কোনো এক সাহিত্যিক লিখেছেন, মানুষের জুতো দেখে নাকি রুচির পরিচয় জানা যায়। কথাটা তিনি মন্দ বলেননি। শুধু জুতো দেখে কেন, জুতো নিয়ে লিখেও কি বিখ্যাত হওয়া যায় না! আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্রেফ ‘জুতা আবিষ্কার’ নামক কবিতা লিখে কি কম যশস্বী হয়েছেন! এই জুতোকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আবার এও বলা হয়, পায়ের জুতো কখনো মাথায় তুলতে নেই। তাতে বিষম বিপদ। মানে যার অবস্থান যেখানে, তাকে ঠিক সেখানেই স্থান দেয়া উচিত। নইলে অতি আদরে কেউ কেউ বাঁদর হয়ে আপনার ঘাড়ে চেপে বসতে পারে! চাই কি, নুনমেশানো গরম পানি ঢালবে!
আমি জুতো পরিষ্কারের কথা বলছিলাম। জুতো দরকারি জিনিস, সন্দেহ নেই। জুতো ছাড়া চলাচল করা মুশকিল। এই জিনিস শুধু পায়ের সুরক্ষা দেয় এমন নয়, জুতো কিন্তু ঠাঁটবাট দেখানোর জন্যও প্রয়োজন হয়ে পড়ে। নইলে মানুষ সামান্য পদযুগল ঢাকার জন্য লাখ টাকার জুতো কেন কিনবে! অংকটা একটু রেখেঢেকে বললাম, পাশে আয়কর কর্মকর্তা আছেন। প্রচুর পাতিঅলা যারা, মানে যার টাকা রাখার পাতিল নাই, তারা আরো বেশি দামে জুতো কিনে তা পরিধান করেন। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখি, কারণ আমজনতার শুধু দুটো চোখ আছে, এরা ড্যাবডেবে চোখে তাকাতে জানে কিন্তু নিরীক্ষণ করে না।
এ প্রসঙ্গে একটি কৌতুক বলাই যায়। রস কতটা আছে জানি না, তবে কাষ্ঠহাসি হলেও খানিক পাবে। আমরা তো আজকাল বলতে গেলে হাসতেই ভুলে গেছি। হাসির উপরেও যেন ট্যাক্স বসেছে। এক কেষ্টবিষ্টু টাইপ রাষ্ট্রীয় ব্যক্তি আমেরিকা সফরে গেছেন। কী নাম? তা তো বলা যাবে না ভায়া। নাম উল্লেখ করে মুফতে কেস খাই আর কী! তো সেখানকার প্রেসিডেন্ট তখন জেএফকে মানে জন এফ কেনেডি। তিনি দেশকে খুব ভালোবাসতেন বলে শোনা যায়। কেনেডি সাহেব বাংলাদেশি ভদ্রলোকের জন্য অপেক্ষা করছেন। একসাথে প্রাতঃরাশ করবেন, সেইসাথে টুকটাক স্বার্থসংশ্লিষ্ট আলাপ। জানেন তো, দেয়ার ইজ নো ফ্রি লাঞ্চ। মানে আমেরিকানরা বেহুদা আপনাকে ডেকে নিয়ে প্রাতঃরাশ খাওয়াবে এমন ভাবনা বৃথা। তারা প্রতিটি পাই-পয়সার হিসাব কষতে জানে বলেই আজ এত ধনী। বাঙালির মতো অতিথিপরায়ণ ওরা নয়।
সে যাক গে, কেনেডি সাহেব বসে আছেন তো আছেনই। আমাদের ভদ্রলোকের দেখা নেই। বলাবাহুল্য, তার সময়জ্ঞান টনটনের উল্টো, মানে একদম নেই। জেএফকে রেগেমেগে যখন উঠে যাবার উপক্রম, তখন হেলেদুলে তিনি এলেন। মানে বঙ্গদেশি অতিথি তাকে দয়া করে দর্শন দিলেন। যথারীতি তার বিলম্বের হেতু জানতে চাইলেন কেনেডি সাহেব। কারণ তিনি বিরক্ত, বিস্মিতও। হে হে গোছের হাসি উপহার দিয়ে তিনি বললেন, আর বলবেন না, জুতো পরিষ্কার করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। আপনাদের এখানে তো চামারগোছের কেউ নেই।
নেই তো! মাথা নাড়লেন কেনেডি। তারপর মুচকি হেসে বললেন, এদেশে সকলে নিজের জুতো নিজেই বুরুশ করে। নো কোবলার।
তাই নাকি! অবাক হন বঙ্গদেশি অতিথি। মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আপনিও কি নিজের জুতো নিজেই পরিষ্কার করেন?
আলবাত করি। নিজের কাজ নিজে করাই তো ভব্যতা। কেন? আপনাকে কি মশাই অন্যের জুতোতেও বুরুশ মেরে দিতে হয় নাকি! হা হা হা! স্বভাবসুলভ হাসলেন জন এফ কেনেডি।
আদতেও তাই। আমাদের দেশে কিছু কিছু মহামহিম বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন, যারা কিনা পারলে ওয়াশরুমের কাজটাও অন্যকে দিয়ে করিয়ে নেন! জুতোবাহক, হুঁকোবরদার সব তাদের সাথে থাকে। কোথাও গেলে পঙ্গপাল সমেত যান, তাতে রাষ্ট্রের খরচ বাড়ে। পাবলিকের আমানত খেয়ানত হয়।
জুতোর কথা বলছিলাম, আমি একজনকে চিনি যিনি কিনা জুতোকে খুব আদর করেন। জুতোর যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য পারতপক্ষে তিনি জুতোকে রাস্তায় নামতে দেন না। জুতো যত্ন করে বগলের তলায় লুকিয়ে রাখেন। হয়তো তিনি বোকা তাই পায়ের চেয়ে পায়েলের দিকে নজর বেশি। মুকুট পরতে গিয়ে মাথাটাই নষ্ট করে ফেলেন। ক্ষমতা বা চেয়ার চিনতে গিয়ে মসনদে বসার তাগতটুকুই হারিয়ে বসেন। এমন ক্ষমতা দিয়ে কী হবে বলুন, যা কিনা জনতার কাজে আসে না! বে-সাইজ ছেঁড়া জুতো আর কি!
আমার এক সহকর্মী— একদিন অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি, তিনি জুতোর সাথে মোজা পরেন না। খালি জুতো পায়ে গলিয়ে খড়মের মতো খট খট করতে করতে অফিসে আসেন। দূর থেকেই বোঝা যায় তিনি আসছেন। অদ্ভুত এত শব্দ হয় তিনি মাঠে নামলে।
মোজা কেন পরেন না জানতে চাইলে তিনি আজব জবাব দেন। বলেন, কী দরকার ভাই বাড়তি পয়সা খরচের! শীতের দেশ তো নয়, মোজা ছাড়া চলার অভ্যেস করে নিলেই হয়। তাছাড়া মোজা পরলে পায়ে দুর্গন্ধ হয়। মনে মনে বলি, ওটা চর্মরোগ। দোষ মোজা বা জুতোর নয়, আপনার। ভদ্রলোকেরা মোজা ছাড়া জুতো পরেন না। অনেকটা যেন অন্তর্বাস ব্যতীত পাতলুন পরার মতো। ওটা কী মানানসই বলুন!
বাংলা শব্দকোষে খেত বা খেতি বলে একটা কথা আছে। মানে যারা খেতে বা খামারে কাজ করে। আমি তাদের যথোচিত সম্মান করি। ভালোও বাসি। কিন্তু এই জাতীয় খেত, যারা কিনা মোজা ছাড়া জুতো আর অন্তর্বাস ছাড়া পাতলুন পরে, তাদেরকে ঠিক মানতে পারি না। দেখলেই মনে হয়, ব্যাটা নাদান, তুমি তফাত্ যাও। আমার এক বস, যিনি কিনা আমাকে খুব একটা দেখতে পারতেন না। বসরা অবশ্য অধঃস্তনদের কখনোই খুব ভালো চোখে দেখেন না। তিনি যদি আবার হন বিদ্যা-দিগ্গজ, তাহলে তো কথাই নেই। এহেন বসের হাত থেকে মুক্তি মিলল। বিদায়বেলা ছোটখাট একটা অনুষ্ঠান হলো। আমি এর নাম দিয়েছি অকারণ তেলাতেলি ও মিথ্যার ফুলঝুরি। এসব অনুষ্ঠানে সত্যি কথা একটাও থাকে না। জাস্ট বাটারিঙ।
আমি তো জানি বস আমাকে ‘লাইক’ করেন না। তাও কিছু বলতে হয়। তিনি আমার গুণকেত্তন কিছু করতে না পেরে শেষে বললেন, এই কর্মকর্তার রুচি খুব ভালো। তিনি নিত্য জুতো বুরুশ করে অফিসে আসেন। তার জুতো এতই চকচকে যে, আয়নার মতো মুখ দেখা যায়।
শুনে আমি হাসি চাপতে পারিনি। ফিক্ করে হেসে দেই, আমার দেখাদেখি অন্যরাও। বেচারা বসের তখন ত্রাহি অবস্থা। বুঝতে পারলেন, বড় রকমের কিছু একটা গড়বড় হয়েছে।
একশ্রেণির লোক আছে, যারা কিনা জুতোর অপব্যবহারে ব্যস্ত। যাকে তাকে জুতোপেটা করে। পায়ের জুতো মাথায় তুলে রাখে। জিনেসর সাথে জুতো পরে, আবার শার্ট ইন করে পায়ে চটি গলিয়ে ফটাফট হাঁটতে শুরু করে। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। কে একজন জুতো পায়ে স্কুলে এলো। গ্রামের স্কুল, সেখানে খালিপায়ে স্কুলে আসার চল ছিল তখন। ছাত্রের পায়ে জুতো, আর টিচারের পায়ে স্পঞ্জের চটি। টিচার তো ক্ষেপে লাল। কথায় কথায় টিপ্পনি কেটে বেচারা ছাত্রের জান জেরবার করে দেন। একের পর এক পড়া ধরেন, না পারলেই জুতোর খোঁটা। তখন মনে হয়েছিল, জুতো পরার চেয়ে না পরাই বরং ভালো। টিচার তাহলে পড়া ধরবেন না।
রবিঠাকুর তাঁর কবিতায় হাজার পিপে নস্যির কথা বলেছেন। তবে এও ঠিক যে, যিনি প্রথম জুতা আবিষ্কার করলেন, তাকে স্যাল্যুট দিতেই হয়। বা ধরুন হারিকেন। জিনিসটা ছোট, কিন্তু বিজ্ঞান অনেক। জুতো নিয়ে জোকসেরও কমতি নেই। আছে বিদগ্ধ বাণী। প্রায়শ বলা হয়, দ্য উইয়ারার বেস্ট নোজ হয়্যার দ্য শু পিনেচস। তার মানে জুতোর সাথে খোঁচাখুঁচির একটা সম্বন্ধ রয়েছে। জুতো যদি নতুন হয় বা সাইজে খাটো, তাহলে কিন্তু জুতো পরার মজা হাড়ে হাড়ে টের পাবেন। ক্ষমতাও তেমনি, ফিট না করলে সমূহ বিপদ। হয় ঢলঢলে, নয়তো আঁটসাঁট। আর খুব কম লোকেই ক্ষমতা উপভোগ করতে পারে। শুরুটা যেমনই হোক, শেষটা বড়ই অপ্রীতিকর।
তাই বলি কী, জুতো পরিষ্কারের অভিজ্ঞান থাকা মন্দ নয়। তাতে প্রয়োজনে বা অবকাশে বেকার বসে থাকতে হয় না। কে বলতে পারে, আখেরে কার কপালে কী আছে!
|