মিয়ানমারের নৃশংস সেনাবাহিনী, বেপরোয়া মৌলবাদী গোষ্ঠী, পথভ্রান্ত সুশীল সমাজ ও বেখেয়াল সরকারের সমন্বিত, সংগঠিত ও সিস্টেম্যাটিক আক্রমণে প্রধানত রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর যে গণহত্যা শুরু হয়েছে তা প্রতিহত করতে হলে মিয়ানমারের ওপর সর্বব্যাপী, সর্বাত্মক ও বহুমুখী বৈশ্বিক অবরোধ আরোপ করতে হবে। বিভিন্ন ফোরাম ও প্রতিষ্ঠানে মানবিক মূল্যবোধের বাকচাতুরি ও কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে কেবল ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচার’ ও ‘বিবেকের আবশ্যকতার’ প্রকাশ না ঘটিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সুশীল সমাজকে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিতে কাজ করতে হবে।
শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘও এ উপসংহারে পৌঁছেছে যে, মিয়ানমারের রাখাইনে ‘ভয়াবহ নৃশংস অপরাধ’ সংঘটিত হচ্ছে, গণহত্যা প্রতিরোধ বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ উপদেষ্টা আদামা ডিয়েং এবং সুরক্ষার দায়িত্ব বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা ইভান ত্রিমোনোভিত্চ তাদের যৌথ বিবৃতিতে লিখেছেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ—এ তিন ধরনের অপরাধ বোঝাতে তারা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতন বিষয়ে ‘ভয়াবহ নৃশংস’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন। এতদিন রোহিঙ্গা নির্যাতনকে জাতিসংঘ আক্ষরিক অর্থেই জাতিগত নিধনযজ্ঞ (textbook example of ethnic cleansing) বলে উল্লেখ করেছে। ইতিপূর্বে বিভিন্ন অধিকার সংগঠনসমূহ ইইউ, ফরাসি প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত পিপলস পাবলিক ট্রায়াল (পিপিটি) রাখাইনে উপর্যুপরি মুসলিম নির্যাতনকে গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ করলেও বিশ্বসম্প্রদায় তাতে তেমন কর্ণপাত করেনি। বিশ্ব ফোরামসমূহে ভয়াবহ এ গণহত্যার বিরুদ্ধে জোরালো কোনো প্রতিবাদ লক্ষ করা যায়নি বা এ ব্যাপারে করণীয় কী— তা নিয়েও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের তেমন মাথাব্যথা দেখা যায়নি।
কিন্তু জাতিসংঘের এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিশ্বের ওপর এ দায় ও দায়িত্ব চেপেছে যে মিয়ানমারের গণহত্যার আশু সমাধান করতে হবে। খুব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এ ভয়াবহ নৃশংসতার জন্য কেবল মিয়ানমারকে দায়ী করলে সমাধান বেরিয়ে আসবে না। মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি, আঞ্চলিক শক্তিসমূহের ভূ-অর্থনৈতিক স্বার্থের লড়াই এবং সর্বোপরি স্নায়ুযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পরিবর্তিত নিরাপত্তা বাস্তবতার কারণে মিয়ানমারের মুসলিম গণহত্যা দীর্ঘতর হয়েছে। এখন সময় হয়েছে এ গণহত্যার স্বরূপ উন্মোচন করে তার কারণ ও নেপথ্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে, দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি দিয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের গণহত্যার কবল থেকে রক্ষা করার কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার।
রোহিঙ্গা মুসলিমের ওপর বর্বরোচিত গণহত্যাকে কেবল একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর পরিচালিত সুসংবদ্ধ ও সুসংগঠিত নির্যাতন মনে করলে ভুল হবে। বরং একটি জাতি-গোষ্ঠীর বিশেষ ‘বিশ্বাস’ ও ‘মূল্যবোধ’কে টার্গেট করে এ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যকে সামনে রেখে চালানো হয়েছে এ গণহত্যা। কাজেই একেই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ না করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ‘বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গণহত্যা’ হিসেবে উল্লেখ করলে বেশি সঠিক হবে। মুসলিম বিশ্বের সংঘাত বিষয়ক লেখক অস্টিন বোডেটি দ্য ডিপ্লোম্যাট অনলাইনে প্রকাশিত নিবন্ধে রোহিঙ্গা নির্মূলে দেশটির সেনাবাহিনীর নীলনকশা তুলে ধরেছেন। তিনি দাবি করেছেন যে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে মিয়ানমার সেনাবাাহিনী কয়েক দশক ধরে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে বার্মার সেনাবাহিনী দেশটির শাসনভার দখল করার পর রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরোচিত অত্যাচার শুরু করে যা তাদেরকে আস্তে আস্তে গণহত্যার মাধ্যমে জাতিগত নিধনযজ্ঞের শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন, পরবর্তী কালে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্বাচনের প্রার্থিতাদানে নিষেধাজ্ঞা, ভোটাধিকার হরণ এবং বর্তমানে তাদের নাগরিকত্ব হরণ ও জাতীয় পরিচিতি-চ্যুতি তথা বাস্তুচ্যুতি ও বৃন্তচ্যুতির মাধ্যমে সেনা অফিসাররা মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় জনসংখ্যা নীতির মুখোশ উন্মোচন করেছে। অবশ্য তাদের রোহিঙ্গা নির্যাতনের পশ্চাতে আঞ্চলিক সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানেরও সম্পর্ক রয়েছে, যা সন্ত্রাসবিরোধী বৈশ্বিক নীতির আঞ্চলিক সংস্করণ মাত্র। স্নায়ুযুদ্ধোত্তর কালে কম্যুনিজমের পতন হলে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ ইসলাম ও মুসলমানদের রাজনৈতিক জাগরণ ও চেতনাকে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার বিরুদ্ধে নব উত্থিত হুমকি হিসেবে প্রচারণা চালায়। ইসলামভীতি (Islamphobia) বিশ্বকে প্রবলভাবে নাড়া দেয় এবং বিশ্বের প্রায় সকল অঞ্চলের মুসলমানদের ওপর অলীক সন্দেহের দৃষ্টি প্রসারিত করা হয়। তদুপরি ঢালাওভাবে মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিদারুণ নির্যাতন শুরু হয়। সেই অত্যচারের বিরুদ্ধে তাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকেও সন্ত্রাস হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। চীনের উইঘুর মুসলিম, ফিলিপাইনের মরো মুসলিম এবং আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমের বিরুদ্ধে চালিত অত্যাচার নির্যাতনকে বিশ্ব রাজনীতির স্নায়ুযুদ্ধোত্তর নিরাপত্তা চিন্তার পরিবর্তিত ও বিকৃত তত্ত্বের ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। বিশ্বাস-হত্যার অন্যতম বৈশ্বিক উদাহরণ হলো ফ্রান্স, কানাডাসহ পাশ্চাত্যের কিছু ভূখণ্ডে মুসলিম নারীর বিশ্বাস নির্দেশিত পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বিশেষ বিশ্বাসের মানুষদেরকে প্রান্তিকীকরণ, অধিকার হরণ ও বৈষম্যের বেদনায় জর্জরিত করা। বিশ্বের চতুর্দিকে সম্প্রসারিত সন্ত্রাস শুধু একটি বিশ্বাসের ধারক নাগরিকদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে না, বৈশ্বিক সন্ত্রাসের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক উত্স ও কারণ সন্ধানে এ পর্যন্ত যত গবেষণা হয়েছে, তাতে এমন তথ্য প্রকাশিত হয়নি।
মিয়ানমারে সংঘটিত মুসলিম গণহত্যা বন্ধে আঞ্চলিক শক্তিসমূহের ভূরাজনীতি, ভূ কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রয়েছে চীনের বিশাল বাণিজ্য স্থাপনা, যার ৭০ ভাগ মালিকানা চীনের। রয়েছে ভারতেরও বাণিজ্য স্বার্থ। রাশিয়াও একইভাবে আঞ্চলিক রাজনীতি-অর্থনৈতিক বাস্তবতা দ্বারা চুক্তিবদ্ধ। বিশেষ করে এ এলাকায় গভীর সমুদ্রবন্দর, সামুদ্রিক স্থাপনা নির্মাণে চীন, ভারত ও রাশিয়াসহ বৃহত্ শক্তিগুলোকে মিয়ানমার আস্থায় নিয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক আন্তঃক্রিয়ায় অসন্তোষ রয়েছে বলে অনুমিত হয়। সেই ভূ-অর্থনৈতিক ও ভূকৌশলগত নৈকট্য ও আস্থা যা মিয়ানমারের সঙ্গে বৃহত্ শক্তিগুলোর গড়ে উঠেছে, তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বৃহত্ শক্তিগুলো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পাশে এসে রোহিঙ্গা মুসলিমদের গণহত্যা দমনে কার্যকর পদক্ষেপ নিবে এমন আশা না করাই সমীচীন। অনেক বিশ্লেষক ইতোমধ্যে ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে বাংলাদেশ ভূ-অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিক দিয়ে মিয়ানমারের কাছে পরাজিত হচ্ছে এবং কেন সে কারণে আঞ্চলিক বৃহত্ শক্তিগুলো মিয়ানমারকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
উপর্যুক্ত অবস্থায় চীন, রাশিয়া ভারতসহ অন্যান্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিসমূহকে বিভিন্ন কূটনৈতিক ফোরামে ও বৈশ্বিক সংস্থাসমূহের মাধ্যমে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য সক্রিয় করতে হবে। জাতিসংঘসহ বৈশ্বিক সমাজের প্রায় সকলে এখন রোহিঙ্গা মুসলিমদের গণহত্যার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে। মিয়ানমারের যুদ্ধাপরাধের অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। জাতিসংঘের তদন্ত দল মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দলিল হাতে পেয়েছে এবং সর্বোপরি মিয়ানমারের অনুরোধে আনান কমিশনও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের অপরাধের ফিরিস্তি তুলে ধরেছে। সামরিক বিশেষজ্ঞগণ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সৈন্যদের অভিনব যুদ্ধকৌশল বিশ্লেষণ করে বলছেন যে, গণধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে বর্মী সৈন্যরা ব্যবহার করছে।
এখন বর্মী সৈন্য ও মিয়ানমারের সরকারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সমাজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের কূটনীতি প্রয়োগ করতে হবে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর নেতৃত্বের স্থানে থাকায় বাংলাদেশ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় শান্তিবাহিনী পাঠানোর জন্য জাতিসংঘকে অনুরোধ জানানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত নিরাপদ এলাকার গঠন ও নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের অনন্য সাফল্য অর্জিত হবে। গণতন্ত্রের নেত্রী হিসেবে নিজ দেশ ও নিজ সরকারের ব্যর্থতার জন্য সু চির নোবেল শান্তি পুরস্কারের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করার সময় এখন। ইতোমধ্যে বিলেতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র কমনরুম থেকে সু চির নাম মুছে ফেলার পক্ষে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। গত মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট হুগস কলেজের প্রবেশদ্বার থেকে তার ছবি খুলে ফেলা হয়েছে এবং সু চিকে দেওয়া ফ্রিডম অব অক্সফোর্ড খেতাব তুলে নেওয়া হয়েছে। ইইউ ইতোমধ্যে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, সামরিক কর্মকর্তাদের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, বিশ্বের বড় বড় দেশ এবং সংস্থাসমূহ যাতে মিয়ানমারের সরকার ও সৈন্যবাহিনীর ওপর সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা জারি করে তার কার্যকর কূটনীতি গ্রহণ করতে হবে। বসনিয়া ও কসোভোর গণহত্যার দায়ে যেমন সেদেশের রাদোভান কারাদজিককে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে, ন্যাটো সেখানে অভিযান চালিয়েছে— তেমনিভাবে বর্মী সৈন্যদের বিরুদ্ধেও যাতে ন্যাটো জাতিসংঘ অভিযান চালায় সেজন্য বিশ্বসমাজকে সক্রিয় করতে হবে। বাংলাদেশের সরকার জাতিসংঘের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ইস্যুটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে এসে এর কূটনৈতিক সমাধানে বেশ পারঙ্গমতা দেখিয়েছে। তবে কূটনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশ তার দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা রাখে এমন বার্তাও মিয়ানমার সরকারকে পৌঁছে দিতে হবে। বাংলাদেশের কঠোর অবস্থান মিয়ানমারকে তার নাগরিকদের দ্রুত ফিরিয়ে নিতে এবং বাংলাদেশের ভূমি ও আকাশসীমায় মিয়ানমারের যেকোনো ধরনের উসকানিমূলক স্পর্ধাকে স্তিমিত করবে। আর কেবল নম্রনীতি ও তোষণনীতি বাংলাদেশের জন্য সমূহ বিপদ ডেকে আনতে পারে।