কেবল রাজধানী ঢাকা শহর নয় বরং প্রধান প্রধান বিভাগীয় শহরগুলোয়ও পানির তীব্র সংকট ঘনীভূত।
বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে প্রায় ৭৬ কোটিরও বেশি মানুষ। আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ ৯৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ৭০০ কোটি মানুষ সুপেয় পানির সংকটে পড়বে। এখনই বিশ্বে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ পানি পায় না অথবা তাদের কাছে নিরাপদ পানি পৌঁছায় না। ইউনিসেফ এর আগে এক জরিপে বলেছিল, আমাদের দেশের প্রায় কোটি ৬০ লাখ জনগোষ্ঠী সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে। সুপেয় পানির সুযোগ বঞ্চিত জনসংখ্যার দিক থেকে আমাদের দেশের অবস্থান সপ্তম।
এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছিল, বাংলাদেশের ৪৪ শতাংশ মানুষ খাওয়ার জন্য নিরাপদ পানি পায় না। আমাদের দেশের প্রায় এক হাজার তিন শ নদীর মধ্যে শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ২১২টি নদীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আর্সেনিক ঝুঁকিতে ভুগছে কয়েক কোটি মানুষ। পানযোগ্য সুপেয় পানির চাহিদা ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এ সংকট মোকাবিলায় আামদের বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক। এর মধ্যে মিঠাপানির উৎস সৃষ্টি করা, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সুপেয় পানির প্লান্ট করা, দেশের সর্বত্র বৃষ্টির পানির সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, শহরের মতো গ্রামের মানুষের জন্য পানি ব্যবস্থাপনা করা, দেশের খাল বিল ও জলাভূমিগুলো রক্ষা করতে হবে, পরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ করতে হবে, সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে। এ ছাড়া দেশের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে পানির সঠিক ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে হবে।
পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে এর বাস্তবায়নের কাজ। ইতোমধ্যেই এ সেতুর ৬০০ মিটার দৃশ্যমান হওয়ার পথে। চলছে চতুর্থ স্প্যান বসানোর প্রস্তুতি। সোনালি রঙের এই স্প্যানে গেন্ডিং মেশিন দিয়ে জোড়া লাগানো স্থানগুলো ফিনিশিং করা হচ্ছে। এ ছাড়া এই স্প্যানটি বহনের জন্য ৩৬০০ টন ওজন বহনের ক্ষমতার ভাসমান ক্রেনের জাহাজটিও বিশেষায়িত ওয়ার্কশপের জেডির অপর প্রান্তে নোঙর করা হয়েছে। রঙের কাজ শেষ হলেই ‘৭ই’ নম্বর স্প্যানটি বহন করে নিয়ে যাব ৪০ ও ৪১ নম্বর খুঁটিতে। এই খুঁটির ওপরই বসবে চতুর্থ স্প্যান। ৪১ নম্বর খুঁটিও স্প্যান বসানোর উপযোগী করা হচ্ছে। আর এর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ৬০০ মিটার।
গতকাল প্রতিদিনের সংবাদে প্রকাশিত এক বিশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর ১৪টি খুঁটির ডিজাইনও সম্পন্ন হয়েছে। শিগগিরই এটি সেতু কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর হবে বলে দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন। অন্যদিকে, সেতুর ৪১টি স্প্যানের কয়েকটি ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। দ্রুত সময়ে এসব স্প্যান স্থাপনের কাজ শুরু করা হবে। এই সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ বিশেষভাবে উপকৃত হবে।
বিশেষ করে ফরিদপুর, শরীয়তপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় নতুন করে শিল্পায়ন হবে। এতে ওই অঞ্চলের অনেক মানুষ রাজধানীর পরিবর্তে ওই অঞ্চলে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানায় কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে। এ ছাড়া এ সেতুর মাধ্যমে রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার যাতায়াত ব্যবস্থাও সুগম হবে। আমরা জানি এ সেতুর সঙ্গে ট্রেন লাইনও সংযোগ করা হবে। আর তার বাস্তবায়ন হলে খুবই কম সময়ে ঢাকা থেকে ওই অঞ্চলের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা হবে। বর্তমানে মংলা সমুদ্র বন্দরের অনেকটাই অব্যবহৃত পড়ে থাকে। পদ্মা সেতু চালু হলে মোংলা বন্দরের কর্মচাঞ্চল্য অনেক গুণ বেড়ে যাবে।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে। কিন্তু এ সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগ এবং প্রাকযোগ্যতা যাচাই নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক প্রকল্পটিতে অর্থায়ন স্থগিত করে। এরপর অনেকেরই আশঙ্কা ছিল এ প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে।
তবে সব আশঙ্কা অমূলক প্রমাণ করে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্পের কাজ এখন দ্রুত এগিয়ে চলেছে। আমরা আশা করছি, যথাসময়েই এর কাজ শেষ হবে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে রেল ও সড়ক যোগাযোগের পাশাপাশি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রেও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
ইউএস-বাংলা বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা বাংলাদেশ, নেপালসহ আজ বিশ্বব্যাপী আলোচিত ও সমালোচিত হচ্ছে। শোকাবহ করেছে সর্বস্তরের মানুষকে। শোক জানিয়েছে জাতিসংঘ, বাংলাদেশ, নেপাল, বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংগঠন। ঢাকা থেকে কেবিন ক্রুসহ ৭১ জন যাত্রী নিয়ে নেপালের উদ্দেশে আকাশে উড়েছিল বিমানটি। একপক্ষের মতে, ১২ মার্চ দুপুর প্রায় ২টায় নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন এয়ারপোর্টের কন্ট্রোল রুমের ভুল নির্দেশনা ও সিদ্ধান্তের কারণে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। পাইলটসহ নিহত হন ৫১ জন।
হিমালয়কন্যা নেপালের এই ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে বিমান দুর্ঘটনাই প্রথম নয়। ভয়ংকর অতীত আজো ইতিহাসে সাক্ষী হয়ে আছে। এ যেন এক মৃত্যুফাঁদ। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর পাহাড়ের কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা এই বিমানবন্দর বহু দুর্ঘটনার সাক্ষী। ১৯৫৬ সাল থেকে ১২ মার্চ ২০১৮ দুর্ঘটনার আগ পর্যন্ত মোট ১০টি বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। কন্ট্রোল রুমের ভুল নির্দেশনা ও বৈরী আবহাওয়া প্রায় সব দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরই পাইলটকেই দোষারোপ করেন।
৩১ জুলাই ১৯৯২ সালে থাই এয়ারওয়েজের একটি এয়ারবাস অবতরণ করার জন্য বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় একটি পাহাড়ে বিধ্বস্ত হয়। এতে ১১৩ জন যাত্রীর সবাই নিহত হন। একই বছর ২৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি এয়ারলাইনস বিধ্বস্ত হয়। এতে নিহত হন ১৬৭ জন। ৭ জুলাই ১৯৯৯ সালে লুফ?টহানজা কার্গো বোয়িং ৭২৭ আকাশে ওড়ার পাঁচ মিনিট পড়ে চম্পাদেবী পর্বতে বিধ্বস্ত হয়। ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সালে নিকন এয়ার ফ্লাইট ১২৮ পোখারা থেকে কাঠমান্ডু যাওয়ার সময় বিধ্বস্ত হয়। বিমানে থাকা ১০ যাত্রী এবং ৫ জন ক্রু সবাই নিহত হন।
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে সীতা এয়ার ফ্লাইটের বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন ১৯ জন। ২০১৬ সালে নেপালের বিমান ভেঙে মৃত্যু হয় ১৮ জন যাত্রীর। ইউএস-বাংলা বিমান বিধ্বস্তের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে টারা এয়ারল্যান্স বিমান দুর্ঘটনায় ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
সর্বশেষ ১২ মার্চ বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান ইউএস কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন এয়ারপোর্টসংলগ্ন ফুটবল মাঠে বিধ্বস্ত হয়। কেবিন ক্রু, পাইলটসহ নিহত হন ৫১ জন। যার বেশির ভাগই বাংলাদেশি। ক্রমাগত বিমান দুর্ঘটনা নেপাল এয়ারলাইনসকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কন্ট্রোল রুমে থাকা কর্মকর্তাদের উদাসীনতা কিংবা সেখানকার আবহাওয়াগত সমস্যার কারণেই দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। নেপাল গণমাধ্যম এ দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণের জন্য কমিটি গঠন করেছে। শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছে দেশটির সরকার।
আমরা নেপাল সরকারের প্রতি আহ্বান রেখে বলতে চাই, কেবল শোক ও দুঃখ প্রকাশের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ না রেখে এয়ারপোর্টটির সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগী হওয়ার সময় এসেছে। বিশ্বের শোকার্ত মানুষের আর্তির দিকে তাকিয়ে নেপাল সরকার নিশ্চয়ই সে আর্তির প্রতি মনোযোগী হবেন—এটাই প্রত্যাশা।