বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা এবং টেলিযোগাযোগ সেবার উন্নয়ন ও দক্ষ নিয়ন্ত্রণের নিমিত্তে একটি স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠায় ২০০১ সালের ১৬ এপ্রিল প্রণীত হয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০১। ২০০২ সালে পাঁচ সদস্যের বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) গঠন করা হয়। দেশের মোবাইল কোম্পানির নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। টেলিযোযোগ আইনানুযায়ী মোবাইল কোম্পানি বিটিআরসির নির্দেশনা অনুসরণে বাধ্য। কিন্তু মোবাইল কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থার দেওয়া নির্দেশনা প্রতিপালন করছে না। ফলে গ্রাহকরা প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
তথ্য মতে, প্যাসিফিক গ্রুপ ও ফারইস্ট টেলিকম ৫৫ শতাংশ এবং সিংটেল ৪৫ শতাংশ মালিকানাধীন দেশের প্রথম সিডিএমএ মোবাইল অপারেটর সিটিসেল ১৯৮৯ সালে যাত্রা শুরু করে আর গ্রামীণফোনের পথচলা ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ। এটি প্রতিষ্ঠা করেন ড. মো. ইউনূস ও ইকবাল কাদির। টেলিকম মালয়েশিয়া ইন্টারন্যাশনাল মালিকানাধীন একটেল টেলিকম ১৯৯৭ সালে যাত্রা করলেও ২০১০ সালে রবি ব্র্যান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সুনীল ভার্টি মিতালীর মালিকানাধীন এয়ারটেল লিমিটেড ২০০৭ সালের ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে যাত্রা করে, পরবর্তীতে মালয়েশিয়ার আজিয়াটা গ্রুপ ৬৮.৭ শতাংশ, ভারতের এয়ারটেল লি. ২৫ শতাংশ ও এনটিটি ডকোমোর ৬.৩ শতাংশ শেয়ারে যৌথ মালিকানায় ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর রবি-এয়ারটেল একীভূত হয়ে কার্যক্রম শুরু করে। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন টেলিটক ২০০৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেবা শুরু করে। সেবা টেলিকম ১৯৯৯ সালে ল্যান্ড ফোনের ব্যবসা আরম্ভ করলে পরবর্তীতে ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়ারসকম টেলিকম লিমিটেডের ভিমপেলকম লি. শতভাগ শেয়ার ক্রয়পূর্বক বাংলালিংক নামধারণ করে ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে কার্যক্রম শুরু করে। ইউএইভিত্তিক ধাবি গ্রুপের চেয়ারম্যান শেখ নাহিয়ান মুবারক-আল-নাহিয়ানের ওয়ারিদ টেলিকম ২০০৭ সালের ১০ মে যাত্রা শুরু করলেও ওই কোম্পানি ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ভারতীয় এয়ারটেল কোম্পানির কাছে বিক্রি করে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে।
বর্তমানে দেশে গ্রামীণ ফোন, রবি-এয়ারটেল, বাংলালিংক ও টেলিটক মোবাইল কোম্পানি সক্রিয় থেকে ব্যবসা অব্যাহত রেখেছে। বিটিআরসির সর্বশেষ তথ্য মতে, গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা ৫ কোটি ১৫ লাখ ৭৯ হাজার, ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা ২ কোটি ৫২ লাখ, রবি-এয়ারটেল একীভূত হওয়ার পর তাদের গ্রাহক সংখ্যা ৩ কেটি ৯৫ লাখ ৭০ হাজার, বাংলালিংক ফোনের গ্রাহক ৩ কোটি ১৫ লাখ ৭২ হাজার ও টেলিটকের গ্রাহক ৩ কোটি ৩২ লাখ ৬০ হাজার। দেশে সর্বমোট মোবাইল গ্রাহক রয়েছে প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি। ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা ০৭ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার। তন্মধ্যে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ০৬ কোটি ৮৬ লাখ ৫০ হাজার।
দেশে বর্তমানে প্রতিমাসে গ্রাহক প্রতি ডাটা ব্যবহার হচ্ছে ৪০০-৫০০ মেগাবাইট। রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন কোম্পানি টেলিটক ২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর পরীক্ষামূলকভাবে থ্রিজি সেবাদান শুরু করে। ২০১৩ সালের ০৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত নিলামের মাধ্যমে থ্রিজির তরঙ্গ বরাদ্দ প্রাপ্ত হয় গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও এয়ারটেল। পরবর্তীতে একই বছরের ০৭ অক্টোবর গ্রামীণফোন, ২১ অক্টোবর বাংলালিংক, ৩০ অক্টোবর রবি ও ০৭ নভেম্বর এয়ারটেল বাণিজ্যিকভাবে এ সেবা চালু করে। তথ্য মতে, থ্রিজি চালু হওয়ার পর থেকে ফোন অপারেটরগুলো ডাটাভিত্তিক সেবায় কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ২০১৬ সালে ইন্টারনেট সেবা থেকে গ্রামীণফোন আয় করেছে ১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। ২০১৪ ও ১৫ সালে এ প্রতিষ্ঠান আয় করেছে যথাক্রমে ৫৫০ কোটি ও ৮৫০ কোটি টাকা। গ্রামীণফোনের ইন্টারনেট গ্রাহক ২ কোটি ৫২ লাখ, রবি ফোন এ খাত থেকে ২০১৬ সালে আয় করেছে ৬৮৪ কোটি, ২০১৫ সালে ৫২৪ কোটি ও ২০১৮ সালে ২৮৭ কোটি টাকা। গ্রামীণফোন চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ৬৫৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এছাড়া বাংলালিংক আয় করেছে ২০১৬ সালে ৪৯১ কোটি, ২০১৫ ও ১৪ সালে যথাক্রমে ১৭৬ কোটি ও ৩২৫ কোটি টাকা। তথ্য মতে, প্রতি গিগাবাইট ইন্টারনেট ডাটা ক্রয়ে মোবাইল কোম্পানিগুলোর ব্যয় হয় গড়ে ২৬ পয়সা, অথচ গ্রাহকের কাছে সমপরিমাণ ডাটা ২০০ টাকার অধিক মূল্যে বিক্রি করছে অধিকাংশ মোবাইল কোম্পানি। সরকার ব্যান্ডউইথের মূল্য কয়েক দফায় হ্রাস করলেও গ্রাহকরা তার সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
মোবাইল কোম্পানিগুলোর ব্যবসা হলো সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো
জানা গেছে, মোবাইল কোম্পানিগুলো ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) হতে প্রতি মেগাবাইটস প্রতি সেকেন্ড (এমবিপিএস) ব্যান্ডউইথ ক্রয় করছে ৩৯০-৫৫০ টাকায়। এক এমবিপিএস গতির সংযোগে মাস শেষে ডাটা ব্যবহারের পরিমাণ দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫৯২ গিগাবাইট। এ হিসাবে প্রতি জিবি ডাটা ক্রয়ে মোবাইল কোম্পানিগুলোর ব্যয় হয় ১৫-২১ পয়সা। তবে সংযোগ বিচ্ছিন্নতাসহ অন্যান্য খাতে ৩০ শতাংশ অপচয় সমন্বয় করা হলেও তা দাঁড়ায় ১ হাজার ৮১৪ জিবি। এতে প্রতি জিবি ডাটা কিনতে মোবাইল কোম্পানিগুলোর ব্যয় হয় সর্বনিম্ন ২২ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ৩০ পয়সা, দুটোর গড় করলে দাঁড়ায় ২৬ পয়সা। বর্তমানে গ্রামীণফোনের ১ জিবি ডাটার সরাসরি কোন প্যাকেজ না থাকলেও ফ্লেক্সি প্ল্যানের মাধ্যমে সমপরিমাণ ডাটা ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। ফ্লেক্সি প্ল্যানে ৩০ দিন মেয়াদে ১ জিবি ডাটা ক্রয়ে গ্রামীণফোনের গ্রাহকের ব্যয় ২৭৮ টাকা ২৮ পয়সা, যথাক্রমে বাংলালিংকের ২০৯ টাকা, রবিও এয়ারটেলের ২১৩ টাকা ০৬ পয়সা ও ২০৯ টাকা, এর মেয়াদ ২৮ দিন। তবে টেলিটকের প্যাকেজের মূল্য তুলনামূলক কম। এদের ৩০ দিন মেয়াদের ১ জিবির মূল্য ১৮০ টাকা। গড় হিসাবে এ পাঁচটি মোবাইল কোম্পানির প্রতি জিবি ডাটার বিক্রয়মূল্য হয় ২১৭ টাকা। তথ্য মতে, মোবাইল কোম্পানিগুলো কোটি কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করলেও সরকার দেশের চার মোবাইল ফোন কোম্পানির কর বাবদ চার হাজার টাকা পাওনা রয়েছে।
এক জরিপে দেখা গেছে, সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারী হিসেবে সারা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা এখন দ্বিতীয়। এখানে ২ কোটি ২০ লাখের অধিক মানুষ সক্রিয়ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করছেন। সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে ২১ কোটি ৯০ লাখ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। বিটিআরসি কর্তৃক জানা গেছে, অচিরে দেশে ফোর-জি চালু হবে, সেজন্য ৭০০ মেগাবাইট তরঙ্গ উন্মুক্ত করা হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যেখানে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো থ্রিজি নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্রাহকদের সেবা দিতে ব্যর্থ, সেখানে দেশে ফোরজি চালু করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত হবে।
অধিকাংশ মোবাইল অপারেটর কোম্পানির নেটওয়ার্ক সমস্যা রয়েছে। অসহনীয় কলড্রপে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন মোবাইল গ্রাহকরা। বিটিআরসি মোবাইল কোম্পানিগুলোকে কলড্রপের ক্ষতিপূরণ গ্রাহকদের প্রদানের জন্য বারবার নির্দেশ দেওয়ার পরও গ্রাহকরা ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। কলড্রপের ক্ষতিপূরণের টাকা গ্রাহকদের ফেরত দেওয়ার বিষয়ে বিটিআরসি ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিলেও মোবাইল কোম্পানিগুলো সে নির্দেশনা বিভিন্ন টালবাহানায় উপেক্ষা করে যাচ্ছে। তবে বিটিআরসি কর্তৃপক্ষ বলেছে, পুনরায় তাগিদপত্র প্রেরণ করেছে। তথ্য মতে, বর্তমানে ৬টি মোবাইল কোম্পানির দিনে মোট কলের সংখ্যা প্রায় ১৮০ কোটি মিনিট। এর মধ্যে গড় কলড্রপের হার ০১ শতাংশ। সে হিসেবে প্রতিদিন ০১ কোটি ৮০ লাখ মিনিট কলড্রপ হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, মোবাইল কোম্পানিগুলো দিনে কলড্রপ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে গ্রাহক প্রতি কলড্রপের হার ০.১১ শতাংশ। অপরদিকে মোবাইল কোম্পানিগুলো ইন্টারকানেকশন একচেঞ্জের ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের দুর্বলতার কারণে কলড্রপ হচ্ছে। এ বিষয়ে বিটিআরসি বলেছে, কলড্রপ হতে পারে, তবে এটা সহনীয় মাত্রায় হতে হবে। পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কলড্রপ হলে গ্রাহক টাকা বা টকটাইম ফেরত পান, কিন্তু বাংলাদেশে রয়েছে ভিন্নতা। এ বিষয়ে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
মোবাইল কোম্পানিগুলোর ব্যবসা হলো সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো। প্রতিনিয়ত মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে বিড়ম্বনা ও মোবাইল কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন লোভনীয় অপারের নামে অভিনব প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ হতে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু ভুক্তভোগী গ্রাহকদের অধিকাংশ এসব বিষয়ে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রতিবাদ বা আইনের আশ্রয়গ্রহণ করেন না। এতদবিষয়ে গ্রাহকরা মোবাইল কোম্পানিগুলোর কাছে অভিযোগ করলেও কোনো প্রতিকার পান না। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৫৯ ধারা মতে, গ্রাহকদের অসুবিধা বা অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য প্রত্যেক টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সংখ্যক অভিযোগ কেন্দ্রের ব্যবস্থা রাখার বিধান থাকলেও টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানগুলো তা প্রতিপালন করে না। মুঠোফোনে বিভিন্ন লোভনীয় অফারের ক্ষুদেবার্তা প্রেরণ করে প্রতারণা ও টাকা কর্তনের জন্য ইতোপূর্বে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে অনেকে মামলা করেছে।
সম্প্রতি বিটিআরসির মোবাইল ফোনের কলরেট পুনঃনির্ধারণের প্রস্তাব পুনঃবিশ্লেষণ করার নিমিত্তে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ফেরত পঠিয়েছে। সূত্র মতে, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের মূল্য হ্রাসে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণের কথা জানালেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। অপরদিকে বিটিআরসি মুঠোফোনভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার মূল্য কত হওয়া উচিত তা নির্ধারণ করতে কস্ট মডেলিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ যাবৎ কস্ট মডেলিং ব্যতীত ইন্টারনেট সেবার গ্রাহকদের কাছ থেকে যে অর্থ আদায় হয়েছে তা যুক্তিসঙ্গত নয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
মোবাইল ফোন সাধারণ জনগণের অত্যাবশ্যকীয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তের সবাই ব্যবহার করছে। গ্রাহক সমাজ সহনীয় পর্যায়ে কলরেট নির্ধারণ, অযথা বিরক্তি থেকে পরিত্রাণ চায়। সরকারের উচিত মোবাইল অপারেটরগুলোর লাগাম টেনে ধরা। অন্যথায় গ্রাহকরা প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হতেই থাকবে।
|