ঘড়ি প্রতীক নিয়ে, সময়কে বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, নগরপিতার মুকুট পরেছিলেন একজন যাদুকর। তার কণ্ঠে এক অনন্য ছন্দময়তা। প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ। আশাবাদী উচ্চারণ। তিনি গণমানুষকে এক বদলে যাওয়া ঢাকার স্বপ্নের গল্প শোনালেন। সে গল্পের নাম রাখা হলো, ‘সমাধান যাত্রা’। সময়টা ২০১৫ এপ্রিল মাস। যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানো ঢাকাবাসী তখন একজন আস্থাবান মানুষকে খুঁজছিল। একজন যোগ্য নেতাকে খুঁজছিল। একজন যোগ্য পিতাকে খুঁজছিলেন। ঠিক সে সময় গণমানুষের প্রতিচ্ছবি হয়ে রাজনীতিতে এলেন আনিসুল হক। পেশায় ব্যবসায়ী। যে নামের মধ্যে ঢাকাবাসী পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতে থাকলো। সমাধানের সব সূত্র খুঁজে পেল।
দলমত ভেদে সবাই আনিসুল হককে ঢাকা বিনির্মাণের মহানায়ক মনে করলেন। যদিও আনিসুল হক বলতেন, আমি নগর পিতা নই। আমি আপনাদেরই একজন। আপনারা জিতলে আমি জিতবো। আপনারা হারলে আমিও হেরে যাবো। নিজের চোখে কোটি মানুষের স্বপ্ন গাঁথলেন আনিসুল হক। এগিয়ে চললেন সামনে। আলোর পথে এগিয়ে চললেন। সমাধানের পথে এগিয়ে চললেন। ঢাকাকে সুন্দর করার পথে এগিয়ে চললেন। কিন্তু সে চলা শেষ না করেই ছেড়ে গেলেন আমাদের।
নির্বাচিত হওয়ার কয়েকমাসের মধ্যে, তিনি তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ডের সামনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেন। দখলমুক্ত করেন সড়ক। যে কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রথম প্রতিরোধের মুখোমুখি হন। চালকদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি। কিন্তু থেমে যাননি। ভয়, হুমকি কোন কিছুই তাকে অবস্থান থেকে সরাতে পারেনি। চলতে থাকে ঢাকাকে যানজটমুক্তকরণ কাজ। এগিয়ে চলে ঢাকাকে বাসযোগ্যকরণ কাজ। গুলশান, বনানী, বারিধারা ও নিকেতন এলাকায় বিশেষ রঙের রিকশা চালু করেন।
‘ঢাকা চাকা’ নামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস সেবা চালু হয় উত্তর ঢাকায়। গুলশান এলাকায় গণপরিবহনের চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েন। কিন্তু থেমে যাননি। বিমানবন্দর সড়কে যানজট কমাতে মহাখালী থেকে উত্তরা পর্যন্ত ১১টি ইউটার্ন নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এছাড়া ঢাকাকে সুন্দর করার আরও অসংখ্য উদ্যোগ আজ চলমান। শুধু তিনি নেই।
ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে আসা আমরা অনেকেই পছন্দ করি না। সমালোচনা করি। খারাপভাবে ব্যাখ্যা করি। কিন্তু আনিসুল হককে রাজনীতিতে পেয়ে সমালোচকরাও চুপ রইলো। সবাই তার ভেতরে ঢাকা শহরের ৪০০ বছরের পুরোনো সমস্যার সমাধান দেখতে পেল। রাজনীতিতে তার আগমন ছিল কিছুটা আকস্মিক। তাই তো আনিসুল হক প্রায়ই বলতেন, শেখ হাসিনার এক ফুঁয়ে তিনি নেতা হয়ে গেলেন।
জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে কাজ শুরু করেন। কিন্তু আনিসুল হক, কাজ শুরু করে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ঢাকা শহরের সমস্যাগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে চিহ্ণিত করতে পেরেছিলেন। তাই তো তার কাজ শুরু হয়েছিল সমাধান দিয়ে। সমস্যা চিহ্ণিতকরণ দিয়ে নয়। ফলে তিনি অন্যসবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। তিনি তার নির্বাচনী ইশতেহারে ছয়টি কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যে কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারলে হয়তো ঢাকা শহর হয়ে উঠতো ‘পরিচ্ছন্ন-সবুজ-আলোকিত-মানবিক ঢাকা’। আনিসুল হক তার নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকা শহরের মানুষের মুক্তির কথা বলেছিলেন। আমাদের অপেক্ষাটা ছিল তা বাস্তবায়নের। তাঁর নির্বাচনী ইশতেহার ছিল মাত্র ১১ পৃষ্ঠার। যার প্রতিটি শব্দ ছিল প্রত্যয়ী ও সাহসী। প্রতিটি শব্দ ছিল গণমানুষের কাছে স্বপ্নসমান। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন, সবুজ ও পরিবেশবান্ধব করবেন। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর করবেন।
যানজটে অচল হয়ে যাওয়া ঢাকাকে আবার সচল করবেন। ঢাকাকে মানবিক বোধসম্পন্ন করে তুলবেন। স্মার্ট ও ডিজিটাল ঢাকা গড়ার স্বপ্নও দেখতেন তিনি। স্বপ্ন দেখতেন অংশগ্রহণমূলক ও সুশাসিত ঢাকা গড়ার। এইসব স্বপ্নের কোনোটিই তাঁর কাছে অলীক নয়। এইসব স্বপ্ন তিনি শুধু দেখতেনই না। বরং কিভাবে তা বাস্তবায়ন করবেন তার একটি রূপরেখাও তিনি দাঁড় করিয়েছিলেন।
আনিসুল হকের পরিচয়ের শুরুটা টিভি উপস্থাপক হিসেবে। ১৯৯৫ সালে বিটিভিতে প্রচারিত জলসা অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ছিলেন তিনি। তার উপস্থাপনায় আনন্দমেলা ও অন্তরালে অনুষ্ঠান দুটি সেসময় বেশ জনপ্রিয়তা পায়। লেখাপড়া করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্থনীতি বিষয়ে। কিছুদিন চাকরী করেন। আশির দশকে জড়িয়ে পড়েন ব্যবসায়ে। ব্যবসায়ী মানুষরা সাধারণত একটু কম রসবোধের হয়।
কিন্তু তিনি সেরকম ছিলেন না। ছিলেন অন্যরকম। অসাধারণ করে কথা বলতেন। জ্ঞানগর্ভ কথা বলতেন। তাঁর বলায় ছিল দর্শন। কেমন যেনো এক সম্মোহন ছিল তাতে। তিনি মানুষকে কল্পলোকে নিয়ে যেতে পারতেন। আনিসুল হক ২০০৫-০৬ সালে বিজিএমইএর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে তিনি হন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি। ব্যবসায়ী হয়ে তিনি কিভাবে জাদুময় কথা বলতেন তা আজও অনেকের কাছে বিস্ময়। তিনি মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পারতেন। তিনি বদলে দেওয়ার কথা বলতেন। অসুন্দরকে জয় করার কথা বলতেন।
অবশ্য শেষজীবনে তাকে আর ব্যবসায়ী হিসেবে তাকে আর দেখা যায় নি। দেখা গেছে নেতা হিসেবে। একজন সুভাষী হিসেবে। একজন বক্তা হিসেবে। তিনি মানুষকে ঐতিহাসিক ঢাকা শহরের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা ইতিহাস, ঐতিহ্য পুনঃবিনির্মাণের গল্প বলতেন। যে গল্পের বাস্তবায়ন অপূর্ণই রয়ে গেল।
তাঁর গল্পগুলোর মধ্যে মানবিক ঢাকা বিনির্মাণের গল্পটা ছিল বেশি সুন্দর। তিনি বলতেন, ঢাকা হবে গরিব-ধনী সবার জন্য মানবিক এক শহর। মানুষের অধিকার থাকবে সুরক্ষিত। ঢাকা উত্তর হবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান উপযোগী একটি নগরী। কর্মজীবী মায়েদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টারের কথা বলতেন তিনি। গার্মেন্টস, পরিবহনসহ অন্যান্য খাতের শ্রমজীবী ও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য স্বল্প আয়ের আবাসনের চিন্তা ছিল তার পরিকল্পনায়।
সিটি কর্পোরেশনের অনুদান তহবিল প্রতিষ্ঠা ও ডিএনসিসির উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারিগরি ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা স্বপ্নও তিনি দেখতেন। তিনি আশাবাদী ছিলেন, সবাই মিলে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও নিরাপদ ঢাকা গড়ে তুলতে পারব আমরা। দায়িত্ব পালনে তিনি সবসময় নিজেকে নিরপেক্ষ রেখেছেন। তিনি বলতেন, নগর ভবন কোনো দলীয় কার্যালয় হবে না। সবার অংশগ্রহণে ঢাকা পরিচালিত হওয়ার কথা বলতেন তিনি। বলতেন, আমি নগরীর পিতা নই, আমি আপনাদের বন্ধু।
আনিসুল হকরা ক্ষণজন্মা। সমাধানযাত্রার মহাপ্রত্যয় নিয়ে তার আগমন। কিন্তু বড় বেশি দ্রুত চলে গেলেন তিনি। এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো বাংলাদেশের। এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো, ঢাকার পরিবর্তনযাত্রায়। আনিসুল হক ঢাকার অসুন্দরের সময় চাকাকে ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন সুন্দরের সুবাতাস বয়ে দিতে। শেষ হলো না সেই স্বপ্নযাত্রা। মাত্র ৬৫ বছর বয়সেই চলে যেতে হলো তাঁকে। তবে রেখে গেলেন একরাশ স্বপ্নের পথরেখা। যে পথরেখা বদলে দিতে পারে ঢাকাকে। বদলে দিতে পারে আমাদের। আনিসুল হকরা মরেন না। বেঁচে থাকেন। বেঁচে থাকবেন বহুদিন, অন্যের মাঝে। আমাদের রাজধানীর উন্নয়নের মাঝে। আনিসুল হক নেই। এই খবরটির জন্য আমরা প্রস্তুত নই। ছিলামও না। স্বপ্নযাত্রার মহানায়কের জন্য শান্তি কামনা।
আনিসুল হকের মতো প্রত্যয়ী, প্রতিশ্রুতিশীল ও সাহসী মানুষের পথরেখায় বিনির্মিত হোক মানবিক ঢাকা। বিনির্মিত হোক মানবিক বাংলাদেশ। উমর ফারুক : অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস্ বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
|