সৌদি আরব ও ইরান মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধা হিসেবে পরস্পর ‘ব্লেইম গেম’ খেলছে। কথা হলো আসলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধা কোথায়? মধ্যপ্রাচ্যে চলছে ভূ-রাজনীতিতে মোড়ল হওয়া আর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই। সম্প্রতি যুবরাজ এমবিসি সৌদি রাজপরিবারের প্রিন্সদের ঘাড়ে দুর্নীতির তকমা লাগিয়ে যে গণগ্রেফতার চালিয়েছে-যা এখনো চলমান, তার একমাত্র কারণ যুবরাজের সিংহাসন নিশ্চিত ও ক্ষমতাকে দৃঢ় করার প্রয়াস। সৌদি আরবের ২০১১ সালে সিরিয়াতে, ২০১৫ সালে ইয়েমেনে যুদ্ধে জড়ানোর কারণ হিসেবে যতটা শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য; তার চাইতে বড় কথা হলো ইরানের প্রভাব ঠেকানো। ২০১১ সালে শিয়া শাসক বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেখানে সুন্নি মতাদর্শের সরকার প্রতিষ্ঠার আশায় সৌদি আরব সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। ফলে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার মনোভাব কতটা তা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে।
রাশিয়ার সোচিতে গত ২২ নভেম্বর পুতিন, রুহানি ও এরদোগানের সম্মিলিত প্রয়াসে সিরিয়াতে বিরোধী ও সরকার দলকে নিয়ে ‘সিরিয়ান পিপলস কংগ্রেস’ সরকার গঠনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা থেকেই প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট। কারণ সিরিয়াতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পশ্চিমা মিত্রদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব যে যুদ্ধ শুরু করেছিল তাতে রক্তের হোলিখেলা ছাড়া কোন শান্তি প্রতিষ্ঠার আলামত মেলেনি। সিরিয়া যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি ব্যর্থ। তারা রক্ত ঝরানো ছাড়া কোনো সমাধান দিতে পারেনি। এখানে ওয়াশিংটন-রিয়াদ কৌশলগতভাবে পরাজিত হয়েছে। প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বাশারমিত্র তেহরান ও মস্কোই নিয়েছে আর তাতে বাশারবিরোধী হয়েও তুরস্ক নিজেকে শামিল করেছে। ২৮ নভেম্বর জেনেভায় জাতিসংঘ সিরিয়াকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
সৌদি আরব কেন সিরিয়া ও ইয়েমেনে সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরাল? লেবানন নিয়ে কেন এত ‘ড্রামা’ চলছে? এর পেছনে মূল কারণ ইরানের সমর্থিত হিজবুল্লাহভীতি। কারণ সৌদিতে চলছে রাজতন্ত্রের শাসন আর হিজবুল্লাহ রাজতন্ত্রের বিরোধী, যা রিয়াদের বড় মাথাব্যথার কারণ। অন্যদিকে রিয়াদমিত্র তেলআবিবের গলার কাঁটা হলো হামাস ও হিজবুল্লাহ, যার জন্য গাজা উপত্যকা গিলতে পারছে না। ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম সংগঠন হামাসের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে শিয়া হিজবুল্লার। হামাস ও হিজবুল্লাহ উভয়েই আবার মিসরের ইসলামী আন্দোলনকারী দল ব্রাদারহুডের সমর্থক। মুসলিম ব্রাদারহুডের আরেক সমর্থনকারী দল তুরস্কের এরদোগান সরকারের একে পার্টি। যারা এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে। আবার সব ক’টি দল একই সঙ্গে রাজতন্ত্রবিরোধী এবং ইসরায়েলবিরোধী।
তাই একদিকে ইসরায়েল ভয়ে আছে তার ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নিয়ে আর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) আছে তার আগামী দিনের রাজতন্ত্রী সিংহাসন নিয়ে। আরব দেশগুলোর নেতৃত্ব দানকারী সৌদি আরব ইসরায়েলের মদদে মধ্যপ্রাচ্যে প্রত্যক্ষভাবে ইরানকে ঠেকাতে চাচ্ছে আর পরোক্ষ ভয়ে আছে তুরস্কের অভ্যুত্থান নিয়ে। কারণ তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র। ন্যাটোর ৫নং ধারা অনুযায়ী কোনো সদস্য রাষ্ট্র আক্রান্ত হলে অন্য রাষ্ট্র তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। তাই সৌদি আরব সরাসরি তুরস্ককে দমনের কথা বলতে পারছে না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অন্য রাষ্ট্রগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেষ্টার ত্রুটি করছে না।
গত ৫ জুন কাতারের ওপর অবরোধের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। কিন্তু সৌদি আরব এখানেও ইরান-তুরস্কের জন্য ব্যর্থ হয়েছে। অবরোধের প্রাথমিক দিকে মনে হচ্ছিল কাতারকে হয়তো ইয়েমেনের মতো ভাগ্য বরণ করতে হবে। কিন্তু তুরস্ক তার কাতার সেনাঘাঁটিতে আরো বাড়তি সেনা মোতায়েন করে আর ইরানের সঙ্গে মিলে খাদ্য সহায়তা দেয়, যার ফলে সৌদি অবরোধে কাতারের ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। সৌদি জোট যে অজুহাত ইরানকে নিয়ে পেশ করছে তার কোনো বাস্তবতা নেই। ইরান বিরোধিতার বড় কারণ আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চল থেকে ইরাক, সিরিয়া ও লেবাননে ইরানের সফল প্রভাব বিস্তার। ইরান শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে সৌদিকে টপকে শীর্ষে অবস্থান করছে। তাই ইরানের প্রভাব বাড়তে থাকলে এক সময় সে প্রভাবে রাজতন্ত্রের সিংহাসন হয়তো থাকবে না, এ প্রভাব রাজতন্ত্রী অন্য আরব দেশগুলোর ওপর যে পড়বে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই সৌদি আরব ইরানকে ঠেকাতে আরব জোটভুক্ত দেশগুলো নিয়ে কাজ করছে।
এখানে সৌদি আরব যতটা নিজের জন্য দৌড়াচ্ছে তার চাইতে বেশি মিত্র ইসরায়েলের জন্য গলদঘর্ম করছে। ২০১৫ সালে ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে ইরানের স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তি পি৫+১ এর ঘোর বিরোধী ছিল নেতানিয়াহু প্রশাসন। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই এ চুক্তির বিরোধিতা করেছেন। ক্ষমতায় এসে চুক্তি বাতিলের কথাও বলেছেন। অন্য রাষ্ট্রগুলো এ বিষয়ে আপত্তি তুলেছে, তারা চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে। এই নিয়ে ওয়াশিংটন অনেকটাই একঘরে হয়ে পড়েছে। তার মানে এই চুক্তি বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বাড়বে, বেকায়দায় পড়বে ইসরায়েল-সৌদি আরব। তাই সৌদি আরব ইরানের ওপর সন্ত্রাসবাদের মদদের গুজব এনে ইরানকে নানা কৌশলে দমন করতে চাচ্ছে। আর এই দমনে ইসরায়েল খুব সুন্দরভাবে ব্যবহার করছে সৌদি আরব ও অন্য আরব দেশগুলোকে। দমনের পাঁয়তারা হিসেবেই লেবানেন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির পদত্যাগ নাটক। রফিকপুত্র সাদ সৌদি নাগরিক। সে তার জীবনের হুমকির জন্য হিজবুল্লাহ ও ইরানকে দায়ী করছে। জীবন বাঁচাতে সাদ পদত্যাগ করে সৌদি আরবে ভ্রমণে গিয়ে। কিন্তু হিজবুল্লাহ নেতা নাসরুল্লাহ এই পদত্যাগকে নাটক বলে আখ্যায়িত করে। লেবানিজরাও তাদের প্রধানমন্ত্রীকে ফেরত চেয়ে রাস্তায় নামে। দেশে ফিরে সাদ রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দিলেও রাষ্ট্রপতি তাকে আপাতত পদত্যাগ না করার কথা বললে হারিরি তা মেনে নেয়। ঘটনাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নাসরুল্লাহ প্রদত্ত নাটকতত্ত্ব সত্য বলেই মনে হচ্ছে।
তাহলে লেবাননে হিজবুল্লার প্রভাব মুক্ত করতেই এই নাটক সাজানো হয়েছিল? আর বলির পাঁঠা করা হতো সাধারণ লেবানিজদের? যেমনটা ইয়েমেনে সুন্নি সরকার হাদিকে বহাল রাখতে গিয়ে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ বাধিয়েছে এমবিএস। যাতে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ১০ হাজার মানুষ, লাখ লাখ মানুষ হয়েছে বাস্তুচ্যুত, ৭০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষে পতিত হয়েছে, ১ হাজার ৭৪০ জন কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ২০ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। কিন্তু পরিস্থিতি দেখ মনে হচ্ছে, যুবরাজ এমবিএস লেবাননে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারবে না।
এত রক্তপাতের পরও রিয়াদ জয়ী হতে পারছে না। এদিকে হাইছিরা ক্রমে ক্রমে সম্পূর্ণ ইয়েমেনের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। সব দিক থেকে পরাজয় আর প্রভাব খর্ব হতে দেখে ক্ষেপাটে যুবরাজ কখন যে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। হারিরি পদত্যাগের আগে হাইছিরা সৌদির বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে বলে অভিযোগ করেছে রিয়াদ। আর এই ক্ষেপণাস্ত্রের জোগানদাতা হিসেবে ইরানকে দায়ী করা হয়েছে। এ রকমভাবে উত্তেজনা চলতে থাকলে যেকোনো সময় হামলা বা যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। ইরান-সৌদি আরব যুদ্ধ শুরু হলে ইরান মস্কো-আঙ্কারা ছাড়া আর কোনো দেশকে পাশে পাবে না।
অন্যদিকে সৌদির পাশে জোরালো অবস্থান নেবে তেলআবিব ও ওয়াশিংটন, যা মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধাকাশে নতুন ধোঁয়াটে পরিবেশ সৃষ্টি করবে। ইরান-সৌদি যুদ্ধের পুরো ফায়দা লুটবে ইসরায়েল। দীর্ঘদিনের শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব প্রমশিত হবে না, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব চরমে উঠবে। সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, বাহরাইনসহ শিয়া অধ্যুষিত দেশগুলোতে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত মুসলিম দেশগুলোতে নিভন্তপ্রায় অগ্নিগর্ভে নতুন করে ঘি ঢেলে আগুন ধরানো হবে।