নৈতিকতা বা মূল্যবোধের অবক্ষয় বর্তমানে আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। মানুষ সামাজিক জীব। ব্যক্তির যেমন চাহিদা আছে, তেমনি সমাজেরও আছে। মানুষের কাছ থেকে সমাজ সব সময় সামাজিক আচরণ প্রত্যাশা করে। প্রত্যেক সমাজে তার সদস্যদের আচরণ পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি থাকে। নীতিহীন সমাজ হয় উচ্ছৃঙ্খল, বিভ্রান্তিকর ও অনিশ্চিত। নৈতিকতা মূল্যবোধের অবক্ষয়ে মানুষের মধ্যে আসছে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। সমাজ ও পরিবারে বেজে উঠছে ভাঙনের সুর। নষ্ট হচ্ছে পবিত্র সম্পর্কগুলো। চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান হয়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। ফলে বেড়ে চলেছে আত্মহত্যাসহ অন্যান্য অপরাধপ্রবণতা। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবসহ সম্পর্কের এমন নির্ভেজাল জায়গাগুলোতে ফাটল ধরেছে। ঢুকে পড়েছে অবিশ্বাস। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্পর্কে সৃষ্টি হচ্ছে আস্থার সংকট।
নৈতিকতা শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন Moralitas শব্দ হতে। Moralitas অর্থ হলো ধরন, ভালো আচরণ। নৈতিকতা হলো এক ধরনের মানসিক অবস্থা যা কাউকে অপরের মঙ্গল কামনা করতে এবং সমাজের প্রেক্ষিতে ভালো কাজের অনুপ্রেরণা দেয়। যেমন সত্য বলা, গুরুজনকে মান্য করা, অসহায়কে সাহায্য করা, চুরি, দুর্নীতি থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি। এগুলো মানুষের নৈতিকতার বহির্প্রকাশ। সমাজবিজ্ঞানী জনাথন হ্যাইট বলেন, ‘ধর্ম, ঐতিহ্য ও মানব আচরণ’-এ তিনটি হতে নৈতিকতার উদ্ভব ঘটে। মূল্যবোধ হচ্ছে মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী ধারণা বা আদর্শ। সামাজিকভাবে বাস করতে গিয়ে মানুষ কিছু আদর্শ বা মানদণ্ড সাধারণভাবে গ্রহণ করে নেয়। সমাজে মানুষের যা কিছু করা উচিত, তারা যা কিছু মঙ্গলজনক মনে করে তার আদর্শ রূপই হচ্ছে মূল্যবোধ।
সাম্প্রতিক সময়ের শিশুহত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, সন্ত্রাস, নকলপ্রবণতা, খাদ্যে ভেজাল, নকল ওষুধ ইত্যাদি সমাজের করুণ রূপ। সমাজের মানুষ কেউ কারো বন্ধু নয়। প্রত্যেকে পরোক্ষভাবে একে-অপরের ক্ষতিসাধনে মগ্ন। সামান্য মুঠোফোন চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে বয়োবৃদ্ধ থেকে শিশু-কিশোরকে পিটিয়ে বা গায়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। গত ২৭ অক্টোবর নরসিংদীতে সামান্য মুঠোফোন চুরির অভিযোগে এক কিশোরী স্কুলছাত্রীকে পরিকল্পিতভাবে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড নিহত কিশোরীর চাচি। হত্যাকাণ্ডে জড়িত চারজনকে শনাক্ত করতে পেরেছে পুলিশ। হত্যাকারী চারজনের মধ্যে দুজন মাস্টারমাইন্ড নিহতের চাচির ভাই। অপর দুজন চাচির ভাইয়ের পরিচিত। যদিও শিশু, কিশোর বা কিশোরীদের নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। কোমলমতি শিশু, কিশোর ও কিশোরীরা শারীরিক-মানসিক এমনকি যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
এছাড়াও তরুণী ঐশী কর্তৃক নিজ পিতা-মাতাকে হত্যা, সাংবাদিক দম্পতি সাগর রুনি হত্যাকাণ্ড ও পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের স্ত্রী মাহমুদা হত্যাকাণ্ড সমাজকে চরমভাবে ভাবিয়ে তুলছে। যা সামাজিক অবক্ষয়ের খণ্ড, খণ্ড চিত্র। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর চরম আঘাত। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ক্রান্তিলগ্নে সমাজরক্ষা নিয়ে চিন্তিত দেশের সব বিবেকবান মানুষ। যথার্থ জীবন আদর্শের অভাবে পরিবারগুলো এখন ভোগবিলাস ও পরশ্রীকাতর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা ও ধনবাদী ধ্যান-ধারণায় গড়ে উঠেছে ভারসাম্যহীন সমাজ। আমাদের আজকের সমাজ পরিচালিত হচ্ছে নৈতিকতার ভিত্তিতে নয়, বরং স্বার্থের মোহে।
নীতিহীন সমাজ হয় উচ্ছৃঙ্খল, বিভ্রান্তিকর ও অনিশ্চিত। নৈতিকতা মূল্যবোধের অবক্ষয়ে মানুষের মধ্যে আসছে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। সমাজ ও পরিবারে বেজে উঠছে ভাঙনের সুর। নষ্ট হচ্ছে পবিত্র সম্পর্কগুলো
তদুপরি বর্তমান বিশ্বে মানুষের সঙ্গে মানুষের অসম প্রতিযোগিতা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে মানুষে মানুষে দূরত্ব। ব্যক্তিজীবনে কমে আসছে ধৈর্যশীলতা। নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কিংবা রাতারাতি বড়লোক হওয়ার লোভও বিরাজ করছে মাত্রাতিরিক্ত। দেশ, জাতি, সমাজ, পরিবার ক্রমেই ধাবিত হচ্ছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। একজন মানুষের চরম নৈতিক মূল্যবোধের ধাক্কায় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে অন্য মানুষ। তৈরি হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়। এক কথায় দিন দিন মানুষের মানসিক বিকৃতি বাড়ছে। হতাশা বা অস্থিরতা বিরাজ করছে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে বেঁচে থাকার প্রতিটি ধাপে। মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে মানুষ পাশবিক হয়ে উঠছে।
সামাজিক অবক্ষয় দিন দিন চরম আকার ধারণ করছে। এমন কোনো অপরাধ নেই, যা সমাজে সংঘটিত হচ্ছে না। স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে, মা-বাবা নিজ সন্তানকে, ভাই ভাইকে অবলীলায় হত্যা করছে। সমাজে সুষ্ঠু বিচার না পেয়ে বাবা-মেয়ে, মা-মেয়ে চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। প্রেমের কারণে অর্থ সম্পত্তির লোভে সমাজে এসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অন্যদিকে হতাশা, নিঃসঙ্গতা, অবিশ্বাস আর অপ্রাপ্তিতে সমাজে আত্মহননের ঘটনাও বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। মাদকের অর্থ জোগাড় করতে না পেরে ছেলে খুন করছে বাবা মাকে, স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে।
অন্যের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য কিংবা কাউকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার নিমিত্তে মানুষ নিজের সন্তানকে পর্যন্ত হত্যা করছে। আর যৌতুকের কারণে নির্যাতন ও হত্যা তো নিত্যদিনের ব্যাপার। পারিবারিক বন্ধন, স্নেহ-ভালোবাসা, মায়ামমতা, আত্মার টান সবই যেন আজ স্বার্থ আর লোভের কাছে তুচ্ছ। কেবল তাই নয়, সমাজের উচ্চবিত্তের তরুণরা বিপথগামী হয়ে পড়েছে। তারা জড়িয়ে পড়ছে খুন, ধর্ষণ ও মাদকাসক্তিসহ নানা অপরাধে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খানের মতে, যে সন্তানরা তাদের মা-বাবাকে হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে কিংবা যে অভিভাবকরা তাদের সন্তান হত্যা করছে, তাদের অনেকেই আর্থিক কারণে এ ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে অভিভাবকরা পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পারিবারিক কলহ থেকে সন্তানকে হত্যা করছে। এ ক্ষেত্রে অবৈধ সম্পর্ক চালিয়ে নিতে হত্যাকারী কোনো বাধা পেলেই ক্রোধের বশবর্তী হয়ে হত্যার মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অনৈতিক লোভ, প্রতিযোগিতা, পরচর্চা ও পরকীয়ার কারণেই পারিবারিক এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে।
মূলকথা, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষ দিন দিন প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠছে। নিজের একক কর্তৃত্ব ও জিদকে প্রাধান্য দিয়ে মানুষ প্রিয়জনকে হত্যার মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হচ্ছে। মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া বিষণ্নতা ও মাদকাসক্তি সমাজের এই ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডগুলোর জন্ম দিচ্ছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের এক ধরনের মানসিক বিকৃতির লক্ষণ। সচেতনতা ছাড়া সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধ দূর করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি যেকোনো অপরাধ বিশেষ করে শিশু, কিশোর বা কিশোরীদের নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এই অস্থির, নিয়ন্ত্রণহীন বিরূপ সমাজব্যবস্থার দায় কারো একার নয়, বরং সব নাগরিকের। প্রত্যেককে ভূমিকা পালন করতে হবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায়, সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং সামাজিক অবক্ষয় রোধে। সপ্তদশ শতকের দার্শনিক হব্স হলেন Civil society বা নাগরিক সমাজ ধারণার প্রবর্তক। এ ধারণার সমর্থনকারীরা হলেন সভ্যসমাজের সমর্থক। তাদেরকেই ভূমিকা নিতে হবে দেশের কল্যাণে। তাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে যথার্থ দেশপ্রেমিক নাগরিক গড়ে তোলার; রাষ্ট্রকে জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার; সমাজে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার; সমাজের সংকটময় মুহূর্তে জনগণের পাশে দাঁড়ানোর; সমাজের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করার বিষয়ে।
শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্প ও প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বসভ্যতা। আধুনিক সভ্যতার দৌড়ে হারিয়ে যাচ্ছে প্রচলিত নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। ক্রমশই বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা এবং ছিন্ন হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক। অস্থির হয়ে উঠছে সমগ্র সমাজব্যবস্থা। বর্তমানে চলছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়। এই প্রেক্ষাপটে পরিবার-সমাজ, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও চিন্তা-চেতনায় বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আস্থা ও বিশ্বাস প্রায় শূন্যের কোঠায়। পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সমাজকে সক্রিয় হতে হবে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে জাগ্রত করতে হবে সমাজকে। সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য প্রয়োজন সামাজিক স্থিতিশীলতা। প্রয়োজন নৈতিকতা, মূল্যবোধের চর্চা ও বিকাশ সাধন। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের উপাদান তথা সততা, কর্তব্য, ধৈর্য, শিষ্টাচার, উদারতা, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, দেশপ্রেম, পারস্পরিক মমত্ববোধ, সহমর্মিতা, আত্মত্যাগ ইত্যাদি মানবীয় গুণের চর্চা বর্তমান সমাজে নেই। সমাজ চলছে বিপরীত স্রোতের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতি বা সুবিচার না হওয়ার কারণে কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অপরাধীরা দিন দিন যেন আরো সাহসী হয়ে উঠছে। এটাও অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
তাই এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে একযোগে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে যথার্থ ভূমিকা পালন করে যেতে হবে। তবে এ কথা সত্য, কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের পক্ষেই নৈতিকতা ও মূল্যাবোধের অবক্ষয় থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসা সম্ভম নয়। কেননা, সমাজ বা রাষ্ট্রে নানা বিশ্বাসের লোক বাস করে, এদের একজনের চরিত্র অন্যজনের সঙ্গে মেলে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তাই সর্বাগ্রে পরিবারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
|