জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ায় উষ্ণতার পরিমাণ বাড়ছে। গলছে হিমবাহ ও মেরু অঞ্চলের বরফের স্তর। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ফলে সমুদ্রতীরবর্তী অনেক দেশের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশও জলবায়ু পরিবর্তনের অশুভ পরিণতির অন্যতম শিকার।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকায় আগামী ১০০ বছরের মধ্যে ছোট-বড় সব মিলিয়ে বিশ্বের ২৯৩টি শহর পুরোপুরি পানির নিচে ডুবে যাবে। তালিকায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রামের নামও রয়েছে। নিউইয়র্ক, লন্ডন, টোকিও, কলম্বো, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, হংকং, সাংহাইসহ বেশ কয়েকটি মেগাসিটির নামও রয়েছে অনিবার্য ধ্বংসের তালিকায়।
নাসার অন্যতম বিজ্ঞানী সুরেন্দ্র অধিকারী বলেছেন, বিশ্বের আরো ২৯২টি শহরের সঙ্গে চট্টগ্রামও হারিয়ে যাবে জলের অতলে, ১০০ বছর পর। সমুদ্রের পানির স্তর যেভাবে বাড়ছে, তাতে চট্টগ্রামকে বাঁচানো হয়তো সম্ভব হবে না। নাসার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি ১০ বছর অন্তর ১ দশমিক ৪ সেন্টিমিটার পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম নগরী। এই হারে পানি বাড়তে থাকলে আগামী ১০০ বছরের মধ্যেই চট্টগ্রাম ১৪ দশমিক ১ সেন্টিমিটার পানির নিচে চলে যাবে। সে সময় আর এই মহানগরীর কোথাও শুকনো মাটির অস্তিত্বই থাকবে না।
নাসার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে জাপানের রাজধানী টোকিও। ভারতীয় উপমহাদেশ ও সংলগ্ন এলাকাগুলোকে সবচেয়ে বিপদাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে নাসার প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের পানি আর ১ মিটার বৃদ্ধি পেলেই উপমহাদেশের অন্তত ১৪ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা তলিয়ে যাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বা জলবায়ু পরিবর্তন মানব জাতিকে এক ভয়ঙ্কর হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্বের যেসব দেশ এই হুমকির সম্মুখীন তার সামনের সারিতে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় এর কুফল ইতোমধ্যে অনুভূত হচ্ছে। সমুদ্রের লোনা পানির আগ্রাসনে সাতক্ষীরার হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতার পেছনেও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। অস্তিত্বের স্বার্থেই এ বিপদ থেকে সতর্ক থাকতে হবে। নিতে হবে নিজেদের সুরক্ষার প্রস্তুতি।
বাংলাদেশ চির ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ দেশ হিসেব পরিচিত। দেশের মানুষ বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়েছে। আইলা, সিডর, নার্গিস ইত্যাদি সাইক্লোনে উপকূল অঞ্চল লন্ডভন্ড হয়েছে। লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ও সম্পদহানি হয়েছে। এর ওপর আবহাওয়ার বিরূপ পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহাওয়ার এই পরিবর্তন শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই হচ্ছে না, বৈশ্বিকভাবেই হচ্ছে। এর জন্য উন্নত বিশ্বের শিল্পায়ন এবং অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণকে দায়ী করা হচ্ছে। বিশ্বে জলবায়ুর এ পরিবর্তন ঠেকাতে জোট গঠিত হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র এ জোট থেকে বের হয়ে গেছে। জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে একটি বৈশ্বিক ফান্ড আগেই গঠন করা হয়েছে। এ ফান্ড থেকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশসহ বিভিন্ন দেশকে সহায়তা দেওয়া হয়। বাংলাদেশও এ সহযোগিতা পাচ্ছে। তবে এ অর্থ কোথায় কীভাবে ব্যয় করা হচ্ছে, তার স্পষ্ট কোনো চিত্র নেই। ফান্ডের অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার না করার অভিযোগও রয়েছে। উপকূলে নামকাওয়াস্তে কিছু বনায়ন করে অর্থের ব্যবহার দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তন ঠেকাতে যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার, তা নেওয়া হচ্ছে না। এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের প্রধান খাত কৃষিতে ইতোমধ্যে পড়া শুরু করেছে। খরা, অতি বৃষ্টিপাত এবং বন্যা ভয়াবহ রূপ লাভ করছে। ধান ও গমে প্রতিবছরই ব্লাস্ট রোগ বিস্তার লাভ করছে। এতে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
পরিসংখ্যান বলছে, বছরে এক শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, কৃষিজমিতে বাড়ি-ঘর ও অবকাঠামো নির্মাণের ফলে আশঙ্কাজনক হারে জমি হ্রাস পাচ্ছে। কিছুদিন আগে পাহাড়ি ঢলে পুরো হাওর অঞ্চলের ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। পাহাড় ধসে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়। আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে দেশে বজ্রপাতের হার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত কয়েক দশকের মধ্যে এ বছর সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত এবং মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আবহাওয়ার বিরূপ পরিবর্তন এবং নির্বিচারে পরিবেশ ধ্বংসের কারণে এ ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং দেশের নদ-নদীতে নাব্য কমে যাওয়ায় একদিকে নোনাপানি যেমন উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিজমিতে প্রবেশ করছে, তেমনি সাগরে অবস্থিত ছোট ছোট দ্বীপগুলোতে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। আবহাওয়ার এই বৈরী আচরণ মোকাবিলায় কার্যকর কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে দেশে টাইফুন ও সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের হার আরো বাড়বে বলে এডিবির প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এডিবির প্রতিবেদন ছাড়াও স্বাভাবিক দৃষ্টিতে বাংলাদেশের আবহাওয়ার নেতিবাচক পরিবর্তনটি দেখা যায়। বাংলাদেশের ষড়ঋতুর বৈশিষ্ট্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি ঋতু অনুভব করা যায় না। এর ওপর রয়েছে ন্যায্য পানিপ্রাপ্তি নিয়ে ভারতের বিরূপ আচরণ। প্রতিবেশী দেশটির কারণে শুষ্ক মৌসুমে উত্তরাঞ্চল মরুরূপ নিচ্ছে। অন্যদিকে বর্ষায় উজানে দেওয়া সব বাঁধ খুলে দেওয়ায় বন্যায় ভেসে যাচ্ছে গোটা দেশ। এবার যে বন্যা দেখা দিয়েছে তা এই বাঁধ খুলে দেওয়ার কারণেই হচ্ছে। পানি নিয়ে প্রতিবেশীর এই অমানবিক আচরণ এবং দেশের অভ্যন্তরে নির্বিচারে পরিবেশ ধ্বংসের কারণে আবহাওয়ার নেতিবাচক পরিবর্তন দ্রুত হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র উপায় সচেতন হওয়া।
সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পেতে উপকূলজুড়ে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা অপরিহার্য। সমুদ্রে জেগে ওঠা দ্বীপগুলোর ভাঙন ঠেকাতে বাঁধ নির্মাণ ও ব্যাপক হারে বনায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। কৃষি ও কৃষিজমি রক্ষার্থে পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অনাবাদি ভূমি ব্যবহার উপযোগী করার কথা ভাবতে হবে। জলবায়ুর যে তহবিল রয়েছে তার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষার কর্মসূচি নিতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে পাহাড় কাটা ও বসতি স্থাপন ঠেকাতে কঠোর আইন এবং আইনের প্রয়োগ কার্যকর হতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করে তা প্রচারের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াটাই হবে সময়োপযোগী একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপক পরিকল্পনা এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তার বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।