জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ বন্ধে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিতে অর্থ বরাদ্দে আজও তেমন সাফল্য অর্জিত হয়নি। আইনি কাঠামো বাস্তবায়নে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্যে আসেনি অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপখাইয়ে নিতে ঝুঁকিপ্রবণ দেশগুলোকে সাহায্য প্রদান এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা লাঘবে অধিকমাত্রায় গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী ও উন্নত দেশগুলোকে অভিযোজন কার্যক্রমে জোরালোভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান কার্যকর হয়নি।
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে এক অঙ্গীকারে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি যাতে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে কম থাকে, সে ব্যাপারে সব দেশ একাত্মতা ঘোষণা করে। কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে একটি আইনি বাধ্যবাধকতামূলক চুক্তিতে পৌঁছানো, অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে আনা এবং পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করাই ছিল গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড গঠনের উদ্দেশ্য। তবে এখনো আশানুরূপ তহবিল জোগাড় করতে সক্ষম হয়নি জিসিএফ। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৬ সাল ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। এ সময় সমুদ্রের উপরিভাগের পানির তাপমাত্রাও অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। বিশ্বজুড়ে উন্নয়নের অভিযাত্রায় বায়ুমন্ডলে অনবরত কার্বন নিঃসরণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। জলবায়ুর এমন পরিবর্তনের ফলে অদূর ভবিষ্যতে ছোট ছোট দ্বীপরাষ্ট্র ও সমুদ্র উপকূলবর্তী বদ্বীপ অঞ্চলগুলো টিকে থকেবে কি না সন্দেহ।
বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত বদলে যাওয়া আবহাওয়া, প্রাকৃতিক পরিবেশের দ্রুত ঘটা আমূল পরিবর্তন-সহজেই চোখে ধরা পড়ে। জানা গেছে, এল নিনোর প্রভাবজনিত কারণে বাংলাদেশেও আবহাওয়ার তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। এল নিনো হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরিভাগের জলরাশি তাপমাত্রার নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তনের সঙ্গে গড়মাত্রার তুলনামূলক বিশ্লেষণ। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে প্রবল তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে এল নিনোর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আমেরিকার ন্যাশনাল ওসেনিক অ্যান্ড অ্যাটমস্ফেয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বিশেষজ্ঞদের মতে, ৬৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এল নিনোর প্রভাবে গেলবার আবহাওয়ার এমন অস্বাভাবিক আমূল পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে।
জলবায়ুর আমূল পরিবর্তনের কারণে বন্যা ও খরার প্রবণতা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে কখনো খরায় মাঠঘাট, ক্ষেতের ফসল পুড়ে ছারখার হয়ে যায়, কখনোবা অতিরিক্ত জোয়ার এবং জলোচ্ছ্বাসের লবণাক্ত পানি ভূখন্ডে ঢুকে ভূমির উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ঋতুচক্রের অস্বাভাবিক পরিবর্তনে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে শ্যামল বৃক্ষরাজি, পশুপাখি। জীবজগতে পড়ছে এর নেতিবাচক প্রভাব। শুকিয়ে যাচ্ছে হাওর, বিল, খাল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গেল ৫০ বা ১০০ বছরের পরিসংখ্যান বিবেচনায় আগামীতে বাংলাদেশে ব্যাপক অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অসময়ে প্রবল বন্যা, মরুময়তা, ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপ, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ৩০ শতকরা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় ২২ শতাংশ কৃষিজমি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এতে দেশে খাদ্যাভাবসহ নানা অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রকৃতির এমন বদলে যাওয়া রূপ এর আগে লক্ষ করা যায়নি। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং পরিবেশগত সমস্যা পৃথিবীর উন্নত দেশের চেয়ে প্রকট। যদিও প্রাকৃতিক পরিবেশের এহেন অবস্থার জন্য উন্নত দেশগুলোই বেশি দায়ী। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষার ঋতুবৈচিত্র্য আজকাল কোনো নিয়ম মেনে চলে না। আর এ ধরনের অনিয়ম মানুষের জীবনযাত্রাসহ দেশের অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে, যা আগে দেখা যায়নি। একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, ২০১৬ সালের তুলনায় এ বছর বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বয়ে গেছে বেশি। চলতি বছরের এপ্রিলে হাওরের বন্যা, আগস্টে উত্তরাঞ্চলের ভয়াবহ বন্যা এবং দেশে পাহাড়ধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ অধিক ঘটেছে। এ কারণে হাওরে বোরো ফসল নষ্ট হয়েছে এবং উত্তরাঞ্চলের আমন ধান তলিয়ে যাওয়ায় ব্যাপক ফসলহানি হয়েছে। দেশ হয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখোমুখি।
বিগত ১৯ বছরে ঘটে যাওয়া দুর্যোগের সংখ্যা, মৃত্যু, অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির হিসাবের ভিত্তিতে জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা জার্মান ওয়াচ ১৯৯৭ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বিশ্বের ২০০ দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে তৈরি ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠতে রয়ে গেছে। তবে শুধু গেল বছরের হিসাবে এ অবস্থান ১৩ নম্বরে। এর আগে জার্মানির ওয়াচ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাপল ক্রফট নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ।
গেল ৩০ বছরে বাংলাদেশের ১ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৭ মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগে মারা গেছে। গবেষণার তথ্যানুসারে এবং বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্বের বিচারে দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা পূর্বাঞ্চলের হাওর-বাঁওড়, উত্তরাঞ্চলের খরাপ্রবণ এলাকা বিশ্বের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। পরিবেশের অবক্ষয়, পৃথিবীর উত্তাপ বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিশ্ব নিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে। ভৌগোলিক অবস্থান, ঘন জনবসতি, জীবিকার জন্য প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা এবং দারিদ্র্যসহ নানা কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আন্তর্জাতিক এক গবেষণার তথ্য মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ভয়াবহ জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য বিপর্যয় নিয়ে শঙ্কিত বিজ্ঞানীরাও।
আইপিসিসির তথ্য মতে, গেল শতাব্দীতে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ০.৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেয়েছে। উত্তাপ বাড়ার কারণে হিমবাহের গলনও বাড়ছে। হিমালয় অঞ্চলে তৈরি হচ্ছে অসংখ্য হিমবাহ লেক। এসব লেকে বিস্ফোরণ হলে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। সমুদ্রের পানির আয়তন বৃদ্ধি এবং পলি জমে সমুদ্রের তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই মধ্যে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা প্রতিবছর ৩ মিলিমিটার করে বৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে গেলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মোট আয়তনের ১৫.৮ শতাংশ স্থলভাগ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। বর্তমানে মেরু অঞ্চলের বরফ যেভাবে গলছে, তাতে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১৭ ভাগ ভূমি সাগরজলে তলিয়ে যাওয়াটাও অসম্ভব নয়।
বিশ্ব জলবায়ু রক্ষায় ২০১৫ সালের প্যারিসের আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তির বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর পরও কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমানোর ব্যাপারে কোনো দেশই পর্যাপ্ত কর্মসূচি গ্রহণ করেনি। জলবায়ু পরিবর্তনের সিংহ ভাগ দায় উন্নত দেশগুলোর হলেও ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও অন্যান্য অনুন্নত দেশ সামনে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো বায়ুমন্ডলে কার্বন নিঃসরণ কমানোর পাশাপাশি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার অঙ্গীকার করলেও আজও তা বাস্তবে রূপায়িত হয়নি।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৩৬ কোটি কিলোটন কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমন্ডলে নির্গত হয়। এর প্রায় ২৯ শতাংশ চীন এবং ১৪ শতাংশের বেশি কার্বন নির্গত করে যুক্তরাষ্ট্র। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশ মিলে কার্বন নির্গত করে ৯ শতাংশ। অথচ ক্লাইমেট চেঞ্জ পারফরম্যান্স ইনডেক্স অনুযায়ী, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য বেশি দায়ী যুক্তরাষ্ট্র ও চীন কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। বিশ্লেষকদের মতে, কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ওপর। এ দুই দেশ যদি বিদ্যুৎ ও জীবাশ্ম জ্বালানি শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে ডি-কার্বোনাইজ পদ্ধতি গ্রহণ করে, তাহলে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমে আসার ক্ষেত্রে বিশাল প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশে ক্ষরাসহিষ্ণু কৃষিপণ্য উৎপাদন, আধুনিক পদ্ধতিতে শস্য ও বীজ সংরক্ষণসহ কৃষিজমি রক্ষার্থে বনভূমি উজাড়, জলাধার ভরাট, ইটভাটা নির্মাণ বন্ধ করা ভিন্ন বিকল্প নেই।
কাজেই বিশ্ব পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সব দেশকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে যেতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বলতে এতদিন বাংলাদেশসহ ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র ও দরিদ্র রাষ্ট্রের নাম শোনা যেত। কিন্তু আজ তাপমাত্রা অধিক বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের ধনী দেশগুলোও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছে। প্রথমবারের মতো এবার ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নামও উঠে এসেছে। এ ছাড়া বিশ্ব উষ্ণায়ন, বর্তমান জলবায়ু পরিবতর্নের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করে বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক জীবন ধারার উন্নয়নের নিশ্চয়তা বিধানসহ দেশের সামগ্রিক চলমান অগ্রগতির ধারাকে অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি নিশ্চিতকরণের জন্য জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, কার্বন নিঃসরণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার জরুরি হয়ে পড়েছে।
|