আমাদের দেশের সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় নবম-দশম শ্রেণিতে তিনটি বিভাগ রয়েছে। বিজ্ঞান, মানবিক এবং বাণিজ্য-এই তিন বিভাগে ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া করে। অষ্টম শ্রেণি থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার পর নিজেদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের কথা মাথায় রেখে এবং নিজস্ব মেধা বিবেচনা ও অভিভাবকের পরামর্শে ছাত্রছাত্রীরা যেকোনো একটি বিভাগ নির্বাচন করে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এবং সার্বিক অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নিজের ইচ্ছা থেকে বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণের দিকেই বেশি জোর দেয় ছাত্রছাত্রীরা।
আমার খুব পরিচিত এক শিক্ষার্থী আছে। সে এলাকার একটি নামকরা স্কুলে লেখাপড়া করে। ছোটবেলা থেকেই তার মা-বাবার ইচ্ছা তার এই মেয়েটি ডাক্তার হবে। কারণ ছোটবেলা থেকেই মেয়েটি প্রচন্ড মেধাবী। আমিও জানি মেয়েটি মেধাবী। অষ্টম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েই তাকে বিজ্ঞান বিভাগ নিতে হলো। মেয়েটি এখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। সেই বিজ্ঞান বিভাগেই। কিন্তু নিজের ইচ্ছায় নয়। এক রকম জোর করেই তাকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। ওর প্রিয় বিষয় ইংরেজি। মেয়েটি জানত, সে মানবিক বিভাগে লেখাপড়া করলে খুব ভালো করবে। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা কোনো বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতে চেয়েছিল। তবে তা হয়নি। তাকে ডাক্তার হতে হবে। এটি তার স্বপ্ন নয়। এটি তার মা-বাবা এবং আত্মীয় স্বজনের স্বপ্ন। এটি একটি উদাহরণ।
আরো অনেক ছাত্রছাত্রীকে আমি জানি, যারা বিজ্ঞান বা মানবিক বা বাণিজ্য নিয়ে পড়তে চেয়েছিল; কিন্তু তাদের অভিভাবকের একগুঁয়েমি স্বভাব এবং দূরদর্শিতার অভাবে তা সম্ভব হয়নি। এ রকম একজন ছাত্র যে অষ্টম শ্রেণিতে মাত্র জিপিএ-৩ পয়েন্ট পেয়েছে। তাকেও বিজ্ঞান নিতে হয়েছে। কারণ তার অভিভাবক স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, পড়তে চাইলে বিজ্ঞানেই পড়তে হবে। অন্য কোনো বিষয় নিয়ে পড়া চলবে না।
আমাদের দেশে এখন অনেক ধরনের পেশা। তরুণ-তরুণীরা সেসব পেশায় খুব ভালো করছে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে নিজের মেধার স্বাক্ষর রাখছে। এক সময় আমাদের দেশের অধিকাংশ অভিভাবকই মনে করতেন ডাক্তার বা প্রকৌশলী হলো দেশের সব থেকে উঁচু মাপের পেশা। কোনোভাবে ছেলেমেয়েকে এই দু’পেশার একটিতে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে ভবিষ্যৎ নিয়ে আর ভাবতে হবে না। অবশ্য অধিকাংশ অভিভাবকের কাছে সন্তানের ভবিষ্যৎ মানেই কেবল টাকা রোজগার করা। যার পকেটে যত বেশি টাকা থাকবে তার ভবিষ্যৎ তত বেশি নিশ্চিত। কিন্তু এটা করতে গিয়ে যে কত ছেলেমেয়ের অন্তরাত্মাকে মেরে ফেলা হচ্ছে তার খোঁজ কোনো অভিভাবকই রাখছেন না। ছোটবেলায় পড়া ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ রচনা লিখতে গিয়ে প্রতিবারই ডাক্তার হয়ে গ্রামে গিয়ে সেবা করার কথাই কয়েক পাতা ভরে লিখে আসতাম। তবে সে সেবা আজ পাতাতেই রয়ে গেছে। সেবা থেকে তা আজ সত্যিকারের পেশাতে পরিণত হয়েছে। খুব দামি এক পেশা। আমি নিশ্চিত করে জানি না আমার দেখা এই মেয়েটি একদিন ডাক্তার হবে কি না বা সুনামের সঙ্গেই সে তার মা-বাবার ইচ্ছা পূরণ করবে কি না। কিন্তু কোনো দিন কি ওর মনে হবে না যে, সে কোনো দিন ডাক্তার হতেই চায়নি।
আমি এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, সে খুব ভালো একজন শিক্ষক হতে পারত। সারা জীবন মেয়েটিকে এই সত্যটা মেনে নিয়ে জীবন কাটাতে হবে। এটা কেবল নিজের প্রিয়জনদের আবদার বা আদেশ মানতে গিয়ে। সবচেয়ে বড় সত্য হলো একজন ডাক্তার ভালো শিক্ষক তৈরি করতে পারে না, কিন্তু একজন ভালো শিক্ষক অনেক ভালো ডাক্তার তৈরি করতে পারে। আমি সেই মেয়েটির কাছ থেকে আরো জানতে পেরেছি যে, ওর ক্লাসের অধিকাংশ মেয়ের সঙ্গেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছিল। কিন্তু ফল হলো সেই মেয়েদের অধিকাংশই নিজের ইচ্ছাতে বিজ্ঞান পড়ছে না। তাদের অভিভাবকদের স্বপ্ন পূরণ করতেই তারা বিজ্ঞান পড়ছে। এসব অভিভাবক হয়তো তাদের ইচ্ছা বা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সর্বদাই উদ্বিগ্ন থাকেন। তাই তারা চান যে, বিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখা করলে ভবিষ্যৎ খুব উঁচুমানের হবে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তার স্বপ্ন হয়তো তার সন্তান পূরণ করবে, কিন্তু নিজের স্বপ্ন সেখানেই চাপা পড়ে থাকবে। কাজটি সম্পূর্ণ অনুচিত। কারো নিজস্ব প্রতিভা বিকাশের সুযোগ না দিয়ে তার প্রতিভার অংশকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এটা এক ধরনের অপরাধ।
অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো বিষয়ে পড়ালেখা করা এসব ছেলেমেয়ে যে এক সময় ডাক্তার হয়ে মন থেকে বিষয়টি মেনে নেবে না তা নয়। কোনো পেশা দীর্ঘদিন কাজ করতে গিয়ে অভ্যস্ত হওয়া, দায়িত্ববোধ জন্মানো এবং সর্বোপরি ভালোবেসে ফেলার ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু মা-বাবার স্বপ্নের সেই পেশা থেকেও তার আদরের সন্তান আরো বড় কোনো কিছু হতে পারত। হয়ত সেটা সম্ভব হবে না। কারণ তার সেই স্বপ্ন শুরুতেই মেরে ফেলা হয়েছে। এসব জেদি এবং একগুঁয়ে স্বভাবের অভিভাবক কি প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি বুঝে করেন? তিনি কি করছেন এটা কি তিনি জানেন? আমাদের দেশে এ ধরনের অভিভাবকের কমতি নেই।
পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর অনেক ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা করে বসে। তারা কেন আত্মহত্যা করে? অনেক সময় পরিবারের আশা পূরণ না হওয়াতে লজ্জায় আত্মহত্যা করে। জীবনের থেকেও কি অভিভাবকের স্বপ্নের দাম বেশি? ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্র থ্রি ইডিয়টসে দেখানো হয়েছে, কিভাবে কোনো ছাত্র নিজের মনের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়। যেখানে পদে পদে ছিল প্রতিবন্ধকতা। এটি একটি সিনেমা হলেও বাস্তব চিত্র খুব একটা আলাদা নয়। আমাদের দেশে ঠিক কতজন অভিভাবক আছেন যারা এমনটা চিন্তা করেন তা বলতে পারব না, কিন্তু এ ধরনেই অভিভাবকের সংখ্যাই বেশি-তা বলতে পারি।
প্রকৃতপক্ষে আমাদের অভিভাবকদের এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশ্বে এখন বৈত্রিম্যময় পেশার আবির্ভাব ঘটেছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয় মানুষের আয়ের উৎস হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। সেবামূলক পেশার ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। বহু নতুন নতুন পেশায় অংশগ্রহণ বাড়ছে। সেখানে অভিভাবকদের মান্ধাতা আমলের চিন্তা-চেতনা কোনো কাজে আসবে না। যেকোনো পেশাতেই চূড়ান্ত সাফল্যে পৌঁছাতে ধৈর্য প্রয়োজন। প্রতিটি পেশার গুরুত্বও রয়েছে। পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিষয়ের ওপর আগ্রহ বিবেচনায় নিতে হবে। অভিভাবকদের উচিত তার সন্তানের মনোভাব যাচাই করা। তার ইচ্ছার মূল্যায়ন করা এবং তাকে তার ভবিষ্যতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া।