উন্নত ও ক্ষমতাধর দেশগুলোয় বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে যত গোলাগুলির ঘটনা ঘটে তার প্রায় এগারো গুণ বেশি সংঘটিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও বন্দুকের গুলিতে হত্যার ঘটনা ঘটে। বলা হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব খুনের নেপথ্যে থাকে একজন মানুষ। আর এতে করেই বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। এবার দৃষ্টি দেওয়া যাক পূর্ব এশিয়ার দিকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এমন একটি উদ্যান, যার অব্যাহতভাবে পরিচর্যার প্রয়োজন। অঞ্চলটি এখনো বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং মার্কিন স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কোনো সংঘাত সৃষ্টি মানে সভ্যতার সমাপ্তি। কিন্তু সব পক্ষের নীতিনির্ধারকরা তাদের পূর্বসূরিদের গ্রহণ করা নীতিতেই আঁকড়ে ধরে আছেন। প্রতিযোগিতার রেখাটি স্পষ্ট এবং অত্যন্ত সামরিকায়নকৃত। ফলে ঝুঁকিটা অত্যন্ত বেশি। এশিয়ার অন্যান্য অংশে প্রবেশ ও প্রভাব বিস্তারের সুফল বিপুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও প্রতিযোগিতার গতিশীলতা অনেক কম প্রত্যক্ষ এবং বেশ অস্পষ্ট।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান ভূরাজনীতিতে অনমনীয়তা রয়েছে, আর বাকি অঞ্চল ভূরাজনৈতিক ওয়াইল্ড ওয়েস্টের মতো। এশিয়ার কৌশলগত ভরকেন্দ্র দৃশ্যত ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরের দিকে বদলে যাচ্ছে। অনেক কারণে এই পরিবর্তন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ওপর এটা কোথায় ও কিভাবে প্রভাব ফেলছে সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিশ্বকে নাড়া দিয়েেেছ। লাস ভেগাস একটি প্রমোদ নগরী। সব দুঃখ ভুলে যেখানে জীবনের নেশায় মাতে মানুষ, আমেরিকার সেই শহরেই আজ মৃত্যুর মিছিল। মার্কিন মুলুকের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড এটি। লাস ভেগাস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আইএসের সম্পৃক্ততা আছে কি নেই, সেটা আমার বিবেচনার বাইরে। তবে বিবেচ্য হচ্ছে, আইএস এর দায় স্বীকার করেছে।
এ হত্যাকাণ্ডের আগে স্টিফেন প্যাডক যে এক লাখ ডলার ফিলিপাইনে পাঠিয়েছিলেন, এটা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে ফিলিপাইনের জঙ্গি কার্যক্রমে তিনি সহায়তা দিয়ে থাকতে পারেন! এখন রোহিঙ্গা মুসলমানদের দুরবস্থার সুযোগে এ রকম দাতা এগিয়ে আসতে পারে। আরেকজন স্টিফেন প্যাডকের জন্ম হতে পারে! তাই রোহিঙ্গা পরিস্থিতির দিকে সবার দৃষ্টি থাকবেই। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্যাম্পে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। পাঠকমাত্রই জানেন, লাস ভেগাস কী জন্য বিখ্যাত। সেখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি বড় বড় ক্যাসিনো, যেখানে জুয়া খেলা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যেসব হোটেলে জুয়া খেলা হয়, সাধারণত সেসব হোটেলে রাত্রীবাস ফ্রি; অর্থাৎ যারা জুয়া খেলতে আসেন, তারা থাকেন ফ্রি আর জুয়া খেলে হয় হেরে যান নয়তো আবার জিতে নিয়ে যান মিলিয়ন ডলার। গত ২ অক্টোবর ওই লাস ভেগাসেই ঘটল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্যতম হত্যাকান্ড। একজন পেশাদার জুয়াড়ি স্টিফেন প্যাডক গুলি করে মারল ৫৯ সাধারণ মানুষকে। এ ঘটনায় হতবাক সারা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ। আরো অবাক হতে হয়েছে এটা শুনে যে, আইএস অর্থাৎ চরমপন্থী সংগঠন ইসলামিক স্টেট এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত। আইএস তার দায় স্বীকারও করেছে।
অপরদিকে লন্ডনের দি ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে গেল ২৭৫ দিনে ২৭৩টি আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। আর বিখ্যাত সংবাদ সাময়িকী ইকোনমিস্ট ১৯৮২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে যত সন্ত্রাসী হত্যাকান্ড ঘটেছে, তার একটি বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে। তাতে দেখা যায়, ২০১২ সালের পর থেকে এ ধরনের হামলার প্রবণতা বেড়েছে। পাঠক নিশ্চয়ই স্মরণ করতে পারেন অরল্যান্ডো নাইটক্লাবে হামলার ঘটনায় ৪৯ জনের মৃত্যু হয় ২০১৬ সালে। ক্যালিফোর্নিয়ার সানমারডিনোতে ১৪ জনের মৃত্যু হয় ২০১৫ সালে। ২০১২ সালে নিউটাউন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মারা যায় ২৭ জন। এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কখনই কোনো জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠেনি; এখন উঠছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইউরোপে, বিশেষ করে ফ্রান্স, ব্রাসেলস, জার্মানি কিংবা লন্ডনে জঙ্গি আক্রমণ বেড়েছে। আইএসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গিরা, যারা এক সময় সিরিয়ায় যুদ্ধে করেছে, তারা এখন ইউরোপে ফিরে গিয়ে জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে গেল দুই বছরে যেসব জঙ্গি আক্রমণ হয়েছে, তাতে আইএসের সংশ্লিষ্টতা থাকা অবিশ্বাস্য কোনো বিষয় নয়। তবে লাস ভেগাসের হত্যাকান্ডের সঙ্গে আইএসের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও তা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো স্বীকার করবে কি না, এটা একটা বড় প্রশ্ন।
যারা বিশ্বব্যাপী জঙ্গি কার্যক্রম নিয়ে কাজ করে, তারা লক্ষ করেছে, সিরিয়া-ইরাকের আইএসের কার্যক্রম সীমিত হয়ে আসছে। আইএস সেখানে পরাজিত হয়েছে অনেকটা। তবে এখানে যেসব জঙ্গি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তারা এখন সেখান থেকে সটকে পড়েছে। আগামীতে জঙ্গি কার্যক্রম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তৃত হবে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। এ ক্ষেত্রে দুটি দেশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন অনেকে। একটি ফিলিপাইনে, অপরটি মিয়ানমার বাংলাদেশে রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে। চলতি মাসে প্রকাশিত দ্য ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিন সংখ্যায় অধ্যাপক জাকারি আবুজার একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে ফিলিপাইনের জঙ্গিবাদের প্রসার নিয়ে। অধ্যাপক আবুজা যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ন্যাশনাল ওয়ার কলেজের একজন অধ্যাপক। গত মে থেকে ফিলিপাইনের সেনাবাহিনী আইএস-সংশ্লিষ্ট আবু সায়াফ গ্রুপের সঙ্গে যে যুদ্ধে লিপ্ত, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি।
জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখন সম্প্রসারিত হয়েছে ফিলিপাইনে। গেল ২৯ মে সিএনএন বলছে, ফিলিপাইন কি হতে যাচ্ছে আইএসের পরবর্তী শক্তিশালী ঘাঁটি? ওই প্রতিবেদনে একটি মসজিদে আইএস কর্তৃত্ব তাদের পতাকা উত্তোলন করার দৃশ্য আমরা দেখেছিলাম। এ অঞ্চলের তিনটি দেশে ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়ায় গত দুই বছরে যেসব জঙ্গি কর্মকাণ্ড হয়েছে এবং যার সঙ্গে আইএস জড়িত, তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে সিএনএনের প্রতিবেদনে। ২০১৬ সালের ২৮ জুন কুয়ালালামপুরের একটি নাইটক্লাবে জঙ্গি হামলায় আটজনের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি জাকার্তায় সন্ত্রাসী হামলায় চারজনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালের ২৪ মে জাকার্তায় সন্ত্রাসী হামলায় তিনজনের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ফিলিপাইনের দাভাও শহর সন্ত্রাসী বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় ১৪ জনের। আর মারাবির ঘটনা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। প্রতিটি ঘটনায় আইএস তার দায় স্বীকার করেছে। গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন তৎপর, যাদের সঙ্গে আইএসের যোগাযোগ রয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে, মরো লিবারেশন ফ্রন্টের কথা। এরা তৎপর সুলু দ্বীপপুঞ্জ এলাকায়। আবার ব্রুনাইয়ে আবু সায়াফ গ্রুপ তাদের তৎপরতা সম্প্রসারিত করেছে। আইএস সম্প্রতি সিরিয়া-ফেরত জঙ্গিদের নিয়ে এ অঞ্চলে নতুন একটি ব্রিগেড তৈরি করেছে, পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এ ব্রিগেডের তৎপরতা রয়েছে। এ ব্রিগেডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন হাপিলন নামে এক জঙ্গি। হাপিলন এসেছেন সুলু অঞ্চল থেকে। ২০১৬ সালে আইএস তাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আমির হিসেবে ঘোষণা করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মার্কিনি গোয়েন্দাদের মতে, হাপিলন ইংরেজি বা আরবি ভাষা কিছুই বোঝেন না এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তার জ্ঞানও সীমিত।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাকে ধরার জন্য পাঁচ মিলিয়ন ডলার পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেছে। কয়েক হাজার জঙ্গি বর্তমানে এ অঞ্চলে জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত। ফলে আগামী দিনগুলোয় এ অঞ্চলে যে অস্থিরতা বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওই জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হলো রোহিঙ্গাদের নাম। ফিলিপাইনে জঙ্গি উত্থানের পাশাপাশি এখন রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে বলে অনেক গবেষক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সিএনবিসি টিভি চ্যানেল তাদের এক প্রতিবেদনে গত ১৩ সেপ্টেম্বর বলেছে, রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো সুযোগ নিতে পারে। একটি আশঙ্কার কথা বলছেন অনেকে যে, রাখাইন অঞ্চল সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষ করে সুলু অঞ্চলে অবস্থানরত জিহাদিরা সমুদ্রপথে রাখাইনে যেতে পারে এবং সেখানে সন্ত্রাসী তৎপরতায় লিপ্ত হতে পারে। সুলু অঞ্চল আর রাখাইন অঞ্চলের অনেক মিল আছে। অস্ত্র আনা-নেওয়া কিংবা সন্ত্রাসীদের মুভমেন্টের জন্য সমুদ্রপথ খুবই উপযোগী। ফলে ফিলিপাইনের জিহাদিরা যদি ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলের শহর মারাবি থেকে উৎখাত হয়ে আরাকানে আশ্রয় নেয়, তখন অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
এখন পর্যন্ত আরাকানে আরাকান সালভেশন আর্মির খবর আমরা জানি, যাদের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণের কারণে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এর বাইরে আরো কয়েকটি গ্রুপের অস্তিত্ব রয়েছে। মজার ব্যাপার, সালভেশন আর্মি খুব বড় সশস্ত্র সংগঠন নয়। কোচিন লিবারেশন ফোর্স মিয়ানমারের বড় বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ। এরা কোচিন প্রদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে, কিন্তু মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সেখানে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেনি। কোচিনরা ধর্মীয়ভাবে খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসী। বোঝাই যায়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মুসলমানদের টার্গেট করেছে। এখন সালভেশন আর্মি কতটুকু রোহিঙ্গাদের স্বার্থ দেখে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
|