সম্প্রতি রাশিয়া থেকে অত্যাধুনিক এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে তুরস্ক। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক বাহিনীর দেশ তুরস্ক গত এক বছর ধরেই সিরিয়ায় মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতামূলক কর্মকান্ড করছে। একইভাবে সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ সম্প্রতি ঐতিহাসিক এক সফরে মস্কো গিয়ে বেশ কিছু সহযোগিতার চুক্তি সম্পাদন করেছেন। তিনিও তার দেশের জন্য রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ক্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক পুরনো মিত্র পাকিস্তান মস্কোর সহযোগিতায় ৬০০ মেগা ওয়াটের বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনে সম্মত হয়েছে, রাশিয়া থেকে হেলিকপ্টার ও প্রতিরক্ষাসামগ্রী কিনেছে এবং যৌথ সামরিক মহড়া করেছে রুশ বাহিনীর সঙ্গে। অথচ এই তিনটি দেশই স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের পর যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরব। মিত্রতার সম্পর্ক চলছে দশকের পর দশক ধরে। ওবামা প্রশাসনের শেষ দিকে এসে ওয়াশিংটন-রিয়াদ কিছুটা দূরত্ব তৈরি হলেও ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর তা কমতে থাকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম বিদেশ সফরেই যান সৌদিতে। আর তুরস্ক হলো যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো-মিত্র। প্রথাগত সামরিক শক্তির দিক থেকে ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই অবস্থান তুরস্কের। ইউরোপের নিরাপত্তা ও বাণিজ্যের জন্য তুরস্ক পশ্চিমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দেশ। সার্বিক বিবেচনায় ওয়াশিংটন-আঙ্কারা পরস্পরের খুবই ঘনিষ্ঠ মিত্র। অন্যদিকে রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী, বলা যায় ‘চিরশত্রু’ও। আর এই চিরশত্রুর সঙ্গে কিনা মাখামাখি শুরু করল মার্কিন ঘনিষ্ঠ মিত্ররা! তুরস্ক আর সৌদি আরব রাশিয়ার সঙ্গে করছে একের পর এক সামরিক-অস্ত্র চুক্তি। মজার বিষয় হলো, রাশিয়ার সঙ্গে আঙ্কারা ও রিয়াদের সম্পর্কও নিকট অতীতে মধুর ছিল না।
গত ২৫ বছরে কোনো সৌদি বাদশাহ রাশিয়া সফর করেননি। রাশিয়ার সরকারপ্রধানদের কেউও আসেননি সৌদিতে। তেল বাণিজ্য নিয়ে দু’দেশের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বহু পুরনো। তুরস্ক তো বছর দুয়েক আগে সিরিয়া রুশ যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছিল। যার স্বাভাবিক ফল, দুই দেশের সম্পর্কে চূড়ান্ত অবনতি। কথাযুদ্ধ শুরু হয় উভয়পক্ষে। অর্থনৈতিক অবরোধও চলেছে অনেক দিন। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় সংকট সিরিয়া যুদ্ধ। এ ক্ষেত্রেও তুরস্ক ও সৌদিআরব রাশিয়ার বিপরীত অবস্থানে আছে। রাশিয়া সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে টিকিয়ে রাখতে মরিয়া; পতনের মুখে থাকা বাশারকে আবার শক্ত অবস্থানে নিতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে সৌদি-তুরস্ক চায় বাশারকে সরাতে। যদিও সম্প্রতি আঙ্কারা নিজেদের অবস্থান কিছুটা নরম করেছে এ ক্ষেত্রে। পরস্পরের প্রতি এত বিরোধ থাকার পরও গত কয়েক মাসে তুরস্ক ও সৌদি আরব ক্রেমলিনের সঙ্গে একাধিক সামরিক চুক্তি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (থাড) থাকার পরও রাশিয়ার তৈরি এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে দুটি দেশই।
গত বৃহস্পতিবার এই সমরাস্ত্র কেনার ঘোষণা দেয় সৌদি আরব। তার আগে গত সেপ্টেম্বরে তুরস্কও জানায় তারা এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার জন্য চুক্তি করেছে। দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতারা বিভিন্ন সময়ে এই অঞ্চলে ওয়াশিংটনের ছায়া হিসেবে কাজ করেছেন ও ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রেখেছেন। ওয়াশিংটন-আঙ্কারা সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বুঝতে একটি উদাহরণই যথেষ্ট যে, তুরস্কের ইনজারলিক বিমানঘাঁটি থেকে মার্কিন বোমারু বিমান সিরিয়ায় বোমা ফেলছে। ঘাঁটিটিতে প্রায় ৫০টি বি-৬১ বোমারু বিমান ও হাইড্রোজেন বোমা মোতায়েন রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই ঘাঁটির নিরাপত্তার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অবশ্য ২০১৬ সালে জুলাইয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেফ তাইয়েব এরদোগানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ঘাঁটির কমান্ডার জেনারেল বেকির এরকান ভ্যানসহ ৯ কর্মকর্তাকে অভ্যুত্থান চেষ্টায় সমর্থনের দায়ে গ্রেফতার করেছিল তুরস্ক। ঘাঁটির লোকদের বাইরে আসা-যাওয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এমনকি বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। সে সময় ঘাঁটির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। একইভাবে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বুঝতে একটি বিষয় জানা দরকার যে, স্নায়ুযুদ্ধের সময় আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের গোয়েন্দা শক্তি এবং উপসাগরীয় অর্থ কাজে লাগিয়েছে ওয়াশিংটন।
এটা ঠিক যে, যুক্তরাষ্ট্র মিলিশিয়াদের সহায়তা করে; তবে তা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ও নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য। যেমন জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার করার পর আফগান মুজাহিদদের আর সহায়তা দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। মস্কোর সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পাওয়া তুর্কি নেতা ফতহুল্লাহ গুলেনের অনুসারীদের দ্বারা অভ্যুত্থান চেষ্টা। তবে এই সম্পর্ক উন্নয়নের শিকড় আরো গভীরে, যেখানে আছে সিরিয়া নীতি নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিভক্তি। ২০১৪ সালে আইএস ইরাকের বেশ কয়েকটি শহর দখল করে নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র তাদের সিরিয়া ও ইরাক নীতিতে কুর্দিদের অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করে। মনে রাখা দরকার যে, সিরিয়া ও ইরাকের সংঘাত মূলত ত্রিপক্ষীয়- সুন্নি আরব, শিয়া আরব ও সুন্নি কুর্দি। আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষণা করার পর যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের শিয়া সরকারে সহযোগিতা নিয়েছে, যদিও শিয়া আরবদের ওপর তাদের আস্থা কম। কারণ শিয়া আরবরা সব সময়ই ইরানপন্থি হিসেবে পরিচিত।
সৌদি ও তুরস্কের এমন পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। পেন্টাগনের মুখপাত্র মিশেল বলডেনজা গত ৬ অক্টোবর এক ব্রিফিংয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে কিছু মিত্র দেশ যেভাবে রাশিয়ার সমরাস্ত্রের দিকে ঝুঁকছে তাতে ওয়াশিংটন উদ্বিগ্ন। কিন্তু এভাবে মিত্ররা কেন ‘ভরসা’ হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর? এর কারণ বহুবিদ। তুরস্কের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল রাজনৈতিক ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মধ্যপ্রাচ্যেও তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে, যা মার্কিন স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। গত দেড় দশক ধরে পশ্চিমামুখী পররাষ্ট্রনীতির চেয়ে রাজনৈতিক ইসলামের ভিত্তিতে গড়া প্রাচ্যমুখী নীতিকে প্রাধান্য দিচ্ছে দেশটির সরকার। এতে দীর্ঘ মেয়াদে ওয়াশিংটনের সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। তবে তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক খুব বেশি শীতল হওয়ার পেছনে রয়েছে ২০১৬ সালের ১৫ জুলাইয়ের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান। রিসেপ তায়েপ এরদোগানের সরকার মনে করে, অভ্যুত্থান চেষ্টাকারীদের সঙ্গে মার্কিনিদের সংযোগ ছিল। কারণ, বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাদের বেশিরভাগ নিয়োজিত ছিলেন তুরস্কে মার্কিন বিমান ঘাঁটি ইনজিরিলিকে।
এরপর যখন অভ্যুত্থানের নেপথ্য কারিগর হিসেবে অভিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত আধ্যাত্মিক নেতা ফেতহুল্লাহ গুলেনকে প্রত্যাবাসনে মার্কিন কর্তৃপক্ষ রাজি হচ্ছে না, তখন ওয়াশিংটনের প্রতি আঙ্কারার আস্থার সংকট চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। অন্যদিকে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সময় এরদোগানের পাশে রাশিয়ার দাঁড়ানো ক্রেমলিনের প্রতি আঙ্কারাকে ঝুঁকতে উৎসাহ জুগিয়েছে। এছাড়া সিরিয়ায় কুর্দিদের পেন্টাগনের অব্যাহত অস্ত্র সরবরাহ তুরস্ককে ক্ষুব্ধ করছে। স্বাধীনতাকামী কুর্দিদের সঙ্গে এরদোগান সরকার দেশের ভেতরে রীতিমতো যুদ্ধে লিপ্ত। সীমান্তবর্তী সিরীয় কুর্দিদের প্রতি মার্কিন সমর্থন তুরস্কের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। তাই সিরিয়ায় মার্কিন নীতির বিপরীতে অবস্থান করা রাশিয়াকে বেছে নিতে হচ্ছে আঙ্কারার।
তা ছাড়া সৌদি আরবের রাশিয়ার প্রতি আগ্রহী হওয়ার প্রধান কারণ আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইরানের উত্থান এবং তেহরানের সঙ্গে মার্কিনিদের সম্প্রতিক নরম নীতি। এমনটাই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ গ্রিগোরি কোসাক। গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক টাইমসকে গ্রিগোরি বলেন, ওয়াশিংটন যেমন তেহরানের কাছে ঘেঁষছে, রিয়াদ চাচ্ছে ক্রেমলিনের নৈকট্য পেতে। এর মাধ্যমে আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারসাম্য আনতে চায় সৌদিরা। রিয়াদের ঘোর বিরোধিতা সত্ত্বেও ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে নানা নিষেধাজ্ঞা-অবরোধ থেকে মুক্ত হওয়া ইরান নতুনভাবে শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করবে বলে শঙ্কা সৌদি আরবের। আর রাশিয়া সিরিয়াতে বাশারকে শঙ্কাহীন রাখতে যুদ্ধ পরিস্থিতির সমাপ্তি চায়। এজন্য সৌদিসহ অন্য শক্তিগুলোকে সঙ্গে পাওয়া প্রয়োজন। ফলে দুই পক্ষই নিজেদের স্বার্থে ঝুঁকছে একে অন্যের প্রতি। বাণিজ্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে দেশ দুটিকে কাছে আনতে।
সৌদি ও রাশিয়া বিশ্বের শীর্ষ দুই তেল উৎপাদনকারী দেশ। গত কয়েক বছরে তেলের দাম পড়তির কারণে দুই দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উৎপাদন সীমিত করে তেলের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ২০১৪ সালে সৌদি আরব ও রাশিয়ার উদ্যোগে একটি চুক্তি হয়েছিল। সফল সেই চুক্তি দেশ দুটিকে আরো কাছাকাছি করেছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের আঞ্চলিক দলগুলোর উদ্বেগ ছিল যে, সৌদি আরব, জর্দানসহ অন্যান্য উপসাগরীয় আরব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সিরিয়া ও ইরাকের কুর্দিদের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার বিষয়ে আপত্তি করবে না। কারণ যেকোনো মূল্যে ওই অঞ্চলে ইরানের হুমকি মোকাবিলা করতে চায় ওই দেশগুলো। অন্য দিকে ইরানের হুমকির চেয়েও দক্ষিণাঞ্চলীয় কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিষয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিল তুরস্ক। বিশ্বের সমালোচনা সত্ত্বেও কুর্দিরা স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট আয়োজন করার পর, যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।