পৃথিবী নামক গ্রহের ভূখন্ডকে কয়েকটি মহাদেশে ভাগ করা হয়েছে। তন্মধ্যে ইউরোপকে বলা হয় খুবই উন্নত মহাদেশ। অর্থনীতি, শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান, খেলাধুলা, সংস্কৃতি সবকিছুতেই এগিয়ে আছে ইউরোপ। এ মহাদেশটির স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ইউরোপীয় দেশগুলো একত্রিত হয়ে গঠন করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। দেশগুলো নিজেদের মধ্যে এক প্রকার মুদ্রাও চালু করেছে। এ মুদ্রার নাম দেওয়া হয়েছে ইউরো। ইউরোপের একাংশে অবস্থিত দেশটির নাম স্পেন। সমগ্র স্পেনের জনসংখ্যা পাঁচ কোটিরও কম।
স্পেনের কয়েকটি প্রদেশের মধ্যে কাতালোনিয়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় একটি প্রদেশ। কাতালান জনগণের দীর্ঘদিনের স্বাধীনতার দাবি বর্তমান সময়ে যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকে জোরপূর্বক তাদের হটিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই স্পেন সরকারের জন্য যুক্তিযুক্ত হবে না জেনেই সম্ভবত স্পেনের পক্ষ থেকে আবারও কাতালোনিয়ার জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সংবলিত এক প্যাকেজ ঘোষণার প্রক্রিয়া চলছে। এখন দেখার বিষয়, এতে তারা কতটুকু সফল হয়। তবে কাতালান নেতা কার্লোস পুজদেমন যেকোনো আপসের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নে অটল রয়েছেন। এখানে ইইউ এবং প্রতিবেশী ফ্রান্সের পক্ষ থেকে এ মুহূর্তে যে প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করা হোক না কেন, কোনো স্বাধীন দেশের উত্থান অতীতের সব বিশ্লেষণ ভুল প্রমাণিত করে নতুন মেরুকরণের সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক কী কারণে কাতালোনিয়ার মানুষের মনে স্পেন থেকে পৃথক হয়ে একটি স্বতন্ত্র দেশ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নাড়া দিয়েছে।
কাতালোনিয়া স্পেনের ১৭টি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের একটি হলেও এর রয়েছে এক হাজার বছরের পুরনো নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা স্পেনের অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আধিক্যের কারণে অনেকটা অবহেলিত। তা ছাড়া ১৯৩৬ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধের আগে অঞ্চলটি অধিক মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন ভোগ করলেও জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকোর প্রায় ৪০ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের ফলে তা বাধাপ্রাপ্ত হয়, যা আর কখনো আগের মাত্রায় ফিরে আসেনি। জেনারেল ফ্রাংকোর মৃত্যুর পর আবারও অঞ্চলটিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জেগে ওঠার প্রেক্ষাপটে ১৯৭৮ সালের সংবিধান মোতাবেক সেখানে আবারও স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়। ২০০৬ সালের এক আদেশে কাতালোনিয়াকে আরো অধিক মাত্রায় ক্ষমতা প্রদান করা হয়, যার মাধ্যমে তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রদানসহ অঞ্চলটিতে বসবাসরতদের একটি জাতি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হলেও পরবর্তী সময়ে স্পেনের সাংবিধানিক আদালতের আদেশে তা আবার খর্ব করে দেওয়া হয়, যা কাতালান নেতাদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা এবং সভ্যতার সংঘাতের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি স্থানীয় ইস্যু হয়েও কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা এখন একটি বহুল আলোচিত বিষয়।
গত ১ অক্টোবর স্পেন থেকে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা ইস্যুতে বহুল আলোচিত কিন্তু সমভাবে বিতর্কিত গণভোট অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। গণভোটে কাতালান ভোটারদের মাত্র ৪৩ শতাংশের অংশগ্রহণ স্পেন সরকারকে গণভোট ও কাতালান স্বাধীনতার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। অন্যদিকে গণভোটের ফলে ৯০ শতাংশ ভোট কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে পড়ায় স্বাধীনতা ঘোষণাকে সময়ের ব্যাপার বলে আখ্যায়িত করেছেন কাতালান নেতা কার্লেস পুজদেমন। কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা নতুন করে যে বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে, তা হলো স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘাত শীর্ষক তত্ত্ব।
১৯৯৩ সালের থিসিস থেকে ১৯৯৬ সালে হান্টিংটন রচনা করেন তার বহুল আলোচিত গ্রন্থ ‘দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন অ্যান্ড দ্য রিমেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার’। মূলত স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী নতুন বিশ্ব বাস্তবতার স্বরূপ কেমন হবে, তার এক ধরনের রূপরেখা কল্পনা করেছিলেন হান্টিংটন তার এ গ্রন্থে। গ্রন্থের বিষয়বস্তু নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতার প্রশ্নে স্কটল্যান্ডের গণভোট কিংবা ২০১৬ সালের ব্রেক্সিট নতুন করে আলোচনায় এনেছে হান্টিংটন আর তার তত্ত্বকে।
কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে আবারও সভ্যতার সংঘাত তত্ত্বের দিকে আলোকপাতের সুযোগ হয়েছে। তবে তার আগে হান্টিংটনের তত্ত্ব নিয়ে সাধারণ আলোচনা প্রয়োজন। হান্টিংটন মূলত বলতে চেয়েছেন, নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের যেসব সংঘাত আসন্ন, তা মূলত রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের নয়; বরং সভ্যতার বিপক্ষে সভ্যতার সংঘাত হিসেবে সামনে আসবে। এ তত্ত্ব ধরে তিনি বর্তমান বিশ্বে বিদ্যমান সাতটি সভ্যতা নিয়ে আলোচনা করেন। সভ্যতাগুলো হলো সিনিক, জাপানি, হিন্দু, ইসলামী, পাশ্চাত্য (ইউরোপ, উত্তর ও ল্যাটিন আমেরিকা), ল্যাটিন আমেরিকা এবং আফ্রিকান (সম্ভাব্য) সভ্যতা। একই সঙ্গে তিনি বিশ্বে বিদ্যমান রাষ্ট্রগুলোকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমত, কোর রাষ্ট্র, এরা কোনো একটি সভ্যতাকে নেতৃত্ব দেয়। যেমন-সিনিক সভ্যতার কোর রাষ্ট্র হলো চায়না। দ্বিতীয়ত, ফাটলরেখার রাষ্ট্র, যেসব রাষ্ট্রে একাধিক সভ্যতার উপস্থিতি থাকায় রাষ্ট্রে ফাটল বা বিভাজনের সম্ভাবনা থাকে। ক্রিমিয়া ইস্যুতে ইউক্রেন এমনই এক রাষ্ট্রের উদাহরণ। তৃতীয়ত, ছিন্ন রাষ্ট্র, এসব রাষ্ট্র এক সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নতুন সভ্যতাকে গ্রহণ করে।
হান্টিংটন এরূপ রাষ্ট্র হিসেবে অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, রাশিয়া ও মেক্সিকোর কথা উল্লেখ করেছেন। চতুর্থত, একাকী রাষ্ট্র, এসব রাষ্ট্র একাই একটি সভ্যতা এবং এর অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্র নেই। জাপানকে বলা হয়েছে একাকী রাষ্ট্রের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। হান্টিংটন যেভাবে সভ্যতাগুলোকে ভাগ করেছেন তাতে এক সভ্যতা থেকে আরেক সভ্যতার মূল পার্থক্য ধরা হয়েছে সভ্যতাগুলোর ভাষা ও ধর্মকে। হান্টিংটন পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেখিয়েছেন কীভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় ভাষা ও ধর্মের ব্যবহার বাড়ছে। একই সঙ্গে তিনি ১৯৯৬ সালেই এ আশঙ্কা করেছিলেন যে, সভ্যতার সংঘাতের অংশ হিসেবে আগামী দিনে ক্রিমিয়া ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত হতে পারে। এছাড়া ২০১৪ সালের স্কটল্যান্ডের গণভোট যুক্তরাজ্যকে ফাটল রেখার রাষ্ট্র হিসেবে সামনে এনেছে, আবার ব্রেক্সিটের ঘটনার ফলে যুক্তরাজ্য সামনে এসেছে ছিন্ন রাষ্ট্র হিসেবে। তাহলে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা প্রশ্নেও কিন্তু স্পেনকে একটি ফাটল রেখার রাষ্ট্র বলাই যায়। আর এক্ষেত্রে এসেই স্পেন ও কাতালোনিয়ার সম্পর্কের ইতিহাস কিছুটা জেনে নেওয়া উচিত। ১১৫০ সালে আরাগনের রানি পেট্রলিনিয়ার সঙ্গে কাউন্ট অব বার্সেলোনা চতুর্থ র্যামন বেরেংগুয়ারের বিয়ের ফলে যে রাজবংশের সূচনা হয় তাতে আরাগন ও কাতালোনিয়া একীভূত হয়। পরবর্তী সময় ১৭১৪ সালে স্পেনের রাজা পঞ্চম ফিলিপ কাতালোনিয়া দখল করে তাকে স্পেন সা¤্রাজ্যের অংশে পরিণত করেন। আধুনিক স্পেনের সৃষ্টির সময়েও কাতালোনিয়া স্পেনের অংশ হিসেবে থেকে যায়। দীর্ঘদিন ধরে স্পেনের সঙ্গে থাকলেও স্পেনের সঙ্গে কাতালোনিয়ার মূল পার্থক্য থেকে যায় ভাষায়।
এখন থেকে চার দশক আগে স্পেন গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করে। তারপর থেকে এই প্রথম মাদ্রিদ (স্পেনের রাজধানী) ও বার্সেলোনার (কাতালানের রাজধানী) মধ্যে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনায় স্বাধীনতা ঘোষণার বিরোধিতা করে দেশের ঐক্যের পক্ষে সমাবেশ করেছে। দেশজুড়ে বিক্ষোভ করে ঐক্যপন্থীরা। তারা কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সরকারকে আলোচনায় বসার দাবি জানায়। প্রায় সাড়ে নয় লাখ লোক বিক্ষোভে যোগ দেয়। যদিও নগর কর্তৃপক্ষের দাবি, বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা ছিল সাড়ে ৩ লাখের মতো। পর্যবেক্ষকদের চোখে কাতালোনিয়ায় প্রদেশের অনেক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এখানে তাদের নিজস্ব পতাকা আছে। একটি পার্লামেন্ট আছে, একজন নেতাও রয়েছেন। এ প্রদেশের নিজস্ব পুলিশ বাহিনী আছে। আছে নিজস্ব সম্প্রচার নিয়ন্ত্রক, এমনকি বিদেশে কিছু মিশন ও মিনি দূতাবাস পরিচালনা করে কাতালোনিয়া। স্বাধীনতা পেলে তাদের আরো অনেক অবকাঠামো সৃষ্টি করতে হবে।
কাতালোনিয়ার একটি জনপ্রিয় স্লোগান হলো- মাদ্রিদ আমাদের লুটে নিচ্ছে। স্পেনের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় কাতালোনিয়া অনেক সম্পদশালী। স্পেনের জিডিপির ১ শতাংশ আর রফতানির এক-চতুর্থাংশ তাদের। পর্যটন শিল্পও বেশ সমৃদ্ধ। স্পেনে গত বছর যে সাড়ে সাত কোটি পর্যটক গেছে তার মধ্যে ১ কোটি ৮০ লাখের গন্তব্য ছিল কাতালোনিয়া। ২০১৪ সালে মাদ্রিদ সরকার যে পরিমাণ অর্থ কাতালোনিয়া সরকারকে দিয়েছে এর চেয়ে ১০ বিলিয়ন ডলার বেশি কর দিয়েছে কাতালানরা। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী কাতালান সরকারের ঘাড়ে ঋণের বোঝা রয়েছে ৭৭ বিলিয়ন ইউরো। এটা তাদের জিডিপির ৩৫.৪ শতাংশ। বৈশ্বিক মন্দার পর ২০১২ সালে প্রদেশগুলোকে নগদ সহায়তা দেওয়ার জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠন করে স্পেন সরকার। এ তহবিলের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী প্রদেশ হলো কাতালোনিয়া। তবুও কাতালোনিয়া স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য উদগ্রীব। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে স্বাধীনতাকামী মানুষের জয় হোক। এটাই আমাদের কামনা।
|