১৯৪৮ সালে মার্কিন সরকার ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকেই কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়, আরব বিশ্বের সঙ্গে ইসরায়েলের দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কোথায়। তার পরও সর্বদাই ইসরায়েলপন্থি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইন ও বিশ্বজনমতকে শ্রদ্ধা করত। এটাও সত্য, বিভিন্ন সময় ফিলিস্তিন প্রশ্নে কিছু পদক্ষেপযোগ্য প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে তারা; কিন্তু জেরুজালেম প্রসঙ্গ সামনে এলেই যুক্তরাষ্ট্রের আসল অবস্থানটি স্পষ্ট হয়ে যায়। দীর্ঘদিন সারা বিশ্বের মতো যুক্তরাষ্ট্রও সব সময় ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেম দখলকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছে এবং শহরটিকে ফিলিস্তিনের অন্যান্য শহরের মতোই দখল করা ভূখন্ড হিসেবে দেখে আসছে।
জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকৃতি দেওয়ার পর সংগত কারণেই বিশ্বব্যাপী তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এ সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়াকে বিপর্যস্ত করবে; একই সঙ্গে নতুন সহিংসতা ছড়িয়ে দেবে। স্বভাবতই শান্তিকামী মানুষ, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর কাছে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত অনভিপ্রেত হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। ট্রাম্প ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে তীব্র তোপের মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে ওই বৈঠকের পর ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এক বিবৃতিতে জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের এ স্বীকৃতি অসহযোগিতামূলক।
এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের উন্মাতাল অবস্থা আরো উত্তপ্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, প্রকারান্তরে যা বিশ্বকেই আরো অস্থির করে তুলবে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষে সর্বদা সহমর্মিতা ও সমর্থন প্রকাশ করে আসছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেওয়ার ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠন প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ ঘোষণা মুসলিম বিশ্বে গ্রহণযোগ্য নয়। ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের বিষয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করা কেউ মেনে নেবে না বলে তিনি জানান। মূলত প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে ফিলিস্তিনের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনকারী এ দেশের মানুষের সারকথাই প্রতিফলিত হয়েছে।
এদিকে জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ইসরায়েলের হিংস্রতা বেড়েই চলেছে। প্রতিবাদকারী ফিলিস্তিনিদের ওপর আগ্রাসী হয়ে উঠেছে ইসরায়েলি সেনারা। লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের পর এবার বিক্ষোভকারীদের প্রতি গুলি এবং বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে; বিমান হামলা চালানো হয়েছে গাজায়। হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এ থেকে স্পষ্ট, ট্রাম্পের ঘোষণা ইসরায়েলকে উসকে দিয়েছে এবং ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাবের যে অভিযোগ রয়েছে, তা প্রতীয়মান হয়েছে বলে ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি। অনিবার্য কারণেই বিশ্বব্যাপী শান্তি রক্ষার্থে দেশটির দায়িত্বশীল ভূমিকা সবাই প্রত্যাশা করে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশীজন হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র কেন বিতর্কিত সিদ্ধান্তে উপনীত হলো, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
তাছাড়া ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। অন্যদিকে নিজেকে অতিক্রম করার সক্ষমতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেই। প্রতিবারই এ অক্ষমতার পরিচয় দেন তিনি; বারবার একই কাজ করেন। প্রায় সাত দশকের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে এবার তিনি ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিলেন। এর ফলে নানা ধরনের নেতিবাচক ঘটনার জন্ম হবে। অনেক ঘটনাই ঘটতে পারে, যেসবের বিষয়ে ইঙ্গিত করা এ মুহূর্তে অসম্ভব। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন যেসব বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত ফয়সালায় পৌঁছতে পারেনি সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেরুজালেম। দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনায় এ ব্যাপারে বারবার মতভেদ দেখা দিয়েছে।
কারণ জেরুজালেম খুবই সংবেদনশীল প্রসঙ্গ। ফিলিস্তিনিদের আবেগ-অনুভূতিকে অগ্রাহ্য করে জটিল এই প্রসঙ্গে ঢুকে পড়লেন ট্রাম্প; যেন কোনো চায়না শপে ষন্ড ঢুকেছে, সব তছনছ করে দিয়েছে। নিঃসন্দেহে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জেরুজালেম। এ শহর ফিলিস্তিনি মুসলিম ও খ্রিস্টানদের পরিচয়ের মূল নির্ধারক বিষয় ধর্ম দুটির আবির্ভাবের সময় থেকেই। অপরদিকে ফিলিস্তিন সংকট যত তীব্র হয়েছে, এ প্রসঙ্গের গুরুত্বও তত বেড়েছে। জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে বিরোধ চরমে পৌঁছার কারণ দুই পক্ষের কাছেই এ শহর পবিত্র (মুসলিমদের জন্য হারাম আল শরিফ ও ইহুদিদের জন্য টেম্পল মাউন্ট)। সবিশেষ গুরুত্বের কারণেই কোনো ফিলিস্তিনি রাজনীতিকরা এর ব্যাপারে আপস করতে রাজি নন।
উল্লেখ্য, ট্রাম্পের ঘোষণা শুধুই একটি ঘোষণা নয়। তিনি ইসরায়েলের অবস্থানকেই সমর্থন করেছেন। ইসরায়েলিরা মনে করে, জেরুজালেম শুধু তাদের। ১৯৬৭ সালে তারা আরব-অধ্যুষিত পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়, ট্রাম্প সেই দখলের বিষয়টিকেও বৈধতা দিয়েছেন। শুধু দখল নয়, পূর্ব জেরুজালেমে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের ওপর বৈষম্যমূলক আইনও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ট্রাম্প যে ক্ষতি করলেন তা অপূরণীয়, এ ঘোষণা রদ করা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আর সম্ভব হবে না। ট্রাম্পের ঘোষণার ফলে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের ভূমিকার অবসান ঘটল। মধ্যস্থতার বিষয়ে একতরফা, একচেটিয়া দাবি ছিল তাদের। তার জামাতা জারেড কুশনার শান্তি পরিকল্পনা করছেন। মধ্যস্থতাকারীর ঐতিহাসিক দাবির সূত্রে এটিকে ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন কুশনার। ট্রাম্পের ঘোষণা আরব বিশ্বের মতপ্রকাশের অধিকারকেই অগ্রাহ্য করল।
জেরুজালেম প্রসঙ্গে আরবদেরও যে অভিমত আছে সে কথা কার্যত অস্বীকার করা হলো। আরব একনায়করা বা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী রাজারা যুক্তরাষ্ট্রকে যা-ই বলুক না কেন, জেরুজালেমের ব্যাপারে ফিলিস্তিনের দাবির প্রতি সমর্থন জোগাতে আরব জনগণ একাট্টা। ট্রাম্পের পদক্ষেপের বিষয়ে তারা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেই। ফলে পুরো আরব অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থ বিঘিœত হবে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস ২০১৩ সালে বলেছিলেন, কমান্ডার হিসেবে (সেন্ট্রাল কমান্ড) প্রতিদিন আমাকে মূল্য চুকাতে হয়েছে। কারণ ইসরায়েলের ব্যাপারে পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবেই মার্কিনদের দেখা হয়েছে। এই সর্বশেষ কূটনৈতিক বে-চালের মধ্য দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন গোটা বিশ্বের অভিমতকে অগ্রাহ্য করার, অবজ্ঞা করার চরম নজির স্থাপন করল।
বিশ্বের আর কোনো দেশ জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী মনে করে না। এ ব্যাপারে বৈশ্বিক মতৈক্য রয়েছে। সেটি হলো, চূড়ান্ত ফয়সালা হওয়ার আগেই আলোচনার ফল নির্ধারণ করে ফেলা বেআইনি কাজ। এমনটি করা হবে না, এ আশ্বাস দিয়েই ১৯৯১ সালে মাদ্রিদ শান্তি সম্মেলনে ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ কথা বলতেই হয়, ইসরায়েলের অনুকূলে, তাদের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়ানোর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। জেরুজালেম ইস্যুতে ইসরায়েল বা তাদের গুরু যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পক্ষপাতহীন আচরণ আশা করা কারোই উচিত নয়। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে স্থায়ী সমঝোতার বিষয়টি এখন খুবই কঠিন হয়ে পড়ল। ট্রাম্পের পদক্ষেপ আত্মনিবর্তনের স্মারক, কূটনীতির দলিল দস্তাবেজে এ ক্ষতের ছাপ দীর্ঘকাল থেকে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ভূমিকা এরই মধ্যে সংকুচিত। এ পদক্ষেপের ফলে মুসলিম ও আরবদের সঙ্গে এবং বিশ্বের শুভচিন্তার মানুষের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক আরো সংকুচিত হবে। আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয় নেতারা ট্রাম্পকে এ ধরনের পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার জন্য বলেছিলেন। তিনি তাদের পরামর্শে কান দেননি। তিনি তার সুহৃদ ও তাদের ইসরায়েলি চরমপন্থি সহমর্মীদের জন্য আনন্দের উপলক্ষ তৈরি করেছেন বটে, কিন্তু ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের বিষয়টিকে আরো কঠিন করে ফেলেছেন। এই আনাড়ি পদক্ষেপের কারণে শতাব্দীর সেরা চুক্তিতে উপনীত হওয়ার বদলে শতাব্দীর চরমতম বিপর্যয়ে পৌঁছতে যাচ্ছেন তিনি। তার এই ঘোষণার দিনটি আন্তর্জাতিক আইনের জন্য, ফিলিস্তিনের জন্য এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি কামনাকারী সব মানুষের জন্য বেদনার দিন।
এ ছাড়া ফিলিস্তিনি জনগণ, এমনকি অনেক বিশিষ্ট ইসরায়েলি নাগরিকও জেরুজালেমের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে একক সিদ্ধান্ত না নিতে ট্রাম্পকে হুশিয়ার করেছেন। কাজেই সারা বিশ্বই একমত, জেরুজালেম কখনই মার্কিন প্রেসিডেন্টের খেয়ালখুশি হতে পারে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যদি জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তরের অঙ্গীকার পূরণ করতেই চান, সে জন্য একটি সহজ ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হতে পারে আনুষ্ঠানিকভাবে দুই রাষ্ট্র সমাধান গ্রহণ করা। তারপর পশ্চিম জেরুজালেমকে ইসরায়েলের ও পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারেন। এ রকম একটি ঘোষণা ট্রাম্পের নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ ও একই সঙ্গে স্থায়ী শান্তিপ্রক্রিয়ার জন্য তার দূতদের প্রতিও সমর্থন হতে পারে। এর বাইরে কোনো কিছুই সময়োপযোগী ও ন্যায়সঙ্গত নয়। দুর্ভাগ্যবশত ট্রাম্প সব সময়েই শান্তির ওপর যুদ্ধ এবং ন্যায়বিচারের ওপর আগ্রাসন ও অবিচারকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। পরিশেষে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ভাষায় বলতে হয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যকেই ‘আগুনের বৃত্তে’ ছুড়ে ফেলবে। তাই শান্তির স্বার্থেই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসতে হবে।
|