আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিক থেকে দেখলে দেখা যাবে, কীভাবে রাজনীতি বদলে যাচ্ছে। এমনকি সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায় মানুষ এখন রাজনীতি সচেতন। গত এক বছরের মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনীতির হাওয়া বদল হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। ইউরোপের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, জার্মানির সাধারণ নির্বাচনের পর আরো দুটি প্রাদেশিক নির্বাচন হয়ে গেল। সেখানেও উগ্র ডানপন্থিরা ভালো করেছে। অস্ট্রিয়াতেও সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেছে। সেখানেও উগ্র ডানপন্থিরা ক্ষমতায় এসেছে। তাহলে ইউরোপ কি একটি উগ্র ডানপন্থি উত্থান প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে আগামী দশকে? ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশেই এখন উগ্র ডানপন্থিরা তাদের অবস্থান শক্তিশালী করছে। এই উগ্র ডানপন্থিরা দুটি কাজ করতে পারে।
এক. তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, যেমনটি গেছে ব্রিটেন। দুই. আরেক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের জন্ম দিতে পারে, যেমনটি দিয়েছে স্পেনের কাতালোনিয়া। এক সময় যে ইউরোপ স্থিতিশীলতা ও ঐক্যের প্রতীক ছিল, সেখানে আসতে পারে অনিশ্চয়তা। ভেঙে যেতে পারে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ধারণা।
সাম্প্রতিক স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল কাতালোনিয়া নিয়ে যে সংকটের শুরু, তার এখনো কোনো সমাধান হয়নি। সংকটের গভীরতা বাড়ছে। গত ১ অক্টোবর সেখানে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় পড়েছিল। কাতালোনিয়ার ৯০ শতাংশ নাগরিক স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় কাতালোনিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা পুইজমন্ট বলেছিলেন, তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। কিন্তু স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার এর সমালোচনা করেছিল। কাতালোনিয়ার গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় পড়ায় চরম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে অনেক দেশ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। তাছাড়া স্পেন সরকার এর সমালোচনা করেছে এবং স্পেনের একটি সাংবিধানিক আদালত বলেছেন, ১৯৭৮ সালের সংবিধানের ডিক্রি অনুসারে দেশকে বিভক্ত করা যাবে না; শুধু জাতীয় সরকারই গণভোটের আয়োজন করতে পারে। কিন্তু কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতারা স্বাধীনতার প্রশ্নে অনড়। এক্ষেত্রে কাতালোনিয়া যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তাহলে স্পেন সরকার সংবিধানের ১৫৫ ধারা প্রয়োগ করতে পারে। কাতালোনিয়ার জন্য যে স্বায়ত্তশাসন রয়েছে, স্পেনের পার্লামেন্ট তা বাতিল করতে পারে। পার্লামেন্ট একটি রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যেতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতাকামীরা তা মানবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
বলা ভালো, কাতালোনিয়ার জনসংখ্যা মাত্র ৭৫ লাখ ২২ হাজার। স্পেনের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ মানুষ কাতালোনিয়ায় বাস করে। এ প্রদেশটির রাজধানী বার্সেলোনা। বার্সেলোনার ফুটবল টিম জগদ্বিখ্যাত। স্পেনের জাতীয় আয়ের শতকরা ২০ ভাগ আসে ওই প্রদেশে থেকে। ইউরো জোনের চতুর্থ বড় অর্থনৈতিক শক্তি হচ্ছে স্পেন। এখন কাতালোনিয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন যদি শক্তিশালী হয়, যদি সত্যি সত্যিই কাতালোনিয়া ইউরোপে নতুন একটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তাহলে তা ইউরোপের অন্যত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আরো উৎসাহ জোগাবে। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে! বদলে যাচ্ছে ইউরোপের রাজনীতি। উগ্র ডানপন্থি উত্থান ঘটেছে ইউরোপে, যারা নতুন করে ইউরোপের ইতিহাস লিখতে চায়। ফ্রান্সে উগ্র ডানপন্থি উত্থানের পাশাপাশি এখন জার্মানিতে উগ্র ডানপন্থি তথা নব্য নাজির উত্থান ইউরোপের রাজনীতি বদলে দিতে পারে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন যোগ হলো কাতালোনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন।
গত এক বছরের রাজনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ফ্রান্স ও জার্মানির অবস্থান কোনদিকে মোড় নিয়েছে। টিভিতে এটা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এ রকম বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন যদি সফল হয়, তাহলে ইউরোপের সর্বত্র এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে। এতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্ম হবে, যা ইউরোপের ঐক্যকে দুর্বল করবে। এমনিতেই এখন একটি উগ্র দক্ষিণপন্থি রাজনীতির স্রোত ইউরোপের সর্বত্র বইছে। ব্যাপক অভিবাসী আগমনকে কেন্দ্র করে এ উগ্র দক্ষিণপন্থি রাজনীতির প্রভাব বাড়ছে। ফ্রান্সে উগ্র দক্ষিণপন্থি দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রভাব বাড়ছে। প্রভাব বাড়ছে জার্মানিতে। সেখানে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে গেছে উগ্র দক্ষিণপন্থি দল অলটারনেট ফর জার্মানি পার্টি। আস্ট্রিয়ার নির্বাচনে গেল সপ্তাহে ভোটাররা উগ্র দক্ষিণপন্থিদের বিজয়ী করেছে। এর বাইরে হল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক রিপাবলিক, স্লোভাকিয়াসহ প্রায় প্রতিটি দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থিদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ছে। কোথাও কোথাও এরা ক্ষমতায়, কোথাও দ্বিতীয় অবস্থানে।
এ যখন পরিস্থিতি, তখন কাতালোনিয়ার গণভোট পুরো দৃশ্যপটকে বদলে দিল। এ মুহূর্তে এটা স্পষ্ট নয়, কাতালোনিয়ার সংকটের সমাধান হবে কীভাবে? একটা সমাধান না হলে তা ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে। সমাধানটা হতে হবে স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার আর কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে। ইইউর প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ইইউ এ ব্যাপারে কোনো মধ্যস্থতা করবে না। তাই সারা ইউরোপের দৃষ্টি এখন কাতালোনিয়ার দিকে। এখানে বলা ভালো, ইউরোপে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের খবর নতুন নয়। অনেক ইউরোপীয় দেশে এ ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদীর খবর আমরা জানি। জার্মানির কথা যদি বলি, তাহলে বেভেরিয়া রাজ্যের কথা বলতেই হয়।
উল্লেখ্য, বেভেরিয়া জার্মানির অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কিছুটা আলাদা। অর্থনৈতিকভাবে অনেক সমৃদ্ধ এ রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা আছে। এখানকার মূল দল সিএসইউ হচ্ছে ক্ষমতাসীন সিডিইউর স্থানীয় সংগঠন। সিডিইউ এখানে আলাদাভাবে কোনো প্রার্থী দেয় না। সিডিইউর হয়ে কাজ করে সিএসইউ। সম্প্রতি দলটি চ্যান্সেলর মারকেলকে বাধ্য করেছে অভিবাসীদের কোটা সীমিত করে দিতে। জার্মান রাজনীতিতে বেভেরিয়ার ভূমিকা অনেকটা যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে স্কটল্যান্ডের ভূমিকার মতো। ২০১৪ সালে স্কটল্যান্ডে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকা না-থাকা নিয়ে একটি গণভোট হয়েছিল। তাতে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকার পক্ষেই রায় পড়েছিল। এখন স্কটিকা ন্যাশনাল পার্টির প্রধান নিকোলা স্টুরজিওন চাচ্ছেন আরেকটি গণভোট, যাতে স্কটল্যান্ডের মানুষ আরেকবার ভোট দিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে- তারা স্বাধীন হবে, নাকি ব্রিটেনের সঙ্গেই থেকে যাবে। এটা স্পষ্ট, স্কটল্যান্ড ইইউতে ব্রিটেনের জায়গাটি নিতে চায়। আর এ জন্যই দরকার স্বাধীনতা।
বেলজিয়াম মূলত দুই ভাগে জাতিগতভাবে বিভক্ত হয়ে আছে ওয়ালুনস এবং ফ্লেমিশ। ওয়ালুনসরা ফরাসি ভাষাভাষী আর ফ্লেমিশদের নিজস্ব ভাষা আছে। তাদের মাঝে স্বাধীনতার চেতনাও আছে। কাতালোনিয়া যদি স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে ফ্লেমিশ স্বাধীনতা আন্দোলন আরো শক্তিশালী হবে। ডেনমার্ক থেকে ৮০০ মাইল দূরে অবস্থিত ফারোও দ্বীপপুঞ্জেও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আছে। দ্বীপটি ডেনমার্কের অধীনে হলেও অতিসম্প্রতি তারা স্বশাসনের কথা ঘোষণা করেছে। ইতালির দুটি অঞ্চল লমবারডি এবং ভেনেতোতে চলতি মাসের শেষে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে গণভোট হবে। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের মার্চের এক গণভোটে ৮৯ শতাংশ ভেনেতোর মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছিল। সেখানে অনেকটা কাতালোনিয়ার মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
এদিকে স্পেনের অন্তর্ভুক্ত বাস্ক মূলত স্বায়ত্তশাসিত একটি অঞ্চল। এর কিছু অংশ আবার ফ্রান্সের অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীনতাকামী ইটিএ দীর্ঘদিন ধরে বাস্ক অঞ্চলের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করে আসছে। সাম্প্রতিক সময় স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার বাস্ক অঞ্চলের জন্য যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। তারপরও স্বাধীনতাকামীরা সক্রিয়। তারা মাঝেমধ্যেই বোমা হামলা চালিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। অন্যদিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হয়েছে নানা কারণে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ, অনুুন্নয়ন, নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদি কারণে এ বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা শক্তিশালী হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, উগ্র দক্ষিণপন্থি কিছু দল এ বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারাকে উসকে দিয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে, অলটারনেটিভ ফর ডয়েটসল্যান্ড, জবিক বা মুভমেন্ট ফর বেটার হাঙ্গেরি ফ্রন্ট ন্যাশনাল গোল্ডেন ডন, ফ্রাইহাইটলিসে পার্টাই ওস্টারিস, ফিনল্যান্ড, সুইডেন ডেমোক্র্যাটস, ড্যানিশ পিপলস পার্টি (ডেনমার্ক), পার্টাই ভর দি ভ্রিজহেইড (হল্যান্ড), লিগা নর্ড (ইতালি) প্রভৃতি রাজনৈতিক দলের কথা। এসব রাজনৈতিক দল উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি প্রমোট করছে। কোথাও কোথাও তারা সংসদেও আছে।
সিরিয়া ও ইরাকের সংকট লাখ লাখ মানুষকে দেশান্তরিত করেছে। ১০ লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়ে জার্মানির অ্যাঙ্গেলা মারকেল মানবতার যে পরিচয় দিয়েছিলেন, তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। তার ওই সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হলেও রাজনীতির দিক থেকে তিনি একটা ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তিনি রাজনীতির জুয়া খেলেছিলেন। এতে তিনি বিজয়ী হতে পারেননি। এ শরণার্থী সংকট ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শরণার্থীবিরোধী অবস্থান। বলার অপেক্ষা রাখে না, ট্রাম্পের মনোভাব ও নীতির কারণে ইউরোপের উগ্র দক্ষিণপন্থি সংগঠনগুলো উৎসাহিত হয়েছে। প্রশ্নটা সে কারণেই। কেমন ইউরোপ আমরা দেখব আগামী দিনে-তার অপেক্ষায় সারা বিশ্বের মানুষ।
|