বাহাত্তর বছর পেরিয়ে এলো বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গঠিত হওয়া এই সংস্থাটির যাত্রাপথ যে মোটেও সুগম হয়নি বিগত বাহাত্তর বছরের ইতিহাস তারই সাক্ষ্য বহন করছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব শান্তির অন্বেষায় ‘লিগ অব নেশন্স’ নামে যে সংস্থা গঠিত হয়েছিল সেটির দুঃখজনক ব্যর্থতার পরিণামে বিশ্বের বুকে নেমে এসেছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহ অভিশাপ। এই যুদ্ধের অবসানে আবারও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ উদ্যোগী হয়ে গঠন করেছিলেন নতুন সংস্থা ‘জাতিসংঘ’। লক্ষ্য একটাই—বিশ্বশান্তি, পৃথিবী থেকে আর কোনো যুদ্ধের সম্ভাবনা দূর করা।
হিংসায় উন্মত্ত এ পৃথিবীতে শান্তির সন্ধান কি মানুষ পেয়েছে? এই লক্ষ্যে বাহাত্তর বছরে কত দূর এগোতে পেরেছে জাতিসংঘ? আর একটি বিশ্বযুদ্ধের সর্বনাশা তাণ্ডব মানবজাতির ওপর নেমে না এলেও সার্বিক অর্থে পৃথিবী কি যুদ্ধের দামামা থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছে? পারমাণবিক শক্তিধরদের পারস্পরিক হুমকি-ধামকি কি বিশ্ববাসীকে স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে? অঞ্চলভিত্তিক যুদ্ধগুলোতে কি শান্তির ললিতবাণী ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে না? সময় এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নগুলো ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে।
এ কথা বলাও বোধহয় অসমীচীন হবে না যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাফল্য এখন প্রশ্নবিদ্ধ। হতাশা পুঞ্জীভূত হয়েছে মানুষের মনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই পাঁচটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও চীনের মিলিত উদ্যোগে গঠিত এই বিশ্ব সংস্থার নাম জাতিসংঘ। এই নামকরণটি করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন ডি রুজভেল্ট। তার সঙ্গে একযোগে এ সংক্রান্ত সনদপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং ২৬ দেশের প্রতিনিধিরা। সময়টা ২৬ জুন ১৯৪৫ সাল।
এই সনদের ভিত্তিতে জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক অভ্যুদয় ঘটে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর। ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা দিবস। এই দিনটিকে উপলক্ষ করে প্রতিবছর আহূত হয় এই সংস্থার সাধারণ পরিষদের অধিবেশন। যেখানে সুযোগ থাকে প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দের ভাষণ দেওয়ার। এই উপলক্ষে প্রতিবছর জাতিসংঘে সমাবেশ ঘটে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানদের। জাতিসংঘ বিশ্বের দুই শতাধিক রাষ্ট্রের শান্তি, উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবেশ, মানবাধিকারসহ নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কাজ করে। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এটি আন্তর্জাতিক উচ্চতার এক অনন্য সংস্থা। বিশ্বের যেখানেই যুদ্ধবিগ্রহ, হিংসা, হানাহানি, দ্বন্দ্ব, সংঘাত সেখানেই জাতিসংঘের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় অভিভাবকের ভূমিকা। বৃহত্তর স্বার্থে এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে, বিরোধ-বিবাদ নিরসনে, শান্তি রক্ষায়, বিভিন্ন দেশে এইডস, জিকা ভাইরাসের মতো মারণব্যাধির বিরুদ্ধে প্রচারণা, অর্থ সহায়তা দেওয়া, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে।
১৯৪৫ সালের ১৫ এপ্রিল এ সংস্থার নীতিমালা তৈরির লক্ষ্যে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোতে মিলিত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সানফ্রান্সিসকোতে ৫০ জাতির প্রতিনিধিরা মিলিত হয়ে ৪৯ জন বিশ্বখ্যাত রোটারিয়ানের নেতৃত্বে জাতিসংঘের চার্টার নির্ধারণ করেন। ১৯৪৫ সালের ২৬ জুলাই ৫১টি দেশের স্বাক্ষরে চার্টার পাস হয়। এ চার্টারের ভিত্তিতে পৃথিবীতে স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ জন্মলাভ করে। জাতিসংঘের ৬টি মূল সংস্থা রয়েছে। এর মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদনক্রমে সাধারণ পরিষদের গোপন ভোটে জাতিসংঘের মহাসচিব নিযুক্ত হন। পাঁচ বছরের জন্য নিযুক্ত হন মহাসচিব। সুতরাং মহাসচিব জাতিসংঘের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। মহাসচিবকে বিশ্ব শান্তির অভিভাবকও বলা হয়।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত মহাসচিবরা হলেন নরওয়ের ট্রিগভেলি, সুইডেনের দাগ হ্যামারশোল্ড, মিয়ানমারের উ থান্ট, অস্ট্রিয়ার কুট ওয়াল্ডহাইম, পেরুর পেরেজ দ্য কুয়েলার, মিসরের বুট্রোস বুট্রোস ঘালি, ঘানার কফি আনান, দক্ষিণ কোরিয়ার বান কি মুন। বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দেন। ১৯৭৯-৮০ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৮৫-৮৬ সালে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ৬৯০০ জন শান্তিসেনা ৪২টি মিশনে কর্মরত। আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে বাংলাদেশ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন, পরিবেশ সুরক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন-এসব বিষয়ে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটে জাতিসংঘ বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলছে। বাংলাদেশে জাতিসংঘের ১১টি সংস্থা কাজ করছে। জাতিসংঘের অনেকগুলো কমিটিতে বাংলাদেশ যুক্ত রয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বিশ্বজুড়ে গরিবি হটাতে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ থেকে হাতে নিয়েছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা।
২০৩০ সালের লক্ষ্য এজেন্ডায় সবার ও সব দেশের জন্য প্রযোজ্য বেশ কয়েকটি লক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত, যেমন-সব ধরনের দারিদ্র্য দূর করা, ক্ষুধা দূর করা, সবার জন্য স্বাস্থ্যকর জীবন ও কল্যাণ নিশ্চিত করা, সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানসম্মত এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা, নারীদের সম-অধিকার এবং তাদের ও কন্যাশিশুদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা, সবার জন্য টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা ও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা, সবার জন্য সুলভ, নির্ভরযোগ্য, টেকসই ও আধুনিক জ্বালানি নিশ্চিত করা, সবার জন্য স্থায়ী, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থনৈতিক কার্যক্রম উৎসাহিত, পরিপূর্ণ ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং উপযুক্ত কর্মের নিশ্চয়তা প্রদান করা, স্থিতিশীল অবকাঠামো তৈরি, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই শিল্পায়ন ও উদ্ভাবন উৎসাহিত করা, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বৈষম্য কমিয়ে আনা, নগর ও জনবসতিগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ, স্থিতিশীল ও টেকসই করা, টেকসই উৎপাদন ও ভোগ নিশ্চিত করা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার বিরূপ প্রভাবের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা, পরিবেশ উন্নয়নে সাগর, মহাসাগর ও সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা, স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও টেকসই ব্যবহার, মরুকরণ প্রতিহত এবং ভূমির মানে অবনতি রোধ ও জীববৈচিত্র্যের রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা। টেকসই উন্নয়নে শান্তিপূর্ণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরি, সবার জন্য ন্যায়বিচারের সুযোগ এবং সর্বস্তরে কার্যকর, দায়বদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য বাস্তবায়নের পদ্ধতিগুলো শক্তিশালী ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব জোরদার করা। এসব লক্ষ্যের অধীনে রয়েছে সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট, সময়বদ্ধ ও পরিমাপযোগ্য ১৬৯টি টার্গেট। টার্গেট বাস্তবায়নে প্রয়োজন বিশ্বব্যাপী দক্ষ শ্রমশক্তি বা ডিপ্লোমা পেশাজীবী। জাতিসংঘ পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি রোধ, অস্ত্রসজ্জা হ্রাসে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে। যুদ্ধ, উত্তেজনা ও সহিংসতা বন্ধে জাতিসংঘ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যমূলক ভূমিকা পালন করছে।
বিশ্বে সব সদস্য রাষ্ট্রের উচিত জাতিসংঘকে শক্তিশালী করা এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের উন্নতিকল্পে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সাহায্য করা। এখানেই জাতিসংঘের সার্থকতা। এখানেই জাতিসংঘের ওপর সমস্যা কবলিত দেশগুলোর নির্ভরশীলতা। অনেক ব্যর্থতার মধ্যেও সবার মাথার ওপর দাঁড়িয়ে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করছে জাতিসংঘ। সমাধান সম্ভব হোক বা না হোক সমস্যা নিয়ে আর্জি জানাবার নির্ভরযোগ্য স্থান হিসেবে জাতিসংঘই সবার ভরসা। বহু ইতিবাচক পদক্ষেপ জাতিসংঘ ক্রমাগত নিয়ে চলেছে। আফ্রিকার জটিল সংঘাতবিক্ষুব্ধ দেশগুলোতে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠিয়ে একটা স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছে। এসব শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ব্যাপক, বলা হয়ে থাকে সর্বোচ্চ। এটাও ঠিক সাফল্যের পাশাপাশি জাতিসংঘের ব্যর্থতার পাল্লাও কম ভারি নয়। সার্বিকভাবে প্রবল চাপ সৃষ্টি করেও জাতিসংঘ যুক্তরাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করতে পারেনি এক তরফা ইরাক আক্রমণ থেকে। ইরাকের হাতে মানববিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে, এই অজুহাতে ইরাকে হামলা চালিয়ে প্রাচীন সভ্যতার এই দেশটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে শক্তিমান যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসিতে না ঝোলানো পর্যন্ত তারা ক্ষান্ত হয়নি। পরে প্রমাণ হয়েছে য়ুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ভিত্তিহীন। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল, যিনি নিরাপত্তা পরিষদে দাঁড়িয়ে জোর দিয়ে বলেছিলেন, ইরাকের হাতে মানববিধ্বংসী অস্ত্র থাকার ব্যাপারে তার হাতে তাদের গোয়েন্দা সংস্থার অকাট্য প্রমাণ রয়েছে, সেই তিনিই পরে বললেন, ইরাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ঠিক ছিল না। তাদের গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট ভুল ছিল। জাতিসংঘ থেকেও ইরাকে তাদের নিজস্ব বিশেষজ্ঞ পাঠিয়ে তদন্ত চালানো হয়েছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাস্তবতা হচ্ছে, এই অন্যায় হামলা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বিরত রাখতে পারেনি জাতিসংঘ। তবুও এ সত্যতা মানতেই হবে, জাতিসংঘই শান্তিকামী মানুষের ভরসাস্থল। লিগ অব নেশন্সের ব্যর্থতায় মাত্র পঁচিশ বছরের মধ্যে বিশ্বে দ্বিতীয় বিশ্বযদ্ধের যে দাবানল জ্বলে উঠেছিল দীর্ঘ বাহাত্তর বছরেও জাতিসংঘ তেমন পরিস্থিতিকে প্রতিরোধ করে রেখেছে এ কৃতিত্ব তাকে দিতেই হবে।
|