আজকাল পত্রিকা খুললেই যেসব খবর দেখি তাতে মন খারাপ ছাড়া ভালো হবার কিছু থাকে না। একটা সময় ছিল যখন আমরা মানুষের মায়া আর ভালোবাসার উজ্জ্তলতায় বড় হয়েছি। একথা বলি না এখন ভালোবাসা নাই। এখনো ভালোবাসা আছে বলেই ১৬ কোটি মানুষের গিজ গিজ করা দেশে কারো জন্মগ্রহণের মতো আনন্দ সংবাদ আর কিছু নাই। এখনো মানুষ সন্তান হবার আনন্দে বিভোর। মা হবার স্বপ্নে বড় হয়ে ওঠা আমাদের কন্যারা ভাবতেও পারবে না উন্নত দেশ নামে পরিচিত এই দেশগুলোতে মেয়েরা সন্তান নিতেই চায় না। আমার দেখা অষ্ট্রেলিয়ার অন্যতম সেরা রাজনীতিবিদ ছিলেন কিম বিজলী নামের এক ভদ্রলোক। তখন লেবার দল গদিতে ছিল না। তিনি ছিলেন বিরোধী দলের নেতা। জনপ্রিয়তা ও বাগ্মিতায় শীর্ষে থাকা এই মানুষটি আর কোনোদিনও এ দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। কারণ যখন হবার কথা তখন দুটো সাংঘাতিক বিষয়ে মুখ খুলেছিলেন তিনি। যার একটি মেধাভিত্তিক সমাজ, আরেকটি বিবাহবন্ধনের ওপর গুরুত্ব আরোপ। তিনি বলেছিলেন, এ দেশে আরো অনেক মেধার দরকার। ভারতের কাছে অঙ্ক বা কম্পিউটার, চীনের কাছে বাণিজ্য, আমেরিকার কাছে শক্তি বন্ধক দিয়ে কোনো জাতি স্বাবলম্বী হতে পারে না। ব্যস। এ দেশের ভোটাররা আমাদের মতো হইচই করে না, ব্যানার ফেস্টুন বা মাইকিং নাই এ দেশে। জনসভা? নৈব নৈব চ। ফলে নীরব ভোটে তারা জানিয়ে দিয়েছিল— তারা আয়েশি সুখের জীবন ছেড়ে অতশত পড়াশুনায় রাজি না। আর একটি কারণ তিনি তারুণ্যকে বলেছিলেন দায়িত্ব নিতে। তাঁর মতে, এই লিভ টুগেদার আর যৌনতা উপভোগের বন্ধনহীন জীবন কোনো জাতিকে মজবুত করে না। বিয়ে করে সংসারী না হওয়া বা সন্তান হলে দায়দায়িত্ব না নেওয়ার জন্য একা থাকা মূলত একটি উপসর্গ। তার এই কথা তারুণ্যের হয়তো মনে ধরেনি এবং তিনিও আর কোনোদিন এ দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি।
এদিক থেকে আমাদের সমাজ ও দেশ অনেক মায়াবী। এখনো ফেসবুক জুড়ে বা মিডিয়ায় বিয়ের চোখ জুড়ানো ছবি আর ঘটা দেখে বোঝা যায় মেয়েদের অন্তরে সংসার কতটা প্রোথিত। ছেলেরাও চায় সুখি হতে। বাদ সাধছে কে? তার আগে বলি, আমি নিজে যেহেতু যন্ত্র ও আবিষ্কারে বিশ্বাসী তাই ঢালাওভাবে কোনো সামাজিক মিডিয়াকে দোষ দেব না। কিন্তু মানতে হবে আমরা যা বা যে বিষয়ে প্রস্তুত না সেটা হঠাত্ খুলে গেলে অসুবিধা হবেই। আমাদের যৌবনে এমনকি সেদিনও ছবি দেখে পাত্রী পছন্দ করে বিয়ে হতো। ছবিতে কত দোষ কত ত্রুটি চাপা পড়ে যায়, তবু মানুষ সেটাই বিশ্বাস করে জীবনসঙ্গী বেছে নিতো। অথচ সে সময়কার বিয়েগুলো ছিলো অটুট ও দীর্ঘমেয়াদি। অবাধ মেলামেশা বা বন্ধুত্ব এক বিষয় আর সেখান থেকে সবকিছু পাবার পর কাউকে জীবনসঙ্গী করে নিলে অচিরেই গাইতে হয়, পুরনো জানিয়া চেয়ো না আমারে আধেক আঁখির কোণে...। বলছিলাম, এই অবাধ অবাধ খেলায় বাংলাদেশ যতটা এগিয়ে আছে সিডনি ততটা না। আমাদের ধারণা শ্বেতাঙ্গ নারী মানেই খোলামেলা। এ যে কত বড় ভুল এদেশে না এলে আমি জানতামই না। ধরুন যখন আমরা চিঠি লিখতাম, কত ধৈর্য আর কত কত দিন পর একেকটি চিঠির উত্তর আসতো। সে স্বপ্ন আর প্রহরের ভেতরেই তারুণ্যের জীবনে আসতো কবিতা নামক গান বা শিল্পবোধ। এখন যখন চটজলদি পাওয়া আর পেয়ে হারানোর রেইস বা দৌড় সেখানে কোথা থেকে ভালো শিল্পের জন্ম হবে? যে কারণে ভালোবাসার নাম এখন দৌড় প্রতিযোগিতা।
মানুষের জীবনে ভালোবাসা কেবল নারী-পুরুষে সীমাবদ্ধ হলে আমাদের সমাজ এতটা এগুতে পারতো? যারা এ দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের ভেতর প্রচণ্ড ভালোবাসা বোধ ছিল। সামান্য একটু মারামারি দেখলে আমরা পালিয়ে ভাগি। আর এরা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে গুলির মুখে বুক পেতে দিয়েছিল কিভাবে? দেশের জন্য মাটির জন্য ভালোবাসা ছিল বলে। আজ সে ভালোবাসা কোথায়? আগামী দিনের কাণ্ডারি হিসেবে দেশ ও সমাজের সামনে যাদের তুলে ধরা হচ্ছে তাদের কেউই দেশে থাকে না। আরে মাটি যদি পায়ে না লাগে আকাশ যদি সকালে ঘুম না ভাঙায় হাওয়া যদি এসে স্পর্শ না করে সে মানুষ সে মাটি সে দেশের নেতা হবেন কী করে? ভালোবাসার আরেকটা রূপ ছিল মায়া। এমন মায়ার সংসার ও সমাজ আর কোথাও নাই। এখনো মায়েরা সন্তানের জন্য না খেয়ে থাকেন। এখনো বাবার জুতোর তলা ছিঁড়ে যায় কন্যার বিয়ের টাকা জোগাড় করতে। এমন দেশের মানুষ কী করে একজন আরেকজনকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করে? এই বোধহীন সমাজের দায় শুধু রাজনীতির ওপর চাপালে চলবে না।
প্রায়ই দেখি সমস্যা আর সমস্যার চাপে মুখ থুবড়ে পড়া মিডিয়ায় কিছু মানুষ বকছেন। কী বলছেন কেন বলছেন কেউ জানে না। আপনারা এক লাখ কথা বলে একজন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়াতে পারবেন? আপনাদের মুখ গোমড়া কঠিন ভাষা কি সু চি বা মিয়ানমার বোঝে? আপনারা মাঠে যান। আমাদের তারুণ্যকে গড়ে তুলুন যাতে তারা নিজের দেশ ও সমাজকে ভালোবাসতে জানে। সবাই মিলে তাদের কাঁধে-পিঠে ভারী পুস্তকের বোঝা আর জিপিএ পাবার লোভ তুলে দিলে তারা সমাজ ও দেশকে ভালোবাসবে কিভাবে?
ভালোবাসার বিকল্প নাই আজ। কেবল ফেব্রুয়ারি মাসের এক বিশেষ দিনে ভালোবাসা হবে আর বাদবাকি সব সময় আমরা ঝগড়া-কলহে থাকবো? তাই অন্তত একটি লেখা একটি কথা একটি কাজে প্রতিদিন আমরা যেন আমাদের দেশ, তারুণ্য ও মানুষকে ভালোবাসার কথা জানাই। ভালোবাসা ফিরে আসলে অনেক সমস্যা এমনিতেই কমে যাবে।