‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত’ এই শ্লোগান আমাদের খুবই পরিচিত। শ্লোগানটি আমরা যখন যে উপলক্ষেই দেই না কেন তার মর্মার্থ এই—আজকের দিনে যদি আমরা শিশুদেরকে সঠিক শিক্ষা-দীক্ষায় লালিত-পালিত করে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি তবে এই শিশুরাই একদিন পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হবে নেতৃত্বের ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে। আমাদের এই ভাবনায় কোনো ভুল নেই সত্য, কিন্তু আমাদের এই ভাবনাকে বাস্তবে রুপান্তরিত করতে হলে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে আমাদের অনেক বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে—দেশের মোট শিশুর মধ্যে একটি বড় অংশ হচ্ছে পথশিশু। যারা জন্মের পর থেকেই বেড়ে ওঠে অযত্নে-অবহেলায়।
আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং মোস্ট অ্যাট রিস্ক অ্যাডেলেসেন্ট (এমএআরএ) নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের ২০১২ সালের জরিপ অনুযায়ী দেশে প্রায় ৪ লাখ ৬৫ হাজার পথশিশু রয়েছে। যার মধ্যে কেবল রাজধানীতেই রয়েছে প্রায় ৩ লাখের বেশি মৌলিক সুবিধা বঞ্চিত পথশিশু। অন্যদিকে বিআইডিএস ও ইউনিসেফের এক গবেষণা মতে, দেশে ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৮ জন পথশিশু রয়েছে। কেবল ঢাকা শহরেই রয়েছে ৭ লাখ পথশিশু। দেশে পথশিশুদের সংখ্যা বৃ্দ্ধির গ্রাফটা ক্রমশই উর্ধ্বমুখী। কোনোভাবেই সংখ্যাটিকে নিয়ন্ত্রণেরে মধ্যে রাখা যাচ্ছে না।
দেশের মোট জনসংখ্যার এই বড় অংশটির বসবাস রাস্তার ধারে ফুটপাত, শহরের বিভিন্ন অলিগলি, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট অথবা বস্তিতে। যারা এক বেলা খাদ্যের অভাবে ধুঁকছে, ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নিয়েছে, টোকাইগিরি করছে কেউবা আবার ফুল নেবেন বলে রাস্তায় হাক ছাড়ছে। আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ানো এই পথশিশুরা খাদ্যের জন্য সংগ্রাম করছে জন্মের পর থেকেই। নিজের খাবারের সন্ধানে ধীরে ধীরে এরা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। মাদকের বিভিন্ন উপকরণ হয়ে উঠছে এদের নিত্যসঙ্গী।
স্বাভাবিক জীবন থেকে এরা ছিটকে পড়ছে অনেক দূরে। দেশ ও জাতির ভবিষ্যত নির্মাণে কোনো কাজেই অংশগ্রহণ করতে পারছে না। এই পথশিশুরা কোনো অবদান রাখতে পারছে না দেশের অগ্রগতিতে। ফলে সমস্বরে উচ্চারিত আমাদের সেই শ্লোগানটি ধীরে ধীরে তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে। পথশিশুদের এই পশ্চাৎপদতার একটি অন্যতম কারণ, এদের মৌলিক অধিকারগুলোর সমন্বয়হীনতা। কিন্তু প্রতিটি সন্তানই ভূমিষ্ঠ হয় তার মৌলিক অধিকারগুলো নিয়েই, চাই সে বাদশা কিংবা ভিখারীর সন্তান হোক।
আমরা এখন এগিয়ে চলেছি স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সামনে রেখে। এই অগ্রযাত্রায় সাফল্য পেতে হলে মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে হবে সমাজের প্রতিটি স্তরে। দূর করতে হবে শ্রেণি বৈষম্য
একটি দেশের নাগরিক হিসেবে শিক্ষার সহায়তা পথশিশুদের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম। কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র কখনই উন্নত হতে পারে না, যদি শিক্ষাকে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া না যায়। কিন্তু এই অধিকার সরবরাহ করা কেবল সরকারের একার পক্ষে কষ্টসাধ্য। এই সঙ্কট সমাধানে প্রত্যেককেই নিজের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমরা আমাদের সংকীর্ণ মানসিকতার বদৌলতে পথশিশুদের বাদ দিয়েই ব্যাস্ত হয়ে পড়েছি সমাজ সংস্কারে। তাই আমাদের অগ্রগতির আজ এই কচ্ছপ দৌড় অবস্থা।
তবে এসবের মাঝে আশার বাণী হচ্ছে—বর্তমানে তরুণ-তরুণীদের বিভিন্ন সংগঠন এক্ষেত্রে খানিকটা এগিয়ে এসেছে। তারা বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করছে পথশিশুদের মৌলিক অধিকারগুলো সমন্বয় করবার। আর দীর্ঘদিন ধরেই এই সকল বাস্তুহারা শিশুদের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে ইউনিসেফ। এছাড়াও সরকারের সাথে একিভুত হয়ে এই প্রকল্পে কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অপরাজেয় বাংলাদেশ। কিন্তু এ ধরনের ক্ষণিকের সহায়তা হয়তো তাদের সাময়িক আনন্দের উপলক্ষ হচ্ছে, তথাপি এই স্বল্প প্রচেষ্টা পথশিশুদের সঙ্গে নিয়ে জাতির ভবিষ্যত বিনির্মাণে খুব বেশি অবদান রাখতে পারছে না। এত বড় একটি জনগোষ্ঠির জীবনযাত্রার মান যেখানে নিম্নগামী সেখানে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের সহযোগিতা খুব বেশি ফলপ্রসূ হবার কথাও নয়। আর এ কারণেই আমাদের উচিত, দেশের উন্নতি এবং অগ্রগতির কথা বিবেচনায় রেখে পথশিশুদের অধিকার পূরণে যত্নবান হওয়া।
আমরা এখন এগিয়ে চলেছি স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সামনে রেখে। এই অগ্রযাত্রায় সাফল্য পেতে হলে মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে হবে সমাজের প্রতিটি স্তরে। দূর করতে হবে শ্রেণি বৈষম্য। পথশিশুদের গড়ে তুলতে হবে আগামীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের দক্ষ সৈনিক হিসেবে। বর্ণিল সুন্দর আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণে পথশিশুদের বাদ দিয়ে নয় বরং সঙ্গী করেই এগিয়ে যাবো সমান তালে, এটাই হোক আমাদের লক্ষ্য।