রোহিঙ্গা সংকট শুরু হতেই জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশ একটা কথাই বলে আসছে যে, মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে সমস্যার সমাধান সম্ভব। কিন্তু ভিন্ন সুরে কথা বলছে মাত্র দুটি দেশ- চীন ও রাশিয়া। ভারত প্রথম দিকে মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বনকারী-এরূপ কিছু ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনের আশ্বাস দিয়েছে তারা। জাতিসংঘও মিয়ানমার সংকট নিয়ে কয়েকবার আলাপ করেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা বিষয়টি সাধারণ পরিষদে জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং দুইবার নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হয়েছে।
কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত কার্যকর করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। চীন ও রাশিয়া-যাদের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেওয়ার অধিকার আছে, তাদের কারণে সংকটের সমাধান যুক্তিসঙ্গতভাবে কার্যকর হচ্ছে না। চীন যে এই সংকটের সমাধান চায় না, তা নয়। তবে মিয়ানমারের ওপর চাপ বা বল প্রয়োগের বিরোধী তারা।
জাতিসংঘের কার্যকর ইনস্ট্রুমেন্ট হচ্ছে-নিরাপত্তা পরিষদ। নিরাপত্তা পরিষদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলেও তা অনেক সময় কার্যকর হয় না। আর যদি সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পরিবেশ না থাকে, তবে কোনো আন্তর্জাতিক সংকট সমাধান সম্ভবও নয়। সিদ্ধান্ত হলেও অনেক সময় তা কার্যকর হয় না। উদাহরণ স্বরূপ- প্যালেস্টাইনের ব্যাপারে ইসরায়েলের বিরোধিতার কারণে তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। তবে এ কথাও ঠিক, নিরাপত্তা পরিষদ হচ্ছে জাতিসংঘের প্রকৃত অর্থেই অপারেটর। যে পাঁচটি দেশের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা আছে (যদিও নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য সংখ্যা ১৫ জন), তারাই তাদের স্বার্থ প্রশ্ন বিবেচনায় নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে কি না তা নির্ধারণ করে থাকে। অনেক সময় ভেটো প্রয়োগকারী দেশসমূহ এরূপ যুক্তি দেখিয়ে ভেটো প্রয়োগ করে যে, নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত কোনো দেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পূর্বে পারস্পরিক বিরোধ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে মেটাবার চেষ্টা করা উচিত।
রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে এটাই ঘটেছে। চীন বলেনি যে, মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে হবে না। তবে ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়াটা দু’দেশের সমঝোতা ভিত্তিক হতে হবে। এরূপ প্রস্তাব অযৌক্তিক নয়। তবে যে দেশের গণতন্ত্র সঠিকভাবে কার্যকর হয়নি সুদীর্ঘ দিন, সামরিক শাসকরা জনগণের ইচ্ছার তোয়াক্কা না করে তাদের মতো করে দেশ শাসন করছে এবং নোবেল বিজয়ীকে নামেমাত্র ‘টাইটুলার হেড’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সামরিক বাহিনীর সিদ্ধান্তের বাইরে যে দেশের ক্ষমতাসীন সংসদে জনগণের পক্ষে কোনো আইন প্রয়োগ সম্ভব নয় এবং যে সংকটটি মিয়ানমার সামরিক বাহিনী কর্তৃক সৃষ্ট, সেখানে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান সম্ভব কি?
বিগত আড়াই মাসে মিয়ানমারের ওপর কম চাপ প্রয়োগ করা হয়নি। নোবেল বিজয়ী সু চিকে প্রদত্ত সম্মাননা ও ডিগ্রি প্রত্যাহার করা হয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অং সান সু চির মূর্তি অপসারণ করা হয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে বলা হচ্ছে অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতন বন্ধ করার জন্য। কিন্তু তারা কোনো কথায়ই কর্ণপাত করছে না। অতীতে যেমন কয়েক দশক ধরে প্রায় গোটা বিশ্ব হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজস্ব সম্পদের বদৌলতে মিয়ানমার সকলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে, এখনো তাদের অবস্থান প্রায় অনুরূপ। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এখনকার মিয়ানমার ভূরাজনীতি ও অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাই দাবি উঠেছে অবরোধের।
তবে চীনের মতো মহাশক্তি যদি মিয়ানমারকে নৈতিক কার্যকর সমর্থন জানায় ও সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত রাখে, তাহলে পাশ্চাত্য দেশসমূহ কর্তৃক অবরোধ করা হলেও মিয়ানমার তা খুব বেশি গ্রাহ্য করবে বলে মনে হয় না। আর চীন যদি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায়, তাহলে বিশ্বের জঘন্য মানবতাবাদী অপরাধ করায় মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন থেকে বিরত থাকবে চীন। এরূপ সিদ্ধান্ত চীন যদি মিয়ানমারকে জানিয়ে দেয়, তাহলে মিয়ানমারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি বলতে গেলে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সম্ভব হবে না।
শুধু তাই নয়, চীন মিয়ানমারের যে বিশাল সম্পদ বিনিয়োগ করছে এবং যেভাবে মিয়ানমারের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করছে, সে ক্ষেত্রে চীন যদি একটু পিছুটান দেয় তাহলে মিয়ানমারের পক্ষে এই সংকট সমাধান না করে কোনো উপায় থাকবে না। পাশ্চাত্যের দুনিয়া রোহিঙ্গাদের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে এবং জাতিসংঘের অধিকাংশ দেশ সমর্থন জুগিয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাধানের যে পাঁচটি প্রস্তাব দিয়েছে, তা কার্যকর করলেই সমাধানের পথ খুলে যাবে। বাস্তবতা যখন এই যে, জাতিসংঘের সবাই একমত হয়েও নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা সম্ভব নয়। তখন চীনের পক্ষে নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দুটি দেশের বিশ্বের এক নির্যাতিত, নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা।
মানবতাবিরোধী অপরাধ এই প্রথম নয়। যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী আরাকান অঞ্চলে যে ধর্মীয় ও সামরিক নিপীড়ন চালানো হচ্ছে তার চির অবসান ঘটিয়ে এতদাঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে চীনকে অবশ্যই রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। যেকোনো দেশ তার স্বার্থ সচেতন হওয়া কোনো খারাপ কাজ নয়। তবে চীনের মতো একটা মহাশক্তি- যার বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব রয়েছে, সেই দেশটি সঠিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা হবে কী করে? মহাচীনের নেতৃত্বে অনেক বিচক্ষণ ব্যক্তি রয়েছে। আর যদি আন্তর্জাতিক রাজনীতির দর-কষাকষির ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা সংকট অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে ও পশ্চিমা দুনিয়ার সমর্থনকে কৌশলগত বলে বিবেচনায় নিলে চীন তার বিপরীতে অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তাহলে জাতিসংঘের পক্ষে এই সংকটের সমাধান দুরূহ হয়ে পড়তে পারে।
এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যথাযথই তার দায়িত্ব পালন করছে। ১০ লক্ষ রোহিঙ্গার জন্য শুধু আহার-বস্ত্রই নয়, শিক্ষা ও স্যানিটেশনের সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে। তারা দেশে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ তাদের সম্পূর্ণ দায়ভার বহন করছে। যদিও সংকটের পরিধি এতই গভীর যে, বাংলাদেশের পক্ষে বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই রোহিঙ্গাদের আশু বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনে চীন-মিয়ানমার সম্পর্কের ব্যাপারে যা বলা হলো, একইভাবে তা প্রযোজ্য ভারতের সম্পর্কেও। অস্ত্র বিক্রি ছাড়া রাশিয়ার আর কোনো বিশেষ স্বার্থ আছে বলে মনে হয় না। তবে বর্তমান বিশ্বে চীন, ভারত ও রাশিয়া যে অক্ষশক্তিতে কাজ করছে, সেখানে যেকোনো আন্তর্জাতিক ইস্যুতে এই তিনটি দেশের সহাবস্থান অপ্রাসঙ্গিক নয়।