আমার বাবা-মা দুজনেই প্রচণ্ড দেশপ্রেমিক। বলা যায় একধরনের অন্ধপ্রেম। দেশ সম্পর্কে কোনো রকমের বিরূপ মন্তব্য তাঁরা পছন্দ করেন না। সবাই যখন ট্রাফিক জ্যাম নিয়ে অতিষ্ঠ বা প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ, তখনো তাঁরা পারতপক্ষে এ বিষয়ে মুখ খোলেন না। দেশের ডাক্তারদের নিয়েও সবার অভিযোগ, কিন্তু তাঁদের কাছে তাঁদের ডাক্তারেরা সবাই খুব ভালো। ফিজিক্যাল থেরাপি করায় যে মেয়ে, সে–ও খুব ভালো—মেয়ের মতো।
প্রচণ্ড দেশপ্রেমী এই মানুষ দুজন বছর দু–এক আগে আমার এখানে বেড়াতে এসে আমার বাড়ির পেছনের ছোট্ট সবজি বাগান দেখে অত্যন্ত আনন্দিত। প্রায় প্রতিদিন দু–চারটা সবজি হাতে করে তুলে নিয়ে আসেন আর সেগুলো খুব আগ্রহ নিয়ে রান্না করে খান। একদিন মুখ ফসকে বলে ফেললেন, তোমাদের এখানে সবজি কি তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়ে যায়। ঢাকায় এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সবজি পানি দিয়েও সেদ্ধ হয় না। ডাল দেখেও খুব অবাক। এত তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়!
আমার এত মায়া লাগল। বয়স্ক দুজন মানুষ। শাকসবজিই বলতে গেলে এখন একটু পছন্দ করেই খান। এটুকু খাওয়াও দেশে শান্তি করে খেতে পারেন না। সামান্য সবজি। আহামরি কোনো খাবার নয়। শ্বশুর বা শাশুড়ি মা বেড়াতে এলেও দেখি একই রকম ঘটনা। খুব আগ্রহ নিয়ে নিশ্চিন্তে ফল খান। দেশে ফল পানিতে ভেজাও। আরও বিভিন্ন সতর্কতা নিয়ে তারপরে ভয়ে ভয়ে খাওয়া। এর চেয়ে না খেয়ে থাকাও ভালো। আত্মীয়স্বজন অনেককেই দেখি বাচ্চাদের ফলমূল খেতে দিতে ভয় পান। মাছে ফরমালিনের ভয় পান। এমনকি ছোট বাচ্চারা মিষ্টি খেতে ভালোবাসে। সেই মিষ্টি খেয়েও পেটের সমস্যা, বমি। দেশে ক্যানসার, কিডনি, অবিসিটি, ডায়াবেটিস, হৃদ্যন্ত্রের সমস্যা বেড়েছে ব্যাপক হারে। এসব দুরারোগ্য ব্যাধি বেড়েছে খাদ্যজনিত সমস্যার সরাসরি কুফলের কারণে।
ব্যাধির কথা যখন এলই তখন চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা বলি একটু। এক পরিচিত মুরুব্বির ডায়াবেটিস দ্রুতগতিতে বেড়ে যাচ্ছে। স্যালাইন দিয়েও কমছে না। বারডেম থেকে কেনা স্যালাইন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো বাধ্য হয়ে। রোগিণীর ডাক্তার মেয়ের এক সময় সন্দেহ দেখা দেয়। স্যালাইনটি পরীক্ষা করে দেখা গেল সেখানে ভাতের মাড় দেওয়া। ডায়াবেটিস রোগীকে সরাসরি মেরে ফেলার ব্যবস্থা। কয়েক দিন আগে দেখলাম এক সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে সিজারিয়ানের হার অনেক অনেক বেশি। বিনা প্রয়োজনে এই সিজারিয়ান। শুধু গত বছরেই পরিচিতদের মধ্যে ডায়ালাইসিসের কয়েকজন রোগী বিদেশ থেকে দেশে যাওয়ার পরপরই মারা যান। কিছুদিন আগেই পত্রিকায় পড়লাম এক গর্ভবতী নারী রাস্তার ফুটপাথে সন্তান প্রসব করেছেন। অ্যাম্বুলেন্স আসতে আসতে মৃতপ্রায় রোগী মারা যাওয়া এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। খাদ্যে সমস্যা, চিকিৎসায় সমস্যা। বাকি থাকল কী? এর চেয়েও বড় সমস্যা আছে। সেটা হলো শিক্ষা। শিক্ষাব্যবস্থার কথা কোথা থেকে শুরু করব জানি না। কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট পড়া এগুলো হলো এখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড। সন্তানের শিক্ষার গগনচুম্বী খরচ আর অফুরন্ত সময় দিতে গিয়ে বাবা–মা দেউলিয়া। ফলাফল প্রশ্নপত্র ফাঁস। না গ্রামের অখ্যাত স্কুল নয়, রাজধানী ঢাকার নামী স্কুল–কলেজের চিত্র এগুলো। ভর্তি পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়ে যায়। এ জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে এর চেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র আর কিছু কি আছে? পরীক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে নিত্যনতুন এক্সপেরিমেন্ট চলছে। যে পরিমাণ চাপ বাচ্চাদের ওপর দেওয়া হয়, সে পরিমাণ চাপ নেওয়ার ক্ষমতা সাধারণ শিশুর আছে কি না, সেটা কি কেউ ভেবে দেখছেন? এতে কি আদৌ শিশুদের শিক্ষার ভিত মজবুত হচ্ছে? এর প্রয়োজনীয়তা কী? জানার ও শেখার যে আনন্দ আছে শৈশবেই সে আনন্দকে মেরে ফেলার চেষ্টা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চাপ বাড়ছে আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নৈতিক শিক্ষার চরম অবনতি হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ড্রাগস, মাদক দ্রব্যের ব্যবহার বেড়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। বেড়ে উঠছে ঐশীরা, যারা নিজের বাবা মাকে হত্যা করার মতো ভয়াবহ অপরাধ করতেও পিছু হটছে না। কয়েক দিন আগে পত্রিকায় দেখলাম মাদ্রাসার এক ১৬ বছরের ছাত্র ১২ বছরের আরেক ছাত্রকে হত্যা করেছে। না, এগুলো আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্রতিদিন যখন এ রকম দু–চারটা ঘটনা ঘটে সেগুলোকে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যায় না। মানুষের বিশেষ করে তরুণ–তরুণীদের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে দেশে মেয়েদের নিরাপত্তা কঠিন হুমকির সম্মুখীন। জন্মদিনের পার্টিতে ডেকে নিয়ে দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনা তোলপাড় তৈরি করেছে বলে সেটা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কিন্তু এক পরিচিত ডাক্তারের মুখে শুনেছি কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ওপরে করা এক সমীক্ষা থেকে তাঁরা জানতে পেরেছেন, কলেজগামী প্রচুর ছাত্রছাত্রী যৌন সম্পর্কে লিপ্ত। বর্তমান যুগের তরুণ–তরুণীদের মধ্যে যেটা লক্ষণীয়, সেটা হলো এরা দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কে আগ্রহী নয়, একাধিক সম্পর্ক ভাঙা গড়াকে এরা খুব সাধারণভাবে নিচ্ছে। এটা নিয়ে এরা একদমই লজ্জিত নয় এবং নির্দ্বিধায়, গর্ব ভরে এরা এগুলো নিয়ে আলোচনা করে। এত গেল স্বেচ্ছায় জড়ানো সম্পর্ক। কিন্তু আরও দুর্ভাবনার বিষয় হলো পথেঘাটে মেয়েদের হেনস্তা। তনুর ধর্ষণ–মৃত্যুর রেশ শেষ হতে না হতেই বাসে ধর্ষিত হলো আরেক তরুণী। তারপরে মৃত্যু। কিছুদিন আগ পর্যন্ত বাসে ভিড়ে মেয়েদের গা স্পর্শ করা পর্যন্ত শোনা যেত। আজকাল শুনি ব্লেড দিয়ে কাপড় কেটে দেওয়ার কথা। শুনি গোপনে ভিডিও করার কথা। সেসব ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেওয়ার কথা। শুনি বাসে–ট্যাক্সিতে মেয়েদের সামনে মাস্টারবেশনের কথা। ওড়না ধরে টানাটানির কথা। মদ্যপান, সিসা, ক্লাব, অশ্লীল পোশাক, পর্নোগ্রাফি সবকিছুই সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে গেছে। আমাদের আরও অনেক প্রকট সব সমস্যা আছে। ট্র্যাফিক জ্যাম। অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা নগরী, মশা, পরিবেশদূষণ, বন্যা, দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতি, নদীর পানি, সড়ক দুর্ঘটনা—এগুলো সবকিছু ছাপিয়ে যে জিনিসটা নাগরিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে সেটা হলো মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার আর অনিয়ম। দেশের কোথায় দুর্নীতি নেই? একজন সামান্য সরকারি কর্মচারী তার পেনশনের টাকা, যেটা তার সর্বস্ব, সেই পাওনা টাকাটা তুলতে গেলেও ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ দিয়ে অন্যায় অপরাধ ঢেকে ফেলা যায়। ক্ষমতার অপব্যবহার করাও যায়। কারও কিছু করার নেই মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া। আর কতকাল এ দেশের মানুষ মুখ বুজে থাকবেন?