কানাডিয়ান ১ হাজার ৩১৪ শিশুর টিভি দেখার অভ্যাস বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি সপ্তাহে এক ঘণ্টা বেশি টিভি দেখলে কোমরের মাপ এক মিলিমিটার করে বেড়ে যেতে পারে এবং পেশিশক্তি কমতে পারে। যুক্তরাজ্যের ‘বায়োমেড সেন্ট্রাল জার্নালে’ গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে শিশুদের দিনে দুই ঘণ্টার বেশি টিভি না দেখার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা।
তারা আরও জানান, গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা গড়ে সপ্তাহে ৮ দশমিক ৮ ঘণ্টা টিভি দেখে। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, সাড়ে ৪ বছরের ১৫ শতাংশ শিশু সপ্তাহে ১৮ ঘণ্টার বেশি টিভি দেখে। এর প্রভাব সম্পর্কে বলা হয়, এ অভ্যাসের কারণে ১০ বছর বয়সে এসব শিশুর কোমরের মাপ অতিরিক্ত ৭ দশমিক ৬ মিলিমিটার বেড়ে যেতে পারে। এতে শিশুদের স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা বেশি থাকে।
এ বিষয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, বাচ্চারা এভাবে টেলিভিশনে আসক্ত হয়ে পড়লে ভবিষ্যৎ জীবনে এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, টেলিভিশন ছাড়াও বাচ্চারা কম্পিউটার গেমস খেলায় অধিক সময় ব্যয় করে। যতটুকু সময় টেলিভিশন বা কম্পিউটারের পেছনে ব্যয় করা উচিত তার চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বেশি সময় তারা ব্যয় করছে। এমনকি বাচ্চাদের দেখাশোনা করা হয় এমন সব স্থানেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেলিভিশন দেখে বাচ্চারা। বাচ্চাদের অভিভাবকদেরও এ ব্যাপারে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
যুক্তরাজ্যের ফিমেলফার্স্ট সাময়িকীতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছেÑ শারীরিকভাবে দুর্বল যেসব শিশু দিনে দুই ঘণ্টা বা তার চেয়ে বেশি সময় টিভি বা কম্পিউটারের মনিটরের সামনে কাটায়, তাদের উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা অন্যদের তুলনায় প্রায় ৩ দশমিক ৪ গুণ। ৮ থেকে ১০ বছরের ৬৩০টি শিশুর অংশ নেওয়া এ গবেষণায় শিশুদের শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, দুর্বলতা ও আলসেমির সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। শিশুদের এমনভাবে বাছাই করা হয়েছে, এদের বাবা-মায়ের মধ্যে অন্তত একজনের মুটিয়ে যাওয়ার সমস্যা আছে।
প্রথমেই শিশুদের টেলিভিশন দেখার অভ্যাস, কম্পিউটারে বসা বা কাজ করা, ভিডিও গেম খেলা এবং পড়াশোনা ও খেলাধুলার অভ্যাসের বিশদ বিবরণ সংগ্রহ করা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ এবং অন্যান্য হৃদরোগের আশঙ্কা এড়ানোর জন্য শিশুদের শারীরিকভাবে সক্রিয় রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এই গবেষণা প্রতিবেদনে। মাসজেনারেল হসপিটাল ফর চিলড্রেন (এমজিএইচএফসি) এবং হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের (এইচএসপিএইচ) গবেষকরা বিগত কয়েক বছর ধরেই শিশুদের টেলিভিশন দেখা ঘুমের ওপর কী প্রভাব ফেলে তা নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। তারা বলেছেন, শিশুদের ক্ষেত্রে যত বেশি টেলিভিশন, তত কম ঘুম। এটি বাবা-মায়েদের জন্য একটি সতর্কবার্তা।
গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, প্রতি ঘণ্টা বেশি টেলিভিশন দেখার কারণে স্বাভাবিক ঘুম সাত মিনিট করে কমে যায় বলে। পাশাপাশি যে কক্ষে টেলিভিশন থাকে সেখানে টেলিভিশন বন্ধ থাকলেও শিশুদের ঘুম কম হয় বলে গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। ছয় মাস থেকে আট বছর বয়েসী ১ হাজার ৮শ’র বেশি শিশুর ওপর পরিচালিত এ গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেন, টেলিভিশন দেখার সময় বাড়তে থাকলে শিশুদের ঘুমের মাত্রা কমতে থাকে।
আবার ব্রিটিশ গবেষণায় দেখা গেছে, ১২ থেকে ১৫ বছরের ছেলেমেয়েরা ব্রিটেনে দিনে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত টেলিভিশন দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। টেলিভিশনের প্রতি বাচ্চাদের অতিরিক্ত আসক্তি মাদকাসক্তের মতোই ক্ষতিকারক বলে দাবি করছেন গবেষকরা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাদকসক্তদের মস্তিষ্কে যে ধরনের ক্ষতি বা পরিবর্তন দেখা যায়, বাচ্চারা অতিরিক্ত টেলিভিশন দেখার ফলে তাদের মস্তিষ্কে অনুরূপ পরিবর্তন দেখা দেয়। এ গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন যিনি সেই ড. এরিক সিগম্যান সাবধান করে দিয়ে বলেন, এখনই ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যৎ বংশধররা শারীরিক ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে না। হৃদরোগ বিষয়ে আমেরিকার সাময়িকীতে প্রকাশিত- অস্ট্রেলিয়ার ‘ওয়েস্টমিড মিলেনিয়াম ইনস্টিটিউট’-এর সেন্টার ফর ভিশন রিসার্চে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, সিডনির ৩৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় দেড় হাজার শিশুর ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, যাদের সবার বয়স ছয় থেকে সাত বছর তারা গড়ে প্রতিদিন প্রায় দুই ঘণ্টা করে টিভি দেখেছে। কেউ প্রতিদিন গড়ে ৩৬ মিনিট করে শারীরিক পরিশ্রম করেছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, যারা এক ঘণ্টার বেশি পরিশ্রম করেছে তারা, যারা এক ঘণ্টার কম পরিশ্রম করেছে তাদের চেয়ে সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপন করছে। গবেষক দলের প্রধান ড. বামিনি গোপীনাথ বলেছেন, বাবা-মায়ের উচিত তাদের সন্তানকে বেশি বেশি খেলাধুলায় উৎসাহিত করা। টিভি বেশি দেখায় শিশুদের চোখের পেছনের ধমনিগুলো সরু হয়ে যায়। টিভি বেশি দেখার মানে হলো কম পরিশ্রম আর অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া। ফলে শরীরের ওজন যায় বেড়ে যায়, যার পরিণতি হৃদরোগ আর উচ্চ রক্তচাপ। কারণ প্রতিদিন দুই ঘন্টা করে টিভি দেখার বদলে যদি এক ঘন্টা অনুশীলন করা যায়, তাহলে সেটা ভালো ফল দেবে। তাই মুক্ত খেলাধুলার প্রতি শিশুদের উৎসাহিত করতে হবে। এজন্য প্রতিটি স্কুলে সপ্তাহে দুই ঘণ্টা করে বাচ্চাদের শারীরিক পরিশ্রম করানো বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এখন বেশির ভাগ বাচ্চার মধ্যেই টিভিতে বিভিন্ন রকমের কার্টুন চ্যানেল দেখার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এর ফলে তারা ধীরে ধীরে সেসব কার্টুন চরিত্রের মতো নিজেদের তৈরির চেষ্টা করে। এই অভ্যাস খুব ক্ষতিকর। শিশুরা টেলিভিশন দেখে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করে। কিন্তু এই টেলিভিশনের প্রভাব শিশুদের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। ২ থেকে ৪ বছর বয়সী যেসব শিশু টেলিভিশন দেখে বেশি সময় কাটায়, ১০ বছর বয়সের মধ্যে তাদের কোমরের মাপ বেড়ে যেতে পারে। তাদের অস্বাভাবিকভাবে মোটা হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
অতিরিক্ত টিভি দেখার ফলে-হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস নামের অসুখগুলো আপনার সন্তানের পরবর্তী জীবনের পরিণতি হিসেবে অপেক্ষা করছে। গবেষণা বলছে, দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের টিভি দেখা একেবারেই ঠিক নয়। দুই বছরের বেশি বয়সীদের দিনে দুই ঘণ্টার বেশি টিভি দেখা ঠিক নয়। যেসব শিশু বেশি টিভি দেখে তারা ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট ডিসঅর্ডার’ বা অমনোযোগিতার সমস্যায় বেশি ভোগে।
সন্তানদের জন্য এখন আমাদের করণীয় হলো-শিশুদের নিরাপদ এবং ভালো যুক্তি দিয়ে নৈতিক বোধটাকে চাঙ্গা করা প্রয়োজন। সন্তান ৪ ঘণ্টা টিভি দেখলে সপ্তাহে সে টিভি দেখে ২৮ ঘণ্টা। কাজেই বিকল্প আকর্ষণীয় ব্যবস্থা করে সময়টা কমিয়ে আনতে হবে। টিভি দেখা বা ভিডিও গেমস খেলার ক্ষেত্রে সময়সীমা ও কিছু নিয়ম বেঁধে দিতে পারেন। পারিবারিক পরিবেশে একসঙ্গে বসে সবাই টিভি নাটক, সিনেমা ও অন্যান্য অনুষ্ঠান দেখার রীতি চালু করতে হবে। সন্তান কোন ধরনের প্রোগ্রাম দেখছে তা বাবা-মায়েরও দেখা উচিত। তাকে পরে বোঝাতে হবে এর ভালো-মন্দ দিকগুলো।
সন্তানকে পারিবারিক ও সামাজিক বিনোদনের সঙ্গে যুক্ত করুন। যেমন-গল্পের আড্ডা, পড়াশোনার আলোচনা, অভিজ্ঞতা আলোচনা, ভ্রমণকাহিনি, ছোটবেলার গল্প, গ্রামের গল্প, পরিবারের ইতিহাস-ঐতিহ্য, দাদু-নানুদের গল্প ইত্যাদি। সন্তানকে নিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় বেড়ানো, সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ, দর্শনীয় স্থান দেখানো, তাদের উপহার দেওয়া। খেলার সুযোগ করে দেওয়া, মাঠ না থাকলে খোলা জায়গায় মাঝে মাঝে নিয়ে যাওয়া, হাঁটতে নিয়ে যাওয়া, ছাদে যাওয়া এবং বাসায় পরিবারের সদস্যরা মিলে কোনো খেলায় মেতে থাকা। সন্তানকে গ্রামে নিয়ে যাওয়া দরকার। তাকে সাঁতার শেখানো, গাছে চড়া শেখানো উচিত। বই পড়া, ছবি আঁকা, যেসব বিষয়ে বাচ্চার আগ্রহ আছে, সেগুলোর প্রতি উৎসাহিত করা এবং পুরস্কৃত করা উচিত। মোটকথা খেয়াল রাখতে হবে, টিভি যেন কিছুতেই শিশুদের একমাত্র বিনোদন না হয়।
|