২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা হয়। ভয়াবহ ওই হামলায় ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। হামলার কিছুদিন পরই ১২ সেপ্টেম্বর শুরু হয় অষ্টম জাতীয় সংসদের ১৩তম অধিবেশন।
হামলায় নিহতরাসহ অধিবেশন শুরুর আগ পর্যন্ত মোট ২৪ জন নিহত হয়। কিন্তু সংসদের ১৩তম অধিবেশনে কেবল উল্লেখ করা হয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আইভি রহমানের নাম। নারকীয় ওই হামলায় নিহতদের আর কারও নাম উল্লেখ না করেই ওই ঘটনায় শোক জানানো হয়।
তবে এ ধরনের ঘটনায় নিহতদের নাম উল্লেখ করার রেওয়াজ আছে বলে ওই অধিবেশনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিরোধী দলের সদস্যরা। একইসঙ্গে সংসদে নিহতদের নাম গ্রহণের দাবি জানানো হয়।
জাতীয় সংসদের কার্যনির্বাহের রিপোর্ট থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংসদের ওই অধিবেশনে প্রথম বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন স্পিকার ব্যারিস্টার মুহম্মদ জমির উদ্দিন সরকার। কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী তিনি শোক প্রস্তাব আনেন। জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘মাননীয় সদস্যবৃন্দ, আমি গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, বিগত কিছুদিনে আমরা অষ্টম জাতীয় সংসদের একজন সদস্যসহ কয়েকজন গণপরিষদ সদস্য, সাবেক সংসদ-সদস্য ও বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হারিয়েছি। এঁরা হলেন ১. অষ্টম জাতীয় সংসদের সদস্য, প্রিয় সহকর্মী আবদুল মমিন, ২. সাবেক গণপরিষদ সদস্য কাজী আকবর উদ্দিন সিদ্দিক, ৩. সাবেক সংসদ-সদস্য প্রফেসর আলহাজ্ব ডা. মাজহার আলী কাদেরী, ৪. সাবেক সংসদ-সদস্য আলহাজ্ব মোহাম্মদ গোলাম হোসেন, ৫. সাবেক সংসদ-সদস্য অ্যাভোকেড শামছুল হক, ৬. সাবেক সংসদ-সদস্য এ, কে, এম আবু জাহেদ, ৭. বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আইভি রহমান, ৮. জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের উপসচিব মো. বজলুর রহমান এবং ৯. জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ডি. আর. মো. সামছু উদ্দিন।’
ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নাসিম (সিরাজগঞ্জ-১) স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরে স্পিকার তাকে ফ্লোর দিলে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আজকে অত্যন্ত বেদনা এবং দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি। আপনি যে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন তাতে ২১ আগস্ট, বাংলার সাবেক প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য, আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যা করার জন্য প্রকাশ্য দিবালোকে যে হামলা চালানো হয়েছে এর জন্য সমগ্র জাতি নিন্দা জানিয়েছে। এ হত্যা প্রচেষ্টার সময় আইভি রহমান শুধু নয়, একজন নারী নেত্রী, একজন মহিয়সী নেত্রীকে শুধু হত্যা করা হয়নি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, যুবলীগের নেতাকর্মী, এমনকি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে গিয়ে একজন নিরাপত্তা রক্ষী পর্যন্ত নিহত হয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ ...আজকে আইভি রহমান ছাড়াও মোস্তফা মনসুর, মামুনুর রশিদ, রফিকুল ইসলাম, সুফিয়া বেগম, হাসিনা মমতাজ রীনা, লিটন বসু ওরফে লিটু, রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ, মামুন মৃধা, বেল্লাল হোসেন, মোয়াজ্জেম হোসেন, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, আতিক সরকার, নাসির উদ্দিন সরদার, রিজিয়া বেগম, আবুল কাসেম, আমিনুর রহমান, আবুল কালাম আজাদসহ ২২ জন নিহত হয়েছে। যুবলীগের একজন কর্মী মাত্র পরশু মৃত্যুবরণ করেছে।’
‘এটা সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা এবং যে পার্লামেন্টে একদিন আমরা বলেছিলাম জননেত্রী শেখ হাসিনার জীবন হুমকির সম্মুখীন। সেদিন প্রধানমন্ত্রী (খালেদা জিয়া) আমাদের সঙ্গে তামাশা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বিদেশে কেন, দেশেই তো শেখ হাসিনাকে হুমকি দেয়া যেতে পারে। আজকে সেই বঙ্গবন্ধুর খুনিরা এই সরকারের ব্যর্থতার কারণে ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে দেশে হত্যা করার জন্য হামলা চালিয়েছিল। শুধু হামলা চালায়নি, শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দসহ আজকে ২২ জন লোককে হত্যা করা হয়েছে। আজকে সরকারের ব্যর্থতার কারণে যে ২২ জন লোকের জীবন গেছে আমি আপনাকে অনুরোধ করব, এ ২২ জন লোকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হোক।’ -বলেন মোহাম্মদ নাসিম। এ সময় সরকারি দলের (বিএনপির এমপিরা) সদস্যরা হৈ চৈ করে তাকে বাধা দেন। এরপর স্পিকার বলেন, ‘......মিস্টার নাসিম, আপনি বক্তৃতা করবেন, আমিতো আপনাকে বক্তৃতার সুযোগ দিলাম। এখানে কী লেখা আছে, বিগত ২১ আগস্ট ২০০৪ তারিখে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা হামলায় নিহতদের জন্য এই মহান সংসদ গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ, তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যবর্গদের জন্য আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছে। সবার কথাই বলা আছে।’
কিন্তু তবুও থামছিলেন না আওয়ামী লীগের এমপিরা। তাদের অনেকেই কথা বলতে চাচ্ছিলেন। এই পর্যায়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা খালেদা জিয়া হস্তক্ষেপ করেন। তিনি বলেন, ‘মাননীয় স্পিকার, আমি আপনাকে অনুরোধ করছি যে, এখানে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আপনি প্রথমে মোনাজাত করার জন্য বলবেন।’ এরপর হামলায় নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়।
ওই অধিবেশন চলে মাত্র চারদিন। ওই হামলা নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি ৬২ অনুযায়ী আলোচনার দাবি জানানো হয়। কিন্তু স্পিকার তা প্রত্যাখ্যান করে সাধারণ আলোচনা দেন। এটি হয় ১৫ সেপ্টেম্বর। কিন্তু ৬২ বিধিতে আলোচনার সুযোগ না পেয়ে আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে ওয়াক আউট করে। আর বিএনপির এমপিসহ অন্য দলের এমপিরা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা নিয়ে আলোচনা করেন। ওই দিন স্পিকার বলেন, ‘মাননীয় সদস্যবৃন্দ, বিগত ১২-৯-২০০৪ তারিখে অনুষ্ঠিত কার্য-উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে ২১ আগস্ট, ২০০৪ তারিখে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে গ্রেনেড হামলা এবং দেশের সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির উপর আলোচনা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং আলোচনার দিন, সময় ও পদ্ধতি নির্ধারণের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়। এ বিষয়ে সংসদে আলোচনা করতে সরকার ও বিরোধী দল উপদেষ্টা কমিটিতে একমত পোষণ করেছেন।’
এ পর্যায়ে তৎকালীন প্রধান বিরোধীদল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা সংসদ কক্ষ ত্যাগ (ওয়াক আউট) করেন।
ওইদিন অনেকের বক্তব্যের শেষে লুৎফুজ্জামান বাবর (স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার বক্তব্যের শুরুতেই স্মরণ করছি, গত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত শ্রদ্ধেয় বিদুষী নেত্রী আইভি রহমানকে। আমি একই সঙ্গে তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং তাঁর শোকাহত পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি এবং যারা আহত হয়েছে তাদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে সেদিন যেসব পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে আমি তাদের প্রতিও সমবেদনা জানাচ্ছি।’
এরপর তিনি হামলার পরে সরকার গৃহীত পদক্ষেপের বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি অভিযোগ করেন, ‘...এই বোমা হামলায় মোট ১৯ জন মারা যায়। ...আওয়ামী লীগের নির্ধারিত সমাবেশটি মুক্তাঙ্গনে হওয়ার অনুমতি নেয়া হলেও তা শেষ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে স্থানান্তর করা হয়েছিল।...... এই ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং যেকোনো মূল্যে দুষ্কৃতকারীদের গ্রেফতারের সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।’
‘মাননীয় স্পিকার, আমাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ করা হয়েছে, আলামত নষ্ট করে ফেলার। বলা হয়েছে, বিরোধীদলীয় নেত্রী যে ট্রাকটির উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেছিলেন এবং আলামত হিসাবে যেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেই ট্রাকটি নাকি মালিককে ফেরত দেয়া হয়েছে। এই অভিযোগটি পুরোপুরি অসত্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ট্রাকটি কখনো মালিককে ফেরত দেয়া হয়নি। সেটি এখনো মেট্রোপলিটন পুলিশ কন্ট্রোল রুমে সংরক্ষিত আছে। ট্রাকটির সব আলামত, এমনকি ব্যানার লাগানোর খুঁটিগুলোও অবিকল রাখা হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার দীর্ঘ বক্তব্যে আওয়ামী লীগ ওই ঘটনার তদন্তে অসহযোগিতা করছে বলেও দাবি করেন।
|