বৃদ্ধাশ্রম মানে বৃদ্ধদের আশ্রয়স্থল। বর্তমান সময়ের দিকে লক্ষ রেখে বলতে হয়, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য পরিবার ও স্বজনদের থেকে আলাদা আবাস বা আশ্রয়ের নাম বৃদ্ধাশ্রম। মূলত অসহায় ও গরিব বৃদ্ধদের প্রতি করুণামিশ্রিত বোধ থেকেই বৃদ্ধাশ্রমের জন্ম। যেখানে বৃদ্ধদের প্রয়োজনীয় সেবা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমের সেই ছবি এখন আর নেই। এখন যা আছে তা হলো, ছোটবেলায় যে বাবা-মা ছিলেন আমাদের সবচেয়ে বেশি আপন। যাদের ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারতাম না। যারা নিজেদের আরাম ত্যাগ করে আমাদের মানুষ করেছেন। নিজের সব দুঃখ-কষ্ট বুকে চেপে সন্তানের হাসি মুখ দেখার জন্য যে মা ব্যাকুল থাকতেন। আমরা না খেলে যিনি খেতেন না। না ঘুমালে যিনি ঘুমাতেন না। অসুস্থ হলে যিনি ঠায় বসে থাকতেন শিয়রে। যে বাবা-মা তিলেতিলে নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন সন্তানকে মানুষ করার জন্য। সেই বাবা-মায়ের শেষ বয়সের ঠিকানা তথাকথিত সভ্যতার এই বৃদ্ধাশ্রম। মানবতার প্রতি, দায়িত্ব বোধের প্রতি আমাদের সমাজব্যবস্থার এ যেন এক চরম উপহাস।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে ছোট্ট শিশু থেকে মা-বাবার আদর-যতœ ভালোবাসায় বেড়ে ওঠার পর পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী অবস্থান গড়ি আমরা। কেউবা রাষ্ট্রের অধিকর্তা, মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিবিদ। আবার কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশায় আত্মনিয়োগ করি। এসব কিছুর পেছনে প্রেরণার উৎস হলেন আমাদের মা-বাবা। অথচ বৃদ্ধ বয়সে প্রতিষ্ঠিত অনেক সন্তানের মা-বাবাকে থাকতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে! বঞ্চিত হতে হয় পরিবার-প্রিয়জনদের সান্নিধ্য!
ছোটবেলায় যখন আমি অসহায় শিশু, তখন একটু চোখের আড়াল হলেও দুশ্চিন্তায় কাতর হতেন মা-বাবা। নিজের সুখ, আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে তিলতিল করে আমাদের বড় করে তোলেন তারা। অথচ সেই মা-বাবাকেই পরিবারে ঝামেলা ও বোঝা মনে করে অনেক সন্তান। পাঠিয়ে দেয় বৃদ্ধাশ্রমে অথবা মা-বাবাকে বাড়িতে একলা ফেলে নিজেরা আলাদা সুখী-সমৃদ্ধ জীবন গড়ার চেষ্টা করে। অনেক ক্ষেত্রে বাবা অথবা মা বেঁচে নেই, একলা যিনি বেঁচে আছেন তার প্রতিও মমত্ববোধ জাগে না নির্বোধ ওই সন্তানের। বিস্ময়কর হলেও সত্য, জন্মদাতা বাবা-মায়ের প্রতি তাদের এ আচরণ এক নির্দয় মানবিক বিপর্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
অনেক ক্ষেত্রে সমাজের বাস্তব চিত্র হলোÑ অনেক পরিবারে ছেলেরা বিয়ে করার পরপরই মা-বাবার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। এই দূরত্ব বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সেই সন্তান। আর মেয়েরা তো বিয়ের পর চলে যায় স্বামীর সংসারে। নিজের ঘর আর মা-বাবাকে ছেড়ে স্বামীর সংসারে নতুন এক জীবনযুদ্ধে শামিল হতে হয় তাদের। মন চাইলেও মা-বাবাকে কাছে রাখার বা দেখভাল করার অথবা সমস্যায় থাকলে পাশে দাঁড়াবার সুযোগ হয় না। এমন প্রেক্ষাপটে মা-বাবাকে মনে পাথর বেঁধে বেছে নিতে হয় অসহায় ও একাকিত্বের জীবন। অনেকে মা-বাবার ভরণ-পোষণ দূরে থাক, খোঁজ-খবরও নেয় না। আবার কেউবা দায়বোধ এড়াতে সামান্য কিছু খরচের টাকা দিয়ে মনে করে দায়িত্ব পালন করা হলো। কিন্তু বয়স্ক মা-বাবাকে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে কি আসলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় ! দায়বোধ এড়ানো যায়?
সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে, মা-বাবার প্রতি দায়িত্ববোধ সবার সমান হওয়াই স্বাভাবিক। যেহেতু বাবা-মায়ের ভালোবাসার ঋণ চিরন্তন, যা কখনো শোধ হওয়ার নয়। পবিত্র আল-কোরআনসহ পৃথিবীর সব ধর্ম গ্রন্থে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তাদের প্রতি অসদাচরণ ও অবাধ্যতাকে পাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি। তাই তো প্রায়ই খবর পাওয়া যায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে মা-বাবার প্রতি অসম্মান, অবহেলা ও নিষ্ঠুরতার নানা অমানবিক আচরণের। অনেক ক্ষেত্রে অধিকার আদায়ে বৃদ্ধ বয়সে আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হন অনেক অসহায় বাবা-মা।
এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে, গত ২০১৬ সালে সন্তানের ওপর তার বাবা-মায়ের ভরণপোষণ বাধ্যতামূলক করে একটি বিল বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে পাস করা হয়। ওই বিলে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণপোষণ না করলে দুই লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাসের জেলের বিধান রাখা হয়েছে। বিল অনুযায়ী, বাবা-মা আলাদা বসবাস করলেও সন্তানের আয়ের ১০ শতাংশ নিয়মিতভাবে তাদের দিতে হবে। আইনে এ ধরনের অপরাধকে বলা হয়েছে জামিন অযোগ্য, তবে আপসযোগ্য। বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানদের দায়িত্ববান করতে সংসদে আইন পাস করতে হয়েছে। বিষয়টি লজ্জাজনক হলেও পরিবর্তিত অপচেতনায় সমৃদ্ধ সমাজব্যবস্থায় তাকে স্বাগত।
এমন আইন শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম সরকার বাবা-মায়ের ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে অভিনব একটি আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাতে সরকারি কর্মচারীরা বাবা-মায়ের ঠিকমতো দেখভাল না করলে তাদের বেতন থেকে একটা অংশ কেটে নেওয়া হবে এবং সেই অর্থ তার বাবা-মায়ের ভরণপোষণেই ব্যয় করা হবে। নতুন এ আইন ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকেই বাস্তবায়ন হবে বলে জানিয়েছেন আসামের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। সম্প্রতি ভারতের আসামসহ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও ছেলেমেয়েরা বৃদ্ধ-অসুস্থ মা-বাবার ভরণপোষণ এবং যতœ না নেওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ ধরনের অনেক ঘটনার অভিযোগ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। পরে আদালতের রায়ে অনেক মা-বাবা তাদের অধিকার ফিরে পেয়েছেন।
পারিবারিক ও সামাজিক এ ধরনের সমস্যা প্রতিকারে আসাম সরকারের এ পন্থাকে সাধুবাদ জানাই। কারণ ঘুণে ধরা এ সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষেত্রে ন্যায়প্রতিষ্ঠায় কঠোরতার কোনো বিকল্প নেই। এর পাশাপাশি আইনের বাস্তবায়নে প্রয়োজন যথার্থ প্রয়োগ, যা আমরা রাষ্ট্রের কাছে আশা করতেই পারি।