মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন কোনো মানুষ দাঁড়াতে পারে না, ঠিক তেমনি শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। আর এ কারণেই বলা হয় ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। বর্তমান সময় এমন হয়েছে, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী জাতির মেরুদণ্ডকে ভেঙে দিতে চায়। তাই বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই বলতে বাধ্য ‘সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। কারণ, সব শিক্ষা জাতিকে উঁচু করে দাঁড় করাতে পারে না। শিক্ষার অপব্যবহারের ফলে জাতি আজ দুর্নীতিগ্রস্ত, লিপ্ত অন্যায় অপরাধে। লিপ্ত প্রশ্নপত্র ফাঁসে।
পরীক্ষা মেধাবী শিক্ষার্থী গঠন ও বাছাইকরণের অন্যতম পন্থা। পরীক্ষার মাধ্যমে মানুষ সম্মানিত বা অপমানিত হয়। যারা কঠোর পরিশ্রম করে লেখাপড়া করে তারাই ভালো ফলাফল অর্জন করে, অথবা তারা ভালো ফলাফলের আশাবাদী। আমাদের দেশে এখন আর লেখাপড়া করতে হয় না। লেখাপড়া না করেও এ+ পাওয়ার আশা করে বসে থাকে। আর করবেই না কেন? পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র হাতে পেলে আর লেখাপড়া করতে হয় নাকি? আরো আপডেটভাবে বলতে হয়, শুধু প্রশ্নপত্র নয়, এখন প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মিলছে উত্তরপত্রও। যেমন : চলমান এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা এবং বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় সাম্প্রতিক সময়ে প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। যে অভিযোগগুলো সত্য বটে।
১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বাংলা প্রথম পত্রের বহুনির্বাচনী অভীক্ষার ‘খ’ সেট পরীক্ষার প্রশ্ন ও ফেসবুকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের হুবহু মিল ছিল। পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগেই তা ফেসবুকে পাওয়া যায়। ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সকালে পরীক্ষা শুরুর প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের নৈর্ব্যক্তিক (বহুনির্বাচনী) অভীক্ষার ‘খ’ সেটের উত্তরসহ প্রশ্নপত্র পাওয়া যায় ফেসবুকে। যার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া যায়। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ পরীক্ষা শুরুর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে সকাল ৮টা ৪ মিনিটে ইংরেজি প্রথম পত্রের ‘ক’ সেটের প্রশ্ন ফাঁস হয়। যার সঙ্গে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। ৭ ফেব্রুয়ারি বুধবার পরীক্ষা শুরুর অন্তত ৪৮ মিনিট আগে সকাল ৯টা ১২ মিনিটে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ‘খ’ সেটের প্রশ্নপত্রটি হোয়াটসঅ্যাপের একটি গ্রুপে পাওয়া গেছে। অনুষ্ঠিত হওয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে যা হুবহু মিলে গেছে। ৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াটসঅ্যাপের একটি গ্রুপে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার বহুনির্বাচনী অভীক্ষার ‘খ’ সেটের প্রশ্নপত্রটি পাওয়া যায়। এটিও অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে। ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা ৫৯ মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপের একটি গ্রুপে গণিতের ‘খ’ সেটের প্রশ্নপত্রটি পাওয়া যায়, যা অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। এ ছাড়া আইসিটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র রোববার সকাল ৮টা ৫১ মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপের একটি গ্রুপে ‘ক সেট’ প্রশ্ন পাওয়া যায়। আর সকাল ৯টা ৩ মিনিটে ‘গ’ সেটের প্রশ্নও ফাঁস হয়।
তা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্রও ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠে। শুধু তাই নয়, বরগুনায় দ্বিতীয় শ্রেণির প্রশ্নও ফাঁস হয়েছিল ১৪০টি স্কুলে। এ ঘটনায় পরীক্ষাও স্থগিত করা হয় ওইসব স্কুলে। বিগত বছরের ৬ অক্টোবর সিনিয়র স্টাফ নার্স পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়ে যায় বলে অভিযোগ ওঠে। এসব প্রশ্ন ফাঁস করা বা ফাঁসকারী কোনো শিক্ষিত মহল বা তৎসংশ্লিষ্ট কোনো গোষ্ঠী ছাড়া হাল-চাষরত ব্যক্তি নিঃসন্দেহে এতে জড়িত নয়। একটা শিক্ষিত সমাজ কীভাবে তার দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ যদি হয় আমাদের লেখাপড়ার অবস্থা তাহলে দেশ ও জাতি এ রকম শিক্ষিত মানুষ থেকে কতটুকু উপকৃত হবে? কেমন হবে আমাদের আগামী শিক্ষিত প্রজন্ম? এ রকম শিক্ষিত লোক দিয়ে সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া ছাড়া মাথা উঁচু করে দাঁড় করানো অসম্ভব।
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম একটি হলো, নৈতিক চরিত্রের উন্নতি সাধন। কিন্তু আমাদের সমাজে তা কি সম্ভব হয়েছে? উত্তর অবশ্যই না। যদি নৈতিক চরিত্রের উন্নতি হতো তাহলে প্রশ্ন ফাঁসের মতো এ রকম নিকৃষ্ট কাজে শিক্ষিত মহল জড়িত থাকত না। আগে নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতাকে আরো গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রশ্ন ফাঁস রোধ করতে না পেরে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মত দিচ্ছেন। যার অনেকটা হাস্যকর বটে। শিক্ষামন্ত্রী প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে বলেছেন, এমসিকিউ পদ্ধতি তুলে দিতে। তাতে কি প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ হবে? হাত-পায়ে অ্যালার্জি বা চর্মরোগ হলে হাত-পা কেটে তা দূর করতে হয় না। উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে তা নিরাময় সম্ভব। কারণ, হাত-পায়ে এখনো ক্যানসার হয়নি। সেটা উপযুক্ত কাজ নয়। কারণ, যারা প্রশ্ন ফাঁস করার তারা প্রশ্ন ফাঁস করবেই। সেটা পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্ন করলেও। বরং এসব অপরাধীদের তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় এনে অত্যন্ত কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। ক্ষত জায়গায় ওষুধ না দিয়ে ক্ষত জায়গা কেটে ফেললে রোগের উপশম হবে না।
শিক্ষাসচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেছেন, পরীক্ষার বর্তমান পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া রোধ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র না ছাপিয়ে বই খুলে পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ সম্ভব নয় বললে এটা ব্যর্থতার ভাষা হিসেবে বোধগম্য হয়। তার মানে কী, আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস ছাড়া পরীক্ষা হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। আমরাও তো বাংলাদেশে লেখাপড়া করেছি। এই তো সেদিন দাখিল, আলিম, ফাজিল, অনার্স, মাস্টার্স, কামিল সমাপন করলাম। ২০০৩ সালে প্রথম পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলাম। সে সময় তো আর প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। শিক্ষার্থীরাও এ রকম কল্পনা করেনি। তাহলে এখন সম্ভব নয় কেন? প্রশ্ন ফাঁসকারীদের যেকোনো মূল্যে শনাক্ত করুন। এরা আমাদের সমাজেরই লোক। যারা প্রশ্ন ফাঁস করছে এরা কোনো না কোনোভাবে প্রশ্ন প্রণয়নে লিপ্ত। কঠোর হস্তে দমন করুন। কঠিন শাস্তির আওতায় আনুন। তখন প্রশ্ন ফাঁস রোধ অবশ্যই সম্ভব। তা না হলে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে উপযুক্ত মহলের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করুন। এটাই এখন সময়ের একমাত্র দাবি।