এক রাজার একজন কর্মচারী ছিল। তাকে রাজা যেখানেই দায়িত্ব দিয়েছেন সেখানেই তিনি কোনো না কোনোভাবে অবৈধ উপায়ে টাকা রোজগারের রাস্তা বের করেছেন। একদিন রাজা মন্ত্রী এবং গণ্যমান্য সভাসদদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন, কিভাবে এই কর্মচারীকে অসদুপায় অবলম্বন করা থেকে নিবৃত্ত করা যায়! মন্ত্রীরা বললেন, “মহারাজ এমন একটি জায়গায় তাকে নিয়োগ দেন, যেখানে কোনো টাকার কারবার নেই এবং যেখানে কোনো মানুষ নেই, তাহলেই সে আর ঘুষ নিতে পারবে না।” রাজা ঐ কর্মচারীকে সভাসদদের পরামর্শে নদীর ঢেউ গুনতে বসালেন। তার কাজ হলো সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নদীর ধারে বসে তার সামনে দিয়ে যত ঢেউ যাবে তা গণনা করে রাজাকে জানানো। কয়েকদিন পর দেখা গেল ঢেউ গুনতে গিয়ে উক্ত কর্মচারীর আয় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ ঐ এলাকা দিয়ে যেসব নৌকা বা জাহাজ চলাচল করে সেগুলোকে রাজচিহ্ন-সংবলিত পতাকা নেড়ে কাছে ডেকে আনে এবং জাহাজের সারেং বা নৌকার মাঝিকে বলে, “রাজা আমাকে নদীর ঢেউ গুনতে দিয়েছেন আর তোমার নৌকা বা জাহাজ আসতেই ঢেউ ভেঙে আমার গোনা এলোমেলো হয়ে গেছে। তাই আমি তোমার নামে রাজার কাছে নালিশ করবো।” এমন পরিস্থিতিতে মামলা-মোকদ্দমা বা রাজার সমন এড়াতে জাহাজের সারেং বা নৌকার মাঝি তত্ক্ষণাত্ কিছু টাকা দিয়ে নিস্তার পেতেন। ফলে ঐ কর্মচারীর অসত্ রোজগার বেড়ে যায়।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিঃসন্দেহে বাবা-মায়ের সুযোগ্য দেশপ্রেমিক ও নির্ভীক সন্তান। কিন্তু তার এবং তার মন্ত্রিপরিষদের অক্লান্ত চেষ্টার পরেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতি থেকেই যাচ্ছে। বাস্তবিক পক্ষে শুধু রাজা সত্ হলেই সবকিছু সঠিকভাবে চলে না। এর জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যেকটি কর্মচারী-কর্মকর্তার সত্ হওয়া দরকার। এদেশে মোটামুটি ১২ লাখ লোক সরকারি চাকরিজীবী। চাকরি যেখানে সোনার হরিণ, সেখানে এই ১২ লাখ লোককে বিশেষ ভাগ্যবান এবং সৃষ্টিকর্তার বিশেষ অনুকম্পা প্রাপ্ত হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সৌভাগ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই সরকারি কাজে তাদের আরও সত্ ও নিষ্ঠাবান হওয়া দরকার নয় কি?
পত্রপত্রিকাগুলো দুর্নীতির খবরে সয়লাব। বগুড়া বিআরটিএ কার্যালয়ে নাকি ঘুষের টাকার হিসাব রাখতে অতিরিক্ত ক্যাশিয়ার নিয়োগ করা হয়েছে। এ খবর অবশ্য পুরনো। সাম্প্রতিক একটি খবর হলো, “নিয়োগ বাণিজ্যে অস্থির দুই বিশ্ববিদ্যালয়”। খবরে প্রকাশ, এক যুবক জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টাররোলে চাকরি পেতে ৮ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন একজন শীর্ষ ব্যক্তিকে। অন্যদিকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে শিক্ষকসহ মোট ৮০ জনকে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় উল্লেখিত বিশ্ববিদ্যালয় দুটিতে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করেছে।
আমরা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি অবৈধ অর্থের সন্ধান না করি তাহলে সত্যিকার অর্থেই দেশটি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হবে। বর্তমান সরকার আমাদের বেতন যে পর্যায়ে নিয়েছেন তাতে দুর্নীতি করার অবস্থা আমাদের আছে কিনা তা ভাববার বিষয়। মানুষের লোভ-লালসা, প্রত্যাশা বা আশা কখনোই শেষ হওয়ার নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে জীবনের আসল মর্ম উপলব্ধি করবে। এই নৈতিক উপলব্ধিবোধ জাগ্রত করার প্রথম সামাজিক প্রতিষ্ঠান হলো পরিবার। এছাড়া প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরও নৈতিকতা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আমরা যারা মেধার গুণে বিনা পয়সায় নিয়োগ পেয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানে সম্মানের সাথে চাকরি করছি তাদের স্বীয় প্রতিষ্ঠান ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। আমাদের কাছে আমাদের কর্মক্ষেত্রই ধর্মীয় উপাসনালয়ের মতোই পবিত্র—কারণ এখান থেকেই আমাদের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগ সেবামূলক বা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। সেখানে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ পাওয়া লোক শুধুই সুযোগ খুঁজবে—কিভাবে নিজের নিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকৃত টাকার ১০ গুণ থেকে ১০০ গুণ টাকা উসুল করা যায়। এ ধরনের অসত্ চিন্তা-চেতনার মানুষ হয় ভোগসর্বস্ব। নিজের স্বাচ্ছন্দ্য ও উচ্চাভিলাষী প্রয়োজন মেটাতে তারা নিজের দেশও বিকিয়ে দিতে পারে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অযোগ্য লোককে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেয় না। কারণ সেখানে কর্মচারী-কর্মকর্তার মেধা ও নিষ্ঠা ঐ প্রতিষ্ঠানটির উন্নতির জন্য অপরিহার্য। আমাদের দেশে ঢেউ গুনতে অর্থের দৌরাত্ম্য থেকে বাঁচতে হলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সর্বাগ্রে জাগিয়ে তুলতে হবে দেশপ্রেম। সকল প্রকার সেবামূলক কর্মকাণ্ডকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে—রাখতে হবে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও নজরদারির মধ্যে। সবচাইতে বড় বিষয় হলো যেকোনো অপরাধমূলক কাজের বিচার এবং শাস্তি নিশ্চিত করা।
সুপ্রিয় পাঠক, আমার এই ভাবনা দেশের প্রতি ভালোবাসা ও মমত্ববোধ থেকেই নিঃসরিত। আমরা চাই আমাদের জাতিকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে।