সমাজ উন্নয়নে স্বেচ্ছাসেবার গুরুত্ব অপরিসীম। স্বেচ্ছাসেবা নানাজনের কাছে নানা অর্থ বহন করে। কারো কাছে স্বেচ্ছাসেবার ব্যাখ্যা হচ্ছে আর্থিক প্রতিদানের অনুপস্থিতি, অন্যদের কাছে জবরদস্তির অনুপস্থিতিই হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবার মানদন্ড। অর্থনৈতিক সুবিধা বা বস্তুগত লাভের আশা না করে সমাজের মানুষের অগ্রগতি বা উন্নয়নের মহৎ প্রয়াসকে সাধারণত স্বেচ্ছাসেবা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মানদন্ডের ভিত্তিতে অন্ততঃপক্ষে চার ধরনের স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ শনাক্ত করা যায়।
যেমন-পরস্পরের সাহায্য-সহায়তা বা আত্মসহায়তা, দানশীলতা বা পরোপকার, অংশগ্রহণ এবং অ্যাডভোকেসি বা প্রচারাভিযান। স্বেচ্ছাসেবা হলো টেকসই উন্নয়নের চতুর্থ ভিত্তিপ্রস্তর, যা হচ্ছে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কর্মকান্ড। দূরের কুয়ো থেকে নিরাপদ পানি বয়ে আনা থেকে শুরু করে অভাবগ্রস্ত শিশুদের শুশ্রুষা প্রদান করা এর অন্তর্গত। টেকসই উন্নয়নের আর তিনটি ভিত্তিপ্রস্তরের মতো স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজকর্মেরও পর্যবেক্ষণ, অনুধাবন, পরিকল্পনা ও সহায়তা অত্যাবশ্যকীয়। স্বেচ্ছাসেবার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বাধাগুলো শনাক্ত করে তা দূরীভূত করতে হবে। স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের পরিমাপ, নথিভুক্তিকরণ ও প্রচার চালিয়ে যেতে হবে।
স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে ছাত্রসমাজ সামাজিক উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে। ছাত্রজীবনে প্রচুর ছুটি থাকে, পরীক্ষার শেষে বেশ কিছুটা দীর্ঘ সময় পাওয়া যায়। লেখাপড়ার পাশাপাশি কিছু সময় বের করেও নেওয়া সম্ভব। এভাবে প্রাপ্ত সময় কাজে লাগিয়ে ছাত্ররা জনকল্যাণমূলক কাজে আত্মনিয়োগ বা নিজের সামর্থের মধ্যে জনসেবায় নিয়োজিত হতে পারে। সমাজকল্যাণ সাধনকে ছাত্রদের কর্তব্য বিবেচনা করা দরকার। ছাত্রজীবনে দেশাত্মবোধ চর্চা এবং তার পরিচয় দেওয়া ছাত্রদের কর্তব্য। শিক্ষাকে জীবনঘনিষ্ঠ করে রূপান্তরিত করা দরকার, যার মাধ্যমে একজন মানুষ নিজের ও জাতির জন্য সম্পদ বলে বিবেচিত হতে পারে।
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তা সরকারি প্রচেষ্টাকেও ছাড়িয়ে যায়। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বলতে জনগণের স্ব-ইচ্ছায় এবং উদ্যোগে সংগঠিত ও পরিচালিত সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানকে বোঝায়। অন্যকথায়, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বলতে সেসব সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানকে বোঝায়, যা জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ ও সাংগঠনিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সংগঠিত ও পরিচালিত। বাংলাদেশের মতো সমস্যায় জর্জরিত দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। জনগণের মৌলিক চাহিদা যেমন-খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা পূরণে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গুরুত্বপূণ ভূমিকা পালন করে। বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান বিনামূল্যে খাদ্য ও বস্ত্র বিতরণ করে থাকে। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি সাধনে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি সমাজকল্যাণ কর্মসূচির পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বর্তমান সমাজের অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে রেখেছে বর্ধিত জনসংখ্যা, স্বাস্থ্যহীনতা, ভিক্ষুক সমস্যা, কিশোর অপরাধ ইত্যাদি। এসব সমস্যার সমাধানে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দান, বয়স্ক শিক্ষা, শিশুকল্যাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণ ও সরকারি সাহায্য গ্রহণ করে জনস্বাস্থ্য রক্ষায়ও ভূমিকা পালন করে। যেমন-টিকাদান কেন্দ্র, চক্ষু শিবির, রক্তদান কর্মসূচি ইত্যাদি। সমাজের বঞ্চিত, অসহায়, অজ্ঞ ও নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে আইনগত সহায়তাদানে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো সামাজিক জরিপ ও গবেষণার মাধ্যমে সমাজজীবনে প্রয়োজনীয় অথচ উপেক্ষিত সমস্যাবলি চিহ্নিত করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে গ্রামের ভূমিহীন কৃষক এবং অন্যান্য গরিব ও নিঃস্ব শ্রেণির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বতন্ত্র উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন করা যায়। এসব প্রকল্পের অর্থসংস্থান করার জন্য গ্রামে মুষ্টি চাল সংগ্রহ, কোরবানির চামড়া, জাকাতের টাকা, হাট-বাজার হতে আদায়কৃত কর প্রভৃতির মাধ্যমে তহবিল গঠন করা যেতে পারে। গরিব ও নিঃস্ব শ্রেণিকে এসব প্রকল্পের সাহায্যে আত্মনির্ভরশীল করে তোলা সম্ভব।
বর্তমানে বাংলাদেশে ৭,৩২১টিরও বেশি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান সমাজকল্যাণ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হলো বাংলাদেশ শিশুকল্যাণ পরিষদ, মুকুল ফৌজ, বাংলাদেশ বহুমূত্র সমিতি, বাংলাদেশ বয়স্কাউট সমিতি, বাংলাদেশ জাতীয় যক্ষ্মা নিরোধ সমিতি, বাংলাদেশ গার্ল গাইডস সমিতি, বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সমিতি, বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি। জাগ্রত যুবশক্তি স্বনির্ভর সমাজ গঠনের প্রধান চালিকাশক্তি। তাই বিভিন্নভাবে গ্রামের যুবসমাজকে স্বেচ্ছাশ্রম দানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। স্বেচ্ছাশ্রমের সাহায্যে সহজেই রাস্তাঘাট নির্মাণ, সেচের জন্য খাল খনন, বৃক্ষরোপণ, নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন প্রভৃতি কাজ করা যেতে পারে। এছাড়া স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে গ্রামীণ জনসাধারণকে উৎসাহিত করতে পারে। গ্রামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, শিক্ষিত যুবসমাজ ও মহিলারা নিরক্ষর এবং অজ্ঞ গ্রামবাসীদের পরিবার-পরিকল্পনা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
সমাজের সবচেয়ে তরুণ এবং সচেতন অংশ হচ্ছে ছাত্রসমাজ। পুরাতনকে, মিথ্যাকে, জরা-জীর্ণতাকে মুছে ফেলে, প্রাচীন সংস্কার ও গোঁড়ামিকে ঝেড়ে ফেলে একটি শোষণমুক্ত সুন্দর সমাজ গড়ার দায়িত্ব আজকের ছাত্রদের। ছাত্ররা তাদের সুন্দর মন ও সুকুমার বৃত্তির অভিনব প্রকাশের সাহায্যে সমাজের পঙ্কিলতা দূর করতে পারে। বিশ্ব মানবতা এবং মানবিকতার বিজয় পতাকা ছাত্রদেরই হাতে। তারা তা সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। চিরবঞ্চিত, বুভুক্ষ, অনাহরিক্লিষ্ট মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তারা শোনাতে পারে সান্ত¦নার বাণী। আশাহীন বুকে জাগাতে পারে আশা। ভাষাহীন বুকে দান করতে পারে প্রাণের স্পন্দন। সভা-সমিতি-সেমিনার, সংঘ, স্কাউটিং এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবামূলক ফোরামের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা এই দায়িত্ব পালন করতে পারে। স্বেচ্ছাসেবার ধারণা শিশু-কিশোরদের মনে বিদ্যালয় থেকেই বপন করে দিতে হবে। বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজেও উৎসাহিত করতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবার ধারণা উপ্ত হলে পরবর্তীকালে সেই শিক্ষিত যুবকটি সমাজের অনেক কল্যাণ সাধন করতে পারে। শহরে কিংবা গ্রামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্থাপন করে স্থানীয়ভাবে সমাজের সেবা করা হয়ে থাকে। বিদেশিরাও আর্থিক সহায়তা দিয়ে ও স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে আর্তমানবতার সেবা করে থাকে।
আমাদের সেবাধর্মে উদ্দীপিত হতে হবে। দারিদ্র্য, লাঞ্ছিত, রোগজর্জর, সমস্যাদীর্ণ, পতিত দেশে স্বেচ্ছাসেবার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ পড়ে রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে মানুষ যখন বিধ্বস্ত তখন তাদের পাশে গিয়ে সেবার কোমল হাত প্রসারিত করে দেওয়া মানুষ হিসেবেই আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। বন্যার্ত, ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত, দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় আমরা গড়ে তুলতে পারি সাহায্য তহবিল। আর সে ভান্ডার পূর্ণ করার জন্য স্বেচ্ছাশ্রম দান করতে পারে সমাজের আপামর জনসাধারণ। রক্তদানের মধ্য দিয়ে তারা মৃতপ্রায় রোগীকে ফিরিয়ে দিতে পারে প্রাণ। বৃক্ষরোপণে ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ষা করতে পারে পরিবেশের ভারসাম্য। পল্লীর অবাঞ্ছিত জঙ্গল পরিষ্কার করেও আমরা স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ গড়ে তুলতে পারি।
উন্নয়ন ও কল্যাণের নতুন দর্শন হিসেবে স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে সমাজের সার্বিক উন্নতিসাধন করা সম্ভব। স্বেচ্ছাশ্রম মানুষকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে। স্বেচ্ছাশ্রম নিবেদিত হয় মানুষের কল্যাণে। স্বেচ্ছাশ্রমে মানুষের কর্মবিমুখতা দূর হয়ে যায়। সচেতনায় জাগ্রত হয় জাতি। সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও বিচ্ছিন্নতা দূর করে সামাজিক সম্প্রীতি ও সংহতি বিনির্মাণে স্বেচ্ছাশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। বস্তুতপক্ষে স্বেচ্ছাশ্রম মহৎ কোনো লক্ষ্য অর্জনের কার্যকর একটি হাতিয়ার।
|