আরব লিগের মতো জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছে ইসলামিক দেশগুলোর সহযোগী সংগঠন ওআইসির ইন্ডিপেন্ডেন্ট পারমানেন্ট হিউম্যান রাইটস কমিশন (আইপিএইচআরসি)। একইসঙ্গে তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এমন ঘোষণার কড়া নিন্দা জানিয়েছে। এমন বেপরোয়া সিদ্ধান্তে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ও নিরাপত্তা কঠিন পরিণতিতে পড়বে বলে সতর্ক করেছে কমিশন।
এতে স্পষ্ট হয়েছে, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের যে সুযোগ আছে তাকে খর্ব করে দেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারে এ সিদ্ধান্তে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে সতর্ক করেছে আইপিএইচআরসি। এ ক্ষেত্রে পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বীকৃতির এক সপ্তাহের মাথায় ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ওআইসির এক জরুরি সম্মেলন ডেকে তা প্রত্যাখ্যান করে জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে বিশ্বের ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা একদিনের সম্মেলন শেষে এই স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছেন। ওআইসির তরফে যেসব রাষ্ট্র এখনো ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়নি তাদের প্রতি অধিকৃত জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ইস্তাম্বুল সম্মেলনের ইশতেহারে আরো বলা হয়েছে, যেসব দেশ ট্রাম্পের ঘোষণাকে সমর্থন করবে সেসব দেশের বিরুদ্ধে ইসলামী দেশগুলো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং সম্পর্ক ছিন্ন করবে।
ট্রাম্পের ঘোষণাকে বাতিল এবং আইনগতভাবে অকার্যকর মন্তব্য করে বলা হয়েছে, এই সিদ্ধান্ত আরব-ইসরায়েল শান্তি প্রক্রিয়া ব্যাহত করবে এবং সেখানে চরমপন্থা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য ট্রাম্প প্রশাসন দায়ী হবে। সভাপতির ভাষণে ইসরায়েলকে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলি দখলদারিত্ব অবসানে জাতিসংঘকে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন এরদোয়ান। ফিলিস্তিনের ভূমি জবরদখল করে ১৯৪৮ সালে গড়ে ওঠা ইসরায়েল ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় মুসলমানদের ঐতিহাসিক পবিত্র মসজিদ বায়তুল মোকাদ্দাসসহ পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। সেই থেকে ইসরায়েল জেরুজালেমকে তার রাজধানী হিসেবে দাবি করে এলেও গত ৫০ বছরে বিশ্বের কোনো দেশ তার স্বীকৃতি দেয়নি। জেরুজালেম নগরীকে একই সঙ্গে মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে সম্প্রতি জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কোর এক ঘোষণায় পূর্ব জেরুজালেমের ওপর ইহুদিদের দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ফিলিস্তিনের ওপর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের আগপর্যন্ত শত শত বছর ধরে জেরুজালেমে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সঙ্গে খ্রিস্টান ও ইহুদিরা শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছিল। ইঙ্গ-মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই সেখানে অশান্তি ও রক্তক্ষয়ী সংঘাতের সূচনা হয়। আরব-ইসরায়েল সংঘাত বন্ধে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের নীতি অনুসরণ করে দুই দশকের বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি শান্তি প্রক্রিয়ার মধ্যস্থতা করে আসছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে শান্তি প্রক্রিয়ায় মার্কিন ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
অবশেষে গত ৬ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন শান্তি প্রক্রিয়ায় কার্যত আনুষ্ঠানিক ইতি টেনেছেন ট্রাম্প। কারণ জেরুজালেমের অধিকার ছাড়া ফিলিস্তিনি ও মুসলমানদের কাছে আর কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। ট্রাম্পের ঘোষণার পর থেকেই জেরুজালেম ও আশপাশের এলাকাগুলোতে প্রতিবাদ, বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন ফিলিস্তিনের প্রতিবাদী মানুষ। সারা বিশ্বের মুসলমানরা সঙ্গে সঙ্গেই ফিলিস্তিনের সঙ্গে তাদের সংহতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়েছে। একমাত্র ইসরায়েল ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পশ্চিমা মিত্র ট্রাম্পের ঘোষণাকে সমর্থন করেনি। রশিয়া, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলো তাৎক্ষণিকভাবেই ট্রাম্পের ঘোষণার বিরোধিতা করে ট্রাম্পের ঘোষণার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। অন্যদিকে ওআইসি, আরব লিগসহ বিশ্বের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে গেছে। বলা যেতে পারে, ট্রাম্পের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম প্রশ্নে বিশ্বসম্প্রদায় এবং ওআইসিভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এক ধরনের মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে।
এদিকে ট্রাম্পের ঘোষণার পর থেকেই প্রতিবাদী ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর বিমান হামলা ও টার্গেটেড কিলিং শুরু হয়েছে। হামাস এবং হিজবুল্লাহসহ ফিলিস্তিনি ও লেবানিজ প্রতিরোধ আন্দোলনের পক্ষ থেকে নতুন গণজাগরণ বা ইন্তিফাদার ডাক দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে হামাস ও হিজবুল্লাহ নেতাদের সঙ্গে রাশিয়া, ইরান ও তুর্কি নেতাদের মধ্যে ফোনালাপ ও কূটনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধির খবর পাওয়া গেছে। এ থেকে বোঝা যায়, ট্রাম্পের ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে আরেকটি রক্তক্ষয়ী সংঘাত উসকে দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ এবং বিশ্বনেতারা ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে একটি কার্যকর পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে আরেকটি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ফিলিস্তিনের প্রতিরোধযুদ্ধ পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। গত একদশকে তারা একাধিকবার ইসরায়েলি বাহিনীকে পর্যুদস্তু করতে সক্ষম হয়েছে। রাশিয়া, ইরান, তুরস্কের হস্তক্ষেপে সিরিয়া এবং ইরাকে পশ্চিমা মদদপুষ্ট দায়েশের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিতে মার্কিনিদের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়েছে। এহেন বাস্তবতায় বিশ্বজনমত উপেক্ষা করে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করা বড় ধরনের বোকামি। তবে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের ফলেই এই প্রথমবারের মতো ওআইসিভুক্ত রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিন প্রশ্নে একটি দৃশ্যমান সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থ হলো। ইস্তাম্বুল ঘোষণা ফিলিস্তিন প্রশ্নে ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে। শুধু ঘোষণা দিয়ে জেরুজালেম সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না। এ জন্য ওআইসি, আরব লিগ, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিশ্বসম্প্রদায়কে ন্যায় ও শান্তির পক্ষে সমন্বিত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এ ঘোষণায় বৈষম্য, উগ্রপন্থা ও সহিংসতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। তা বিশ্বজুড়েও দেখা দিতে পারে।
এদিকে, জেরুজালেম ইস্যুতে আরব দেশগুলো বিশেষ করে সৌদি জোটের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু। তিনি বলেন, জেরুজালেম ইস্যুতে কিছু আরব দেশের প্রতিক্রিয়া খুবই দুর্বল। তারা যেন যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ে ভীত। উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ফিলিস্তিনি ভূখন্ড দখল করে প্রতিষ্ঠিত হয় বর্ণবাদী ইসরায়েলি রাষ্ট্রের। পশ্চিমা খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ এবং একের পর এক তাদের বাসভূমি দখল করে যাচ্ছে ইসরায়েল। অপরদিকে আইপিএইচআরসি তার বিবৃতিতে বলেছে, জেরুজালেমকে বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটি মুসলিম পবিত্র শহর হিসেবে দেখে থাকেন। তাদের কাছে এর মূল্য অপরিসীম। বারবার জেরুজালেমে ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব ও দেয়াল নির্মাণকে প্রত্যাখ্যান করেছে ইউনেস্কো। এমন কিছু করলে তা হবে অবৈধ—এ ঘোষণাও দিয়েছে ইউনেস্কো। একই বিবৃতিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে অবৈধ বলে ঘোষণা দিতে আহ্বান জানিয়েছে আইপিএইচআরসি। এক্ষেত্রে একটি টেকসই সমাধানের জন্য জেরুজালেম ইস্যুতে একটি আন্তর্জাতিক ঐকমত্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। আইপিএইচআরসি বলেছে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের উচিত এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্যারান্টি নিশ্চিত করা যে, আল-আকসা মসজিদ ইসরায়েলিদের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখা হবে।