দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কার, যৌতুক, যৌননির্যাতন, অ্যাসিড নিক্ষেপ, ইভটিজিংয়ের ভয়সহ নানা কারণে বাল্যবিবাহ বাংলাদেশে মহামারী আকার ধারণ করেছে। বিয়ের ন্যূনতম বয়স মেয়েদের ১৮ ও ছেলেদের ২১ নির্ধারণ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার বিশ্বে চতুর্থ। এ ক্ষেত্রে নাইজার, মধ্য-আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র ও চাদের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। বর্তমানে বাংলাদেশে তিন কোটি কিশোর-কিশোরী আছে, যার মধ্যে প্রায় দেড় কোটি মেয়ে। পরিসংখ্যান বলছে, লেখাপড়া শেষ করার আগেই ১৩ থেকে ১৪ বছর বয়সী মেয়েদের প্রায় ৪০ শতাংশ শিশুকে বাল্যবিবাহের জন্য পিঁড়িতে বসতে হয়।
বাল্যবিবাহের খেসারত ছেলেমেয়ে সবাইকে দিতে হলেও মেয়েদের জীবনে এর কুফলের পরিধি ও মাত্রা ভয়াবহ। বাল্যবিবাহের মধ্য দিয়ে একজন মেয়ে শিশু বা কিশোরীকে এক ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্দশাগ্রস্ত দাম্পত্য জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। জীবন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ এসব মেয়ে স্বামীর সংসারে নানাভাবে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয়। এমনকি অল্পবয়স্ক এসব মেয়েই সবচেয়ে বেশি মাতৃমৃত্যুর শিকার হয়। এক পর্যায়ে তাদের শিক্ষা ও দক্ষতা লাভের সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। জীবন সংগ্রামেও পিছিয়ে পড়ে তারা। বড় হওয়ার স্বপ্ন মিশে যায় মাটির সঙ্গে। এর ফলে দক্ষ কর্মী থেকে বঞ্চিত হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র।
দেশের কিশোরীদের শতকরা ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই অপুষ্টির শিকার। বিয়ের পরই স্বামী ও অন্য আত্মীয়স্বজন সন্তানের মুখ দেখতে চান। এক বা দুই বছরে মধ্যে সন্তান না হলে, স্বামী বংশ রক্ষার অজুহাতে আবার বিয়ে করে ফেলতে পারেন। এজন্য মেয়ের বাড়ি থেকেও সন্তান নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু এই অপুষ্টির শিকার অল্পবয়সী মায়েরা কম ওজনের সন্তানের জন্ম দেয়। অনেক সময় নবজাতক মারা যায়। মারা না গেলেও মা ও সন্তানের অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে। এতে চিকিৎসার ব্যয়ভার বেড়ে যায়, যে কারণে সংসারে অশান্তি লেগেই থাকে।
ইউনিসেফ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মেয়েদের বাল্যবিবাহের কারণে বছরে দুই লাখ শিশুর জন্ম হয় স্বল্প ওজন ও মারাত্মক অপুষ্টি নিয়ে। মায়েরও স্বাস্থ্যহানি ঘটে। গর্ভধারণ সংক্রান্ত জটিলতায় বাংলাদেশে বছরে প্রতি হাজারে পাঁচজন মা মারা যান। অথচ এই হার জাপানে প্রতি লাখে একজন। এছাড়া আমাদের দেশে জন্মের সময় প্রতি হাজারে ৯০ শিশু মারা যায় ও এক মাস বয়সী শিশু মারা যায় ৭০ জন। অল্প বয়সে বিয়ে ও মা হওয়ার বড় ঝুঁকি হলো জরায়ু ছিঁড়ে যাওয়াসহ জরায়ুতে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা। বাল্যবিবাহ মেয়েদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যেরও হানি ঘটায়।
নারী-পুরুষের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স যথাক্রমে ১৮ বছর এবং ২১ বছর নির্ধারণসহ প্রয়োজনীয় বিধান করে জাতীয় সংসদে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনে, স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা এবং স্থানীয় পর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করার বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা মহিলা ও শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা, উপজেলা প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি কোনো ব্যক্তির লিখিত বা মৌখিক আবেদন অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে বাল্যবিবাহের সংবাদ পেলে তিনি ওই বিয়ে বন্ধ করবেন।
অথবা বিধিমালা দ্বারা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন। স্ব-উদ্যোগে বা কোনো অভিযোগের ভিত্তিতে অথবা অন্যকোনো মাধ্যমে তথ্যের ভিত্তিতে নিশ্চিত হয়ে আদালত কোনো বাল্যবিবাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবেন। আদালতের নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গকারীকে ছয় মাসের কারাদন্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত এবং অনাদায়ে আরো এক মাসের কারাদন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের ২০১৬ সালের জরিপ অনুসারে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ হয় রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলায়। জেলা দুটিতে বাল্যবিবাহের হার যথাক্রমে শতকরা ৯১ ও ৯০ ভাগ। এক সময়ের মঙ্গাকবলিত এই জনপদ এখন বাল্যবিবাহের মতো মারাত্মক সমস্যায় জর্জরিত। বাল্যবিবাহ বন্ধে রংপুরে শুরু হয়েছে মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রথমে সরকারিভাবে কুড়িগ্রামে পাইলট প্রকল্প আকারে এই কাজ শুরু হয় ও পরে চারটি জেলাকে এ প্রকল্পের আওতায় আনা হয়। এই অঞ্চলে এখন যে কেউ বিয়ে করতে গেলে, যারা বিয়ে পড়াবেন বা বিয়ে নিবন্ধন করবেন তারা প্রথমে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পাত্র-পাত্রীর বয়স যাচাই করে নেবেন। এটি বাধ্যতামূলক। এর জন্য মুঠোফোনে *১৬১০০# নাম্বারে ডায়াল করলেই বয়স যাচাইয়ের একটি অপশন দেওয়া হয়। সেখানে জন্ম নিবন্ধন সনদ, শিক্ষাসনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম্বার দিলেই চলে আসবে পাত্র-পাত্রীর সঠিক বয়স। যদি কারো জন্ম নিবন্ধনটি ভুল হয়, সেই ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়বে ভুয়া জন্ম নিবন্ধনকারী।
পপুলেশন কাউন্সিল নামের অন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি জরিপ থেকে জানা যায়, বগুড়া ও জামালপুরে ৫৪ শতাংশ ক্ষেত্রে ১৬ বছর বয়সের আগে মেয়েদের বিয়ে হলে যৌতুক হিসেবে পাত্রপক্ষকে দিতে হয় ৫০ হাজার টাকা। কনের বয়স ১৬ থেকে ১৭ হলে যৌতুকের টাকার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ হাজার টাকা এবং কনের বয়স ১৮ থেকে ১৯ হলে যৌতুকের বেড়ে হয় ১ লাখ টাকা। এতে দেখা যায়, বাল্যবিবাহের সঙ্গে যৌতুকের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া ওই জেলা দুটোর অভিভাবকরা মেয়েকে যৌন নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে এবং সামাজিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কম বয়সে বিয়ে দেন। জরিপ থেকে আরো জানা যায়, দুই জেলার বাল্যবিবাহের কারণে ৬১ শতাংশ মেয়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে।
বিয়ের আসরে বাল্যবিবাহ বন্ধ করলে বর-কনে উভয়পক্ষই সামাজিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তাই বিয়ের দিন নয়, আগেই করতে হবে সচেতনÑ এ স্লোগানকে সামনে রেখে বাল্যবিবাহমুক্ত ত্রিশাল গড়ার লক্ষ্যে স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ব্রিগেড। এ ব্রিগেডের সদস্যরা তাদের সহপাঠীদের বাল্যবিবাহের ব্যাপারে সচেতন করার পাশাপাশি বিয়ের দিন নির্ধারিত হওয়ার আগেই পরিবারকে সচেতন করবে। তাদের যাতায়াতের জন্য দেওয়া হয়েছে সাইকেল, নির্দিষ্ট পোশাক। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য তত্ত্বাবধান করবেন। নিরাপত্তা ও সার্বক্ষণিক তদারকির দায়িত্ব পালন করবেন জেলা প্রশাসক নিজে।
সম্প্রতি উপজেলার ধলা স্কুল মাঠে সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ব্রিগেড গঠনের শুভ উদ্বোধন করেন ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক খলিলুর রহমান। তারপর ধলা স্কুলের ১২ শিক্ষার্থীকে প্রাথমিক পর্যায়ে ১২টি বাইসাইকেল, নির্দিষ্ট পোশাক ও কাপড়সহ তাদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। ব্রিগেড সদস্যরা তাদের সহপাঠীদের মাধ্যমে খোঁজ রাখবে কোথায় বিয়ে হচ্ছে? উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে বিয়ে বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। প্রতিমাসে ব্রিগেড সদস্যদের ট্রেনিং করানো হবে এবং উপজেলা থেকে একটি হটলাইনের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক তদারকি করা হবে।
প্রাথমিক পর্যায়ে একটি ইউনিয়নে এই কার্যক্রম চালু করা হলেও পরবর্তীতে সব উপজেলায় ব্রিগেড গঠন করা হবে। ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু জাফর রিপন এ ব্রিগেড সৃষ্টির উদ্যোক্তা। এ ব্রিগেডের আওতায় ১২টি ইউনিয়নের ২৪টি স্কুলে ২৮৮ ছাত্রীকে একই রকমের বাইসাইকেল ও লগোখচিত ড্রেস দেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নে বাল্যবিবাহের কোনো খবর পেলেই তারা সেখানে পৌঁছে যাবে। এতে সচেতনতা গড়ে উঠবে এবং বাল্যবিবাহ ও যৌন হয়রানি কমবে।
ব্রিগেডের সদস্যদের বাল্যবিবাহ আইন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। উপজেলা প্রশাসন থেকে দেওয়া একটি হট লাইন নাম্বার তাদের কাছে সংরক্ষিত থাকবে, যা ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে। এ নাম্বারটি উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নিয়ন্ত্রণ করবেন। তাদের কাছে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নাম্বার থাকবে। ব্রিগেডের ছাত্রীদের নিরাপত্তা ও সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নেওয়ার জন্য একজন শিক্ষক দায়িত্ব পালন করবেন। ২৮৮ ছাত্রী প্রতি দুই মাসে একবার উপজেলার কোনো বড় মাঠে একত্রিত হবে। এতে করে গোটা উপজেলাবাসীকে বাল্যবিবাহ ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা দেওয়া সম্ভব হবে।
|