মানবজীবনের অসামান্যতা ও অসাধারণত্বকেই প্রতিভা হিসেবে ধরা হয়। অসামান্য উদ্ভাবনী শক্তি প্রতিভার প্রথম ও মৌলিক শর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় মানুষের সৃষ্টিশীল কাজে, উদ্ভাবনী শক্তিতে, বিস্ময়কর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। এমন কিছু জটিল সমস্যার সমাধান এমনভাবে দিয়ে যেটা সাধারণ কারো পক্ষে কষ্টসাধ্য ও কল্পনাতীত ব্যাপার। শিল্পে, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, খেলাধুলায় সর্বত্রই প্রতিভা তার বিশেষ দ্যুতিময় অস্তিত্ব দিয়ে সর্বস্তরের মানুষকে বিমুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে। প্রতিভা ইংরেজি Genius শব্দের প্রতিশব্দ। প্রতিভা মূলত একটা বিশেষ্য পদ। যার অর্থ হচ্ছে প্রজ্ঞা, প্রভা, দীপ্তি, উদ্ভাবনী শক্তি, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। প্রতিভা শব্দটির পূূর্ব শব্দ হিসেবে ধরা হয় প্রতিবোধ বা প্রতিবোধন। যার অর্থ প্রকাশ বা জাগরণ।
অসাধারণ সৃজনীশক্তি, ব্যতিক্রমধর্মী বুদ্ধিমত্তাবিশিষ্ট গুণাবলি যার ভেতর পরিলক্ষিত হয় না আর যায় হোক তাকে প্রতিভাবান বলা চলে না। অন্তর্নিহিত ব্যতিক্রমধর্মী বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার সক্ষমতা, সৃজনশীলতা অথবা জন্মগত ও প্রকৃতিগতভাবে একে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হন। যিনি এ গুণাবলির অধিকারী তিনি প্রতিভাবান হিসেবে চিহ্নিত। জনগণ পৃথক চিন্তাচেতনায় কোনো ব্যক্তির চাতুর্র্যতা, উপস্থিত ও তীক্ষè বুদ্ধিকে প্রতিভারূপে আখ্যায়িত করে থাকে। প্রতিভার বিজ্ঞানসম্মত কোনো ব্যাখ্যা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। প্রতিভা শব্দটিকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নির্দিষ্ট অনেকগুলো বিষয়ে দক্ষ অথবা শুধু একটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। কী কারণে প্রতিভা এবং দক্ষতা প্রদর্শিত হয় এ-সংক্রান্ত গবেষণা কর্মশৈশবেই রয়েছে। কিন্তু মনোবিজ্ঞানে ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে। মূলত প্রতিভার মূলে অলৌকিকত্ব, আবেগ, ইচ্ছা ও প্রেরণা যাই থাকুক না কেন সাধনা ছাড়া প্রতিভার বিন্দুমাত্র দাম নেই। কেননা প্রতিভা মানুষের ভেতর সুপ্ত অবস্থায় থাকে। আপনা-আপনি বের হয়ে আসে না বা প্রকাশ পায় না। এটাকে সাধনা ও কঠোর ত্যাগের মাধ্যমেই বের করে আনতে হয়। রুশ বিজ্ঞানী ইভান পাভলভ মনে করেন, সৃষ্টিশীলতার অপরিহার্য শর্ত হলো অসাধারণ ধৈর্য ও নিরন্তন সাধনা। প্রতিভাবান এই বিজ্ঞানী নিজেই তার এ কথার উদাহরণ। বিখ্যাত প্রকৃতি বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন তার যুগান্তকারী গ্রন্থ Origin of species লেখার জন্য বিশ বছর ধরে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। মহাকবি ফেরদৌসি ত্রিশ বছর ধরে রচনা করেছেন মহাকাব্য : শাহানামা। এগুলোর মানে এই নয় যে, এগুলো তিনারা শুধু তিনাদের প্রতিভার বলেই করেছেন। প্রতিভার সঙ্গে তিনাদের ভেতরে জাগ্রত ছিল এক অসাধারণ ধৈর্য ও নিরন্তন সাধনা। সপ্তদশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত ইংরেজি লেখক, কবি ও নাট্যকার জন ড্রাইডেন বলেছেন, প্রতিভা তৈরি করা সম্ভব নয় এটা জন্ম থেকেই আসে এবং নিখুঁত পরিচর্চার মাধ্যমে সেটাকে বের করে সভ্যতার মঙ্গলে লাগাতে হয়।
যেমন বহুমুখী প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেবে স্যার আইজাক নিউটন কিংবা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির নাম আধুনিক সভ্যসমাজে সর্বজনস্বীকৃত। এ ছাড়া নিকোলা টেসলা, আলবার্ট আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিং প্রমুখ ব্যক্তিগতও অত্যন্ত সুপরিচিত। আলবার্ট আইনস্টাইনকে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রতিভাবান ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি অনন্য সাধারণ গুণাবলির পাশাপাশি গণিতে অত্যন্ত সিদ্ধহস্তের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষত ভাষা বিষয়ে যথেষ্ট নৈপুণ্য প্রদর্শন করতে পারেননি। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এবং জোহন ওল্ফগ্যাং ভন গ্যাটে প্রমুখ ব্যক্তিরাও অসাধারণ প্রতিভাশালী ছিলেন। তারা বিভিন্ন বিষয়ে যথেষ্ট পারঙ্গমতা প্রদর্শন ও সক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রতিভা সাধারণত জন্মগত বৈশিষ্ট্য, যা শৈশবকালীন শিশুদের মধ্যে দেখা যায় যা তাকে প্রতিভাবান হিসেবে সমাজ কর্তৃক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। মেধা প্রতিভার সমমর্যাদাসম্পন্ন ও সমমানের অধিকারী নয়। মেধা একটি বিশেষ গুণাবলি ও দক্ষতাবিশেষ, যা দ্রুত আয়ত্ত কিংবা শেখার সক্ষমতা অর্জন করতে সাহায্য করে। অন্যদিকে একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি খুবই সৃজনশীলতার অধিকারী এবং অসম্ভব যেকোনো ধরনের কার্যসম্পাদন করতে পারেন যা কেউ, কখনো কল্পনাও করতে পারেন না মানুষ বিবেকবুদ্ধি-সম্পন্ন সবচেয়ে অনুকরণপ্রিয় জীব। কেননা মানুষের বুদ্ধিও চর্চা ও এর বিকাশ মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীবের আসনে অধিষ্ঠিত করতে পারে। সৃষ্টিকুলের মধ্যে মানুষই একমাত্র বিবেকবুদ্ধি-সম্পন্ন। জ্ঞানানুশীলন, নিরবচ্ছিন্ন অধ্যবসায় ও কঠোর সাধনা, পরিশ্রম ইত্যাদি প্রতিভা বিকাশের জন্য প্রয়োজন। যে ব্যক্তি যত বেশি জ্ঞানচর্চা করবে, সাধনা করবে, নিরলস পরিশ্রম করতে যে তত বেশি তার প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারবে। প্রতিভা এমন জিনিসের নাম যাকে জাগ্রত করতে কঠোর সাধনা ও অনুশীলনের প্রয়োজন হয়। প্রতিভা ও সাধনা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। বিধাতা প্রদত্ত বিবেক, জ্ঞান, বুদ্ধি, শক্তি যথাযথ কাজে লাগাতে না পারলে যেমন জীবনে কিছুই করা যায় না। ঠিক একইভাবে প্রতিভার ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে কোনো কিছুই আশা করা যায় না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজের নানা রকম বিপর্যয় বিপ্লব, গণজাগরণ অভ্যুদয়, যুদ্ধ সবকিছুকে উপেক্ষা করেও প্রতিভা বিকাশের জন্য নিরঙ্কুশ সাধনা করেছেন। একজন মা যেমন তার ছোট্ট অবুঝ না জানা, না বোঝা শিশুকে অধিক আদর স্নেহে লালন পালন করে বড় করে তোলেন। ইতিহাস খুলে দেখেন এই পৃথিবীর সব প্রতিভাবান ব্যক্তিও ঠিক একইভাবে তার ভেতরের প্রতিভাকে লালন-পালন করে জাগ্রত রেখেছেন এবং একসময় নিজেকে একজন প্রতিভাবান হিসেবে পুরো বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। যত্ন না করলে প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটে।
প্রতিভা একটা স্বতন্ত্র গুণের অস্তিত্বও স্বতন্ত্র। নিজের কাছে নিজেই প্রতিভাবান দাবি করলেই আপনাকে কেউই প্রতিভাবান বলে খ্যাত বা বিবেচনা করবেন না। আপনার প্রতিভার বলে আমাকে করে দেখাতে হবে নতুন কিছু। আপনি এখন ইতিহাস খুঁজে বেড়ালেও আপনার প্রতিভার যথাযথ প্রয়োগ দেখাতে পারলে তখন ইতিহাস আপনাকে খুঁজে নেবে। তার নিজের ভেতরে আপনাকে স্থান দেবে—এটাই নিয়ম।
অনেক বিজ্ঞানীই দাবি করেছেন প্রতিভা বলে কিছুই নেই। সবই অধ্যাবসায় ও পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। আসলেই এমনটা নয় বোধ হয়। কেননা এক আর এক এর যোগেই দুই হয়। তাই তো শুধু পরিশ্রম নয়। প্রতিভার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা আপনি যদি কালি ফুরানো কলম দিয়ে সারা দিন কোনো খাতায় লিখে যান তাহলে দিন শেষে এমনটা হবে যে আপনার সমস্ত খাতা ঠিক আগের মতোই সাদা রয়েছে, লেখার কোনো চিহ্ন নেই। সবই পণ্ডশ্রম। এখানে কলমের কালিই হলো প্রতিভা। প্রতিভা সবার মধ্যে থাকে না। তাই তো প্রতিভার সন্ধান পেলে সেটার সঠিক পরিচর্যা করতে হয়। তার যথাযথ বিকাশের সুযোগ দিতে হয়। বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিতে হয়। তবেই প্রতিভা তার সম্পূর্ণ স্পৃহা নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে এবং সেই প্রতিভাই সম্ভাবনাময় প্রাচুর্যপূর্ণতা দান করে মানবজাতিকে কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে পারবে।
এ কথা একদম খাঁটি যে, সমাজ ও সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যান প্রতিভাবানরাই। তারাই মূলত সময়ের বিবেক। তারা মানব মিছিলের অগ্রভাগে থাকেন। সাধারণ মানুষদের তারা অনুপ্রাণিত করেন। সাহসের জোগান দেন। সামাজিক দায়িত্ব বোধকে জাগ্রত করতে সহায়তা করেন। তাই তো আমাদের উচিত প্রতিভার সঠিক পরিচর্চা ও প্রতিভাবানদের সঠিক সম্মান প্রদর্শন করা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘যে দেশে গুণের কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মায় না।’ তাই তো আমাদের গুণী ব্যক্তিদের যথাযথ সম্মান করতে হবে। গুণের পরিচর্চা করেই সে গুণকে পরিবর্ধন করতে হবে। প্রতিভার আলোয় আলোকিত করতে হবে সারা দেশ, সমাজ তথা পুরো বিশ্বকে।