আমরা শান্তিপ্রিয় বাঙালি। দেশের কিছু কিছু প্রশাসন থেকে কত মহৎপ্রাণই তো বিদেশে শান্তি মিশনে গিয়ে প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিচ্ছেন। কিন্তু এই শান্তিপ্রিয় দেশে মনের মধ্যে সবাই কি শান্তি লালন করেন? কেউ কেউ তাই মনের দুঃখে বলেও থাকেন—‘শান্তিবালা মরে গেছে!’ ঠিকই তো, গ্রাম থেকে শহরে সবখানে আজ শান্তির নামে একশ্রেণির মানুষ কেবলই অশান্তির চাষাবাদে ব্যস্ত। তাদের অশান্তির বীজে উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য অর্থাৎ তাদের ‘বিবেক এবং মেধা’য় কীট-পতঙ্গের উপদ্রব থাকলেও তা নিবারণের কোনো কীটনাশক নেই, নেই কোনো প্রতিকারের পথ!
‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’ বলে এখান থেকেই শুরু করা যেতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একজন শিক্ষকই পারেন জাতির মেরুদন্ড সোজা রাখতে। আজকাল সেই শিক্ষক যেমন সেই মহৎ কাজটি করতে ব্যর্থ, তেমনি কোনো কোনো শিক্ষক আবার সেটা সোজা রাখতে গিয়েও কি মূল্যায়ন পাচ্ছেন কোনো? আজ অনেক শিক্ষকই প্রতিষ্ঠানে মনোযোগী না হয়ে তাদের ব্যবসায়িক কোচিং সেন্টারে বা প্রাইভেট পড়ানোর কাজে মগ্ন আছেন! তিনি যা বেতন পাচ্ছেন তা হারাম নাকি হালাল—সে প্রশ্নের জবাব কখনই চাই না। তবে প্রশ্ন হলো তিনি কি তার বিবেকটুকু বিসর্জন দিয়েছেন? যা হোক, এখানে আবার শুধু শিক্ষকদের দোষ দিয়েই আমরা পার পেতে পারি না। শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানও তো এখানে দায় এড়াতে পারে না। বারবার সিলেবাসে কিছু সংযোজন বা সেখান থেকে কিছু বিয়োজন শিক্ষকদের শিক্ষা প্রদানে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। নতুন একটা বিষয় বা পরীক্ষার পদ্ধতি পরিবর্তন হতেই পারে। সাথে সাথে সেটা নিয়ে কাজ ও কথা নড়াচড়ায় অনেক ব্যয়-খরচ করা হলেও এক সময় ফল খুব একটা ভালো পাওয়া যায় কি? সে ফল শূন্য না হলেও যেটুকু আউটপুট পাওয়ার কথা তা আর পাওয়া যায় না অনেক সময়।
আবার পূর্বে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত শিক্ষকদের পন্ডিত বলা হতো (যেমন ‘পণ্ডিত মশাই’ লিখেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী), তাদের সম্মান করা হতো। অভিভাবকদের মুখেও একটা কথা প্রচলিত ছিল ‘বাপ-মা বানায় ভূত, ওস্তাদে বানায় পুত’। বড়দের কাছে গল্প শুনেছি যে, অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানোর পর পন্ডিতজিকে বলতেন, ‘এর চামড়াগুলো আপনার, হাড়গুলো আমার!’ এর মানে এই নয় যে, পন্ডিতজি ছাত্রকে মেরে ছাত্রের গায়ের চামড়া ছিঁড়ে ফেলবেন। শাসনের দিককে প্রাধান্য দিতে এমনটি বলা হয়েছে, যাতে করে সেসব অভিভাবকের সে সন্তানরা শাসনের মাধ্যমে আদব এবং সঠিক শিক্ষা নিয়ে মানুষ হতে পারে। এখন তো চিত্র তার সম্পূর্ণ বিপরীত। কোনো শিক্ষক কোনো ছাত্রকে বেত্রাঘাত করলে বরং শিক্ষকদেরই এখন চামড়া ছেঁড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে! কোনো ছোট ক্লাসের ছাত্র ক্লাসের ফাঁকে বা টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের দ্বিতীয় তলা থেকে নিচে যে কোনো শিক্ষক বা অন্য ছাত্রের গায়ে থুতু ফেলবে! আর তাকে শাসন করা যাবে না—এটাও যেমন মেনে নেওয়া যায় না, তেমনি তাকে যে ভীষণভাবে মেরে রক্তাক্ত করে শাসন করতে হবে, এমনটিও কিন্তু কখনই নয়। তাকে সোহাগ এবং শাসনের সুরে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে ওদের আদব শিক্ষাসহ সুন্দর করে গড়ে তোলার পরিবেশ বা শিক্ষা আজ কোথায়? তাই শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর মাঝে এখন ব্যাপক ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্রের প্রতি স্নেহ এবং শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ উঠে যাচ্ছে! শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক প্রহৃত বা লাঞ্ছিত হওয়ার মতো কর্মটা তো এদেশে সচরাচর চোখে পড়ে!
আমরা বাঙালি প্রকল্প ভালোবাসি। প্রকল্পের মধ্য দিয়ে যেমন দেশের উন্নয়ন বা গরিবকে সাহায্য করা যায়, তেমনি কিছু কিছু খয়ের খাকেও দীর্ঘদিন বসে রাখার কারণে বশে রাখা যায়। বিভিন্ন প্রকল্পের নামে অর্থ লুটপাট আমাদের দেশে একটা সাধারণ ঘটনা। প্রকল্পপ্রেমী সবাই না হলেও যারা লুটে খাওয়ার তারা খাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে! দেশ-জনতা বা গরিবের হকে ঢুকছে অন্য অনেকের হক! সেখানে ঢুকছে কোনো কোনো প্রকল্পধারী স্বজনদের অংশ। রাস্তা, সেতু, মসজিদ, মন্দির, বা গরিবদের অংশে অনেকেই ভাগ বসায় এখানেই। অনেক দিন ঘুরে ভুক্তভোগীরা যা খরচ করে অনেক প্রকল্পের সুযোগে তারা সে খরচের অংশটুক একসঙ্গে পেয়ে নিজেদের এতদিনের শ্রমকে ভাগ্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে খুশি থাকে! আবার অনেক উন্নয়নমূলক কাজের জন্য প্রকল্পের টাকা ভাগ-বাটোয়ারাতে কোনো কাজের কাজ হয় না! এখানে শুধু কতিপয় প্রকল্পপ্রেমীই দায়ী নয়, বরং যারা প্রকল্পের সুবিধাভোগী তারাও অন্যায়ভাবে প্রকল্পের অর্থের সুযোগ নিতে অনেক সময় মন্দপথ অবলম্বন করে থাকে।
আমরা বাঙালি, খোলা হাতে দান করি। বিশেষ করে বন্যায় বা শীতে দানের হিড়িক পড়ে যায়। পত্রপত্রিকায় প্রতিদিন কিছু শীতবস্ত্র বা বন্যার্তদের দানের মৌসুমি চিত্র দেখে ওসব আমাদের সয়ে গেছে। আমন্ত্রিত হয়ে বা না হয়ে এমন অনেক অনুষ্ঠানে ফটোসেশনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রবীণ মহিলা বা পুরুষকে টেনে এনে ত্রাণ বা শীতবস্ত্র বিতরণের অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। ছবি এবং সংবাদ ছাপাতে যা করতে হয়, তাও করা দেখেছি। আমাদের দানের হাত এত বড়! সে কি আর এমনি এমনি বড় হয়? সবাইকে দোষ দিয়ে তো আর দায় বহন করতে পারব না, তাই বলি—বিভিন্ন প্রশাসন বা বিভিন্ন বিভাগের কেউ কেউ কলমে গোপনে চুরি করি, ঘুষ খাই আর প্রকাশ্যে দান করি, যদিও বা সে চুরি আর ঘুষের আনুপাতিক হার দানের চেয়ে হাজার গুণেও বেশি বলতে হয়! এমনকি বিদেশে কোনো গেমসে খেলতে গিয়ে গামছার লোভ সামলাতে না পেরে তা চুরিরও অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের। তাতে করে এ জাতির নাম বিভিন্ন মিডিয়ায় ফলাও করে প্রকাশ করা হয়েছে, বিশ্ব আমাদের কীর্তি দেখেছে! বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় উদাহরণ বা কোনো কিছু বোঝাতে আমার এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ইংরেজিতে একটা কথা বলেছিলেন যার বাংলাটা এ রকম—‘কখনো কখনো সীমাকে লঙ্ঘন কর, সীমাকে জানতে।’ দান করতে তাই চুরি করাটা কি সে রকমই মহৎ চিন্তার প্রকাশ? যারা ঠিক চুরি করেন, ঘুষ খান—ঠিক তারাই এটা বলতে পারবেন হয়ত!
পিয়ন দরজা না খুললে বস্ কী করে অফিসে ঢুকবেন? তাই কোনো কোনো অফিসে পিয়নের ক্ষমতা দেখে যত না বিমোহিত, অভিভূত হই, বিস্মিত হই তারও বেশি! কোথাও কোথাও কাজ করতে গেলে আমাদের মতো অফাটা কেষ্টদের আগে পিয়নের হাতেই গলা বাড়িয়ে দিতে হয়। প্রচলিত বিধানে আমরা তাদের শিকার বলেই কি পার পেতে পারি? না পারি না! কারণ আমরাই কি বেশি ভালো! না-জায়েজ কাজকে জায়েজের ফর্মুলায় সেঁটে দিতে পিয়নের হাত ধরে বসের দরজায় পৌঁছে ভাব করি বসের সঙ্গে! যেচে ঘুষ দিয়ে দারুণ সফলতা অর্জন করে ফেলি! আর যেখানে আমাদের ধান্ধা ধোপে টেকে না, সেখানে বসের কাজও পিয়নের দ্বারা সম্পন্ন করে নিতে পটু আমরাই। এক্ষেত্রে পিয়ন আমাদেরই যোগ্যতম বস্ হয়ে ওঠার নজিরও দেখে থাকি কেউ কেউ! কারণ বাংলায় কত অযোগ্যজনই তো টাকা বা মামার জোরে বস্ সেজেছেন! কত যোগ্যজনও তো সুবিধার অভাবে পিয়নই থেকে গেছেন! আমার কথায় কারো রাগ বেড়ে যাওয়ার কিছু নেই। এ চিত্রটি বাংলা সিনেমায়ও বেশ উপভোগ্য নয় কি?
নাম নিয়ে বড় থাকা মানুষদের কীর্তি দেখে আর সব মান-মর্যাদায় কম হওয়া মানুষ (সকল মানুষ সমান—মুখে বলি, কিন্তু কিছু মানুষ বেশি মর্যাদাবান, যা হৃদয়ে তা লালন করি) যেমন—চাষি, মজুর, শ্রমিক, কামার, কুমোর, জেলে, মুচি এমন অনেকেই পরিস্থিতির শিকারে হোক, ক্ষুধার জ্বালায় হোক আর লোভের বশেই হোক নীতি থেকে বঞ্চিত থেকে নিজের কর্ম সম্পাদন করে গেলে তার দায় কেউ কেউ নিতে অপারগ!
এ সবই তো শেষ কথা নয়। আরো অনেক বলা যাবে, লেখাও যাবে। কতজনই তো তার নিজের স্বার্থকে বহাল রাখতে মিডিয়ায় পত্রিকার পাতায়, টক শোতে প্যাঁচালে মত্ত রয়েছেন! ভালো হতে পয়সা না লাগলেও উপদেশ লাগে! কিন্তু কারো দেওয়া উপদেশও তো আরেকজনের অন্তরে নয়, বরং মুখেই উপনীত হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়! তাই বেশি বেশি উপদেশমূলক শুদ্ধি বা পরিশীলনের কথা বলে আর কী লাভ হবে? বেশিকিছু না বললেও জ্ঞানীরা তো ইশারায় বুঝে ফেলেন। তবে জ্ঞানী প্রশ্নেও আমাদের একটা সামান্য দাবি আছে—দেশে কিছু জ্ঞানী মানুষের খুব দরকার, দরকার কিছু যোগ্য মানুষেরও।
|