শিল্প-অর্থনীতির উন্নয়নে প্রথম কথা হচ্ছে নিরাপদ শ্রম-পরিবেশ। যেকোনো কারখানায় এ পরিবেশ না থাকলে শিল্পের উৎপাদন বা লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডে অনিরাপদ কর্মপরিবেশে মারা যায় শতাধিক কর্মী; তার বিচারিক কার্যক্রমের মূল জায়গায় না পৌঁছাতেই পেরিয়ে গেছে পাঁচটি বছর। আর ওষুধশিল্প দেশের রফতানি পণ্যের তালিকায় এ বছর দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে-এটা একটা বড় অর্জন। পাশাপাশি কোনো দ্রব্যের মূল্য যদি কয়েক গুণ বেড়ে যায়, তাহলে তা মানুষের জীবনের ব্যক্তিগত আয়ে বাড়তি চাপ ফেলে। এ পর্বের আলোচনায় রয়েছে তিনটি বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার প্রতিফলন। এই বিষয়গুলো নিয়ে আজকের পর্যালোচনা নিবন্ধ।
পেঁয়াজের কেজি ৯০ টাকা : তরিতরকারি দিয়ে ভাত খাওয়া আমাদের নিত্যদিনের খাদ্যাভ্যাস। এই তরকারিতে পেঁয়াজ না হলে যেন চলেই না। রান্নাতে স্বাদ আসে না। বিশেষ করে মাছ-মাংস হলে তো কথায় নেই। পেঁয়াজ অনিবার্য। সেই পেঁয়াজ নিয়ে বলতে হবে চলছে ‘তুঘলকী কান্ড’। গতবারের ২৫ টাকার পেঁয়াজ এবার ৮০-৯০ টাকা। কমার কোনো লক্ষণ নেই। এমনিতে চালের দাম ‘কমবে কমছে’ অবস্থার দোলাচলে দুলছে। কতটা কমে কতটা বেড়েছে, সে নিয়ে প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত। তারপর নিত্যদিনের বাজার খরচে যোগ হয়ে বসে আছে পেঁয়াজের ঊর্ধ্বমূল্য।
রাজধানীর বাজারে আবারও পেঁয়াজের কেজি ৯০ টাকা ছাড়িয়েছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। খুচরা বাজারে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ ৯০-৯৫ টাকা। আর আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকায়। বিক্রেতাদের ভাষ্য, পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ার পর মাঝে কিছুটা কমেছিল। কিন্তু আবার হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে বলেই প্রভাব পড়েছে দেশি পেঁয়াজের দামে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার দর ২৪ নভেম্বরের তথ্য মতে, সেদিন দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৮০-৯০ টাকায়; যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৭০-৮০ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ২৬ শতাংশ। আর আমদানি করা পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭৫ টাকায়; যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫০-৬০ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে এই পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২২ শতাংশ। ভোক্তাদের মতে, বাজারে দেশি বা আমদানি কোনো ধরনের পেঁয়াজেরই কমতি নেই। এখন পেঁয়াজের দাম কমার কথা। কারণ বাজারে কিছু নতুন পেঁয়াজ এসেছে। কিন্তু পেঁয়াজের দাম না কমে বরং বেড়ে গেছে।
পেঁয়াজ নিয়ে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হয় না খুব সহজে এ থেকে নিস্তার পাবেন সাধারণ গ্রাহকরা। যে সময় পেঁয়াজের দাম কমার কথা, সে সময় যদি বাড়ে, তাহলে কমবে কখন। সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর যে অভিযোগ তার একটা সুরাহা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তাও খুব সহসা হচ্ছে বলে মনে হয় না। এবার বন্যা আর পাহাড়ি ঢলের অজুহাতে দফায় দফায় চালের দাম বেড়েছে। সরকার দাম কমানোর লক্ষ্যে সন্দেহমূলক বিভিন্ন গোডাউনে অভিযান চালিয়েছে। তাতে কাজের কাজ কতটা হয়েছে, সে প্রশ্ন আজও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো ঝুলছে। অতিরিক্ত দামের বোঝা এখন জনগণকেই বহন করতে হচ্ছে।
গত বছর রসুনের দাম এভাবে আকাশচুম্বী ছিল। কিছুইতে সে দাম নাগালের ভেতরে আনা যায়নি। বিশ্ববাজারে ঊর্ধ্বগতির সুযোগে সিন্ডিকেটও মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এবার রসুন সুলভ মূল্যে পাওয়া গেলেও পেঁয়াজের নাগাল পাওয়া দুরূহ। আজ রসুন, কাল পেঁয়াজ, পরশু চালÑ এভাবে কি চলতে থাকবে? এই চক্রের মুখোশ উন্মুক্ত করা দরকার। না হলে সচেতন মানুষ এর দায়ভার সরকারের ওপর চাপাবে।
তাজরীনে অগ্নিকাণ্ডের পাঁচ বছর : দেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক। আর দক্ষ হাত দিয়ে কর্মীরা এ পণ্য উৎপাদন করেন। শিল্প-কারখানা সব সময় নিরাপদ হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু না, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, পোশাকশিল্পে অগ্নিকান্ডে সবচেয়ে বেশি পুড়ে মারা গিয়েছিল তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডে। সেই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচারকার্য আজও শুরু হয়নি-এমন সংবাদ গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।
সাভারের আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডে অগ্নিকান্ডের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে গত ২৪ নভেম্বর। দিনটি বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ইতিহাসে একটি ভয়াবহ স্মৃতি। ২০১২ সালের এই দিনে নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে অন্তত ১১৭ শ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা যায়। হতাহত হয় বহু শ্রমিক। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও হৃদয়বিদারক এই ঘটনা ভুলতে পারেনি নিহত ও আহত শ্রমিকদের পরিবার। নিহত শ্রমিকদের পরিবার বয়ে বেড়াচ্ছে স্বজন হারানোর বেদনা। আর দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণ করা শ্রমিকদের নিয়ে নিদারুণ কষ্টে আছে তাদের পরিবার। তাজরীন ট্র্যাজেডির পাঁচ বছরপূর্তি উপলক্ষে হতাহত শ্রমিকদের স্বজনসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের ফটকের সামনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের সামনে মানববন্ধন শেষে বিক্ষোভ মিছিল করেন। শ্রমিক নেতারা তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের অবিলম্বে ক্ষতিপূরণ দেওয়াসহ এর মালিক দেলোয়ার হোসেনের কঠোর শাস্তি দাবি করেন।
এদিকে তাজরীন ট্র্যাজেডির পাঁচ বছর পূর্তিতে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সভাপতি অ্যাডভোকেট মন্টু ঘোষ ও সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার এক বিবৃতিতে তাজরীনের ঘটনার বিচারের দীর্ঘসূত্রতার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তাদের ভাষ্য, ১৯৯০ সালে সারাকা গার্মেন্টসে আগুনে পুড়ে শ্রমিক নিহতের ঘটনা থেকে সাম্প্রতিক মাল্টিফ্যাবস কারখানায় শ্রমিক নিহত হওয়া পর্যন্ত কোনো ঘটনার বিচারই আলোর মুখ দেখেনি। ফলে বিচারহীনতার সুযোগে একের পর এক শ্রমিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হচ্ছে। তাজরীন হত্যাকান্ডের তিন বছর পর অভিযোগপত্র গঠন করা হয়। গত দুই বছরে ১৯টি শুনানির তারিখ নির্ধারিত হলেও রাষ্ট্রপক্ষ এ সময়ে মাত্র তিনজন সাক্ষীকে হাজির করেছে। ফলে ১০৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ কবে শেষ হবে, তা আজ বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিটি রফতানিমুখী কারখানা যদি শতভাগ নিরাপদ না হয়, তাহলে কর্মীদের শঙ্কার মধ্যে কাজ করতে হবে। এতে পূর্ণমাত্রার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ারই কথা। মানেও প্রভাব পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে কারখানায় নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলে কর্মীবান্ধব করা নৈতিক দায়িত্ব। এতে মালিকদের অবশ্য সচেতন হতে হবে। শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক শঙ্কামুক্ত না হলে শিল্প আপন গতিতে চলতে পারে না। শিল্পের স্বার্থে সবার জবাবদিহিতা থাকা দরকার। তাজরীন ফ্যাশনসে যে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেছে তার বিচারপ্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়। এতে যেমন মালিকদের জবাবদিহি বাড়বে তেমন শিল্প হবে পরিবেশবান্ধব। কারো খামখেয়ালির দায় শিল্পের ওপর পড়তে পারে না। আইনকে তার আপন গতিতে চলতে দেওয়া উচিত। এতে দেশ ও শিল্প সুশৃঙ্খল হবে।
দ্বিতীয় প্রধান রফতানি পণ্য ওষুধ : প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশের ওষুধশিল্প রফতানিমুখী। বড়ই আনন্দের সংবাদ, বাংলাদেশের চেয়ে সবদিক থেকে উন্নত অনেক দেশে আমাদের দক্ষ হাতে তৈরি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ রফতানি হচ্ছে। এই সূক্ষ্ম শিল্পের কারিগর আমরা। এ শিল্প আজ দেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাতে পরিণত হয়েছে। এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে।
সংবাদে বলা হয়েছে, এক সময় চাহিদার ৭০ শতাংশ ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি হতো। আর এখন দেশের চাহিদার ৯৮ শতাংশ মিটিয়ে বিশ্বের ১২৭ দেশে বাংলাদেশে প্রস্তুত ওষুধ রফতানি হচ্ছে। বিশ্বমানের ওষুধ এত কম দামে আর কোথাও পাওয়া যায় না। এ ছাড়া ওষুধ প্রযুক্তি ও কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাংলাদেশ।
বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরেই প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার ওষুধের বাজার। আর বছরে প্রায় ১০০০ কোটি টাকার ওষুধ রফতানি হয়। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির (বিএএসএস) প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়েছে।
বর্তমানে দেশের দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান পাঁচ হাজার ব্র্যান্ডের আট হাজারের বেশি ওষুধ উৎপাদন করছে, যার মধ্যে বড় ১০ কোম্পানি দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশ মিটিয়ে থাকে। বড় ২০ কোম্পানি বিবেচনায় নিলে তারা মোট চাহিদার ৯০ শতাংশ সরবরাহ করছে। আর ৪০ কোম্পানি ১৮২টি ব্র্যান্ডের সহস্রাধিক রকমের ওষুধ রফতানি করছে।
আমাদের শিল্পের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ এবং এসবের মূল্যের মাত্রা যেন শিল্পসহায়ক হয়- এমন প্রত্যাশা শিল্পমালিকদের। গামের্›ট শিল্পমালিকদের পাশাপাশি ওষুধ শিল্পমালিকরা একই কথা বলছেন। আসলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নিয়ে সরকারের আরো ভাবা দরকার। জ্বালানি উৎপাদনের সঙ্গে সরবরাহ মূল্যের যেমন সমন্বয় থাকা দরকার, তেমন শিল্পের জন্য নির্ধারিত ওই মূল্য কতটা সহনীয় সেটাও ভাবা দরকার।
|