বন্যা বা যেই কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানির ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নহে। কিন্তু দিনাজপুরে বন্যার পানিতে ভাসিয়া গিয়া চারটি শিশুর মৃত্যুর ঘটনাটি দেশের মানুষকে গভীরভাবে আলোড়িত করিয়াছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ইহা লইয়া নিন্দার ঝড় উঠিয়াছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন হইতে জানা যায়, কাহারোল উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের ঈশ্বরগ্রামের এক মা বন্যার পানি হইতে মুক্তি পাইতে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় উপস্থিত হন। প্রতিষ্ঠানটিতে সাময়িকভাবে আশ্রয় গ্রহণের নিমিত্ত তিনি নৈশ প্রহরীকে কক্ষ খুলিয়া দিবার জন্য বারবার অনুরোধ করেন। নৈশ প্রহরী প্রতিষ্ঠানটির সুপারের নিকট ফোনে কক্ষ খুলিয়া দিবার অনুমতি চান। কিন্তু সুপার অনুমতি প্রদান করেন নাই। অবশেষে নিরুপায় হইয়া মা তাহার চার শিশু সন্তানকে লইয়া বাড়ি ফিরিবার সময় তীব্র স্রোত তাহাদের ভাসাইয়া নিয়া যায়। এলাকাবাসীর সহায়তায় মা রক্ষা পাইলেও মর্মান্তিকভাবে মৃত্যু হইয়াছে চারটি শিশুরই!
বাংলাদেশ নামক এই বদ্বীপটি গঠিত হইয়াছে বন্যাসৃষ্ট পলিমাটি দ্বারা। তাহা ছাড়া ভাটির দেশ হিসাবে দেশটির উপর দিয়া মৌসুমি বৃষ্টিজনিত উজানের পানিও প্রায়শই প্রবাহিত হইয়া থাকে। বর্তমানে দেশে ও উজানের বিভিন্ন দেশে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে আমাদের দেশের বন্যা পরিস্থিতিরও মারাত্মক অবনতি ঘটিয়াছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরসূত্রে জানা যায়, দেশের মোট ২২টি জেলা এখন বন্যার কবলে আক্রান্ত এবং ইহাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৩৩ লক্ষ ২৭ হাজার। তবে সমুদ্রস্তর হইতে দেশের সবচাইতে উঁচু স্থান হিসাবে পরিচিত দিনাজপুরেই এই বন্যার প্রাদুর্ভাব বেশি ঘটিয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে। নানা কারণে যদিও বন্যা আমাদের অস্তিত্বের সহিত মিশিয়া গিয়াছে বলা যায়, তথাপি বন্যা যদি অতীতের যেই কোনো সময়ের তুলনায় ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে, তবে তাহা যে এতদাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগকে চরম পর্যায়ে লইয়া যায়— ইহা সহজেই অনুমেয়। তাহা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিকভাবেই অতিবৃষ্টি এবং ভারীবৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়িয়া গিয়াছে। আমাদের দেশসহ উজানের বিভিন্ন দেশ ভারত, নেপাল ও চীনে সমপ্রতি এই ধরনের ভারী বৃষ্টিপাতের প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা গিয়াছে। সুতরাং আমরা নানানভাবেই বন্যা ঝুঁকি কবলিত একটি দেশ। তাই উঁচু বা নিচু এলাকা কিংবা বন্যাকবলিত বা পাহাড়ি অঞ্চল এইসব বিবেচনা না করিয়া দেশের সর্বত্র চাহিদানুযায়ী আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি। ইহাতে শুধু বন্যা নহে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত যেই কোনো দুর্যোগের ঝুঁকিই অনেকাংশে লাঘব হইবে নিঃসন্দেহে। অন্যদিকে দিনাজপুরের নিষ্ঠুর ঘটনাটিরও সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া আবশ্যক। আমরা জানি, দুর্যোগ চলাকালে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি সাময়িক আশ্রয় কেন্দ্র হিসাবে বিবেচিত হয়। আশ্রয় কেন্দ্র না হইলেও কেহ দুর্গত মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলিয়া দিতে পারেন না, বরং তাহাকে রক্ষা করাই কর্তব্য বলিয়া বিবেচিত হয়।