ব্রাজিলের পর বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চিনি রপ্তানিকারক দেশ ভারত। আর বাংলাদেশের জন্য পণ্যটি তৃতীয় বৃহত্তম আমদানির উৎস। এখন ভারত নিজ দেশের অভ্যন্তরে দামের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে চিনি রপ্তানি সীমিত করার পরিকল্পনা করছে। যার প্রভাব বাংলাদেশের বাজারেও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের। যদিও সরকার তেমনটি মনে করছে না। মঙ্গলবার (২৫ মে) ভারতের একটি সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, দেশটি চলতি মৌসুমে চিনির রপ্তানি এক কোটি টনে সীমাবদ্ধ করতে পারে। কারণ, সরকারি ভর্তুকি ছাড়া ভারতীয় কারখানাগুলো চলতি ২০২১-২২ বিপণনবর্ষে এ পর্যন্ত ৮৫ লাখ টন চিনি রপ্তানির চুক্তি করে ফেলেছে। এরইমধ্যে প্রায় ৭১ লাখ টন চিনি বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে তারা। সেজন্য নিজেদের বাজার স্থিতিশীল রাখতে এ সিদ্ধান্ত আসছে। যদিও কবে থেকে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে সে বিষয়টি এখনো পরিষ্কার করা হয়নি। তবে আগামী মাসের শুরু থেকেই দেশটি চিনি রপ্তানিতে লাগাম টানতে পারে বলে জানিয়েছে ভারতের ওই সরকারি সূত্র। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতীয় চিনি রপ্তানি সীমিত হলে বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম বেড়ে যেতে পারে। পাশাপাশি বাংলাদেশের মতো অন্যান্য আমদানিকারক দেশগুলো বিকল্প উৎসের ওপর চাহিদা বাড়াবে। তাতে ব্রাজিল, যুক্তরাজ্য ও চীনের মতো রপ্তানিকারক দেশগুলোর বাজারেও সরবরাহের টান পড়তে পারে। যা নিশ্চিতভাবেই দুশ্চিন্তার কারণ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের অন্যতম আমদানিকারক শিল্প গ্রুপের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে ভারত থেকে তুলনামূলক চিনি আমদানি কম হলেও করোনা মহামারির সময় থেকে তা বেড়েছে। কারণ, অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় ভারত থেকে পরিবহন খরচ কম। ফলে এখন ভারতীয় চিনি চাহিদা মতো না পেলে দেশের বাজারে অবশ্যই প্রভাব পড়বে। এটা সাধারণ বিষয়।’তবে ওই কর্মকর্তার ভাষ্য, ‘এ ধরনের পরিস্থিতি কিছুটা সময়সাপেক্ষ। এখনো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না যে বাংলাদেশ কী পরিমাণ চিনি আনতে পারবে বা পারবে না। কারণ, ভারত কিন্তু এখনো রপ্তানি বন্ধ বা সীমিত করেনি। এমনও হতে পারে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে চাহিদা অনুয়ায়ী পণ্যটির সরবরাহ অব্যাহত রাখা হবে।’বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি চিনি আমদানি করে ব্রাজিল থেকে। এরপর চীন এবং ভারত। এছাড়াও যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়া থেকেও আসে অপরিশোধিত চিনি। ফলে বিশ্ববাজারে ভারত রপ্তানি সীমিত করলেও বাংলাদেশে এর প্রভাব খুব একটা পড়বে না বলে মনে করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংস্থাটির আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (আইআইটি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ কে এম আলী আহাদ খান জাগো নিউজকে বলেন, চিনির জন্য আমরা ভারতের ওপর ততোটা নির্ভরশীল নই। ভারত রপ্তানি সীমিত করলেও বিকল্প অনেক দেশ রয়েছে। সেজন্য চিন্তার কোনো কারণ নেই। সমস্যা হবে না। এক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ বা প্রস্তুতি আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো ভারতের পক্ষ থেকে অফিসিয়ালি কিছু জানতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে প্রয়োজন হলে যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তথ্য বলছে, দেশে চিনির চাহিদার প্রায় পুরোটাই এখন আমদানিনির্ভর। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোতে যে পরিমাণ চিনি উৎপাদন হয় সেটা চাহিদার তুলনায় খুবই নগণ্য। বিগত পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে এক কোটি সাড়ে ১১ লাখ টনের বেশি অপরিশোধিত চিনি। দেশের বৃহৎ পাঁচটি শিল্প গ্রুপ এসব চিনির আমদানিকারক। এরমধ্যে সিংহভাগ চিনি আমদানি করেছে সিটি ও মেঘনা গ্রুপ। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এরপরই তালিকায় আছে এস আলম, আবদুল মোনেম লিমিটেড ও দেশবন্ধু সুগার মিল। দেশে বছরে কমবেশি ২০ থেকে ২২ লাখ টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে। এরমধ্যে রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো চাহিদার ন্যূনতমও পূরণ করতে পারছে না। দেশীয় চিনির উৎপাদন কমতে কমতে তা এখন সর্বনিম্ন স্তরে নেমেছে। যেখানে এক দশক আগেও (২০১২-১৩ অর্থবছর) দেশের চিনিকলগুলোর বার্ষিক উৎপাদন ছিল এক লাখ টনের উপরে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৫টি রাষ্ট্রীয় চিনিকলে প্রায় ৮২ হাজার টন উৎপাদন হয়েছিল। ২০২০ সালের শেষ দিকে ছয়টি চিনিকল বন্ধের ঘোষণা আসার পর গত আখ মাড়াই মৌসুমে (২০২০-২১ অর্থবছর) উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ৪৮ হাজার ১৩৩ টনে। সবশেষ চলতি মৌসুমে (২০২১-২২ অর্থবছর) উৎপাদন আরও কমে নামে ২৪ হাজার ৯শ টনে।দেশে চিনি উৎপাদনের এই ক্রম নিম্নমুখী ধারার প্রেক্ষাপটে দিন দিনই বাড়ছে আমদানি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২১ লাখ ৬১ হাজার ৯৭২ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২২ লাখ ৯৫ হাজার ৯৮৮ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২২ লাখ ৩৮ হাজার ৮২৯ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২১ লাখ ৭০ হাজার ১৬৮ টন এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ২২ লাখ ৮৫ হাজার ৬০৩ টন অপরিশোধিত চিনি। অন্যদিকে ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, গত বছর দেশটি ২ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের চিনি রপ্তানি করছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সবোর্চ্চ ক্রেতা। ভারত সবচেয়ে বেশি চিনি রপ্তানি করেছে ইন্দোনেশিয়ায় ৭৬৯ মিলিয়ন ডলারের। এরপর বাংলাদেশে ৫৬১ মিলিয়ন ডলারের। এছাড়া সুদান ও সংযুক্ত আবর আমিরাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চিনি রপ্তানি করেছে প্রতিবেশী দেশটি। ২০১৬ সালে ভারত চিনি রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর বিগত বছরগুলোতে এ পণ্যের রপ্তানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। অর্থাৎ, টানা ছয় বছর বিশ্বব্যাপী চিনির বড় উৎস হিসেবে কাজ করেছে দেশটি। কিন্তু গত দুই বছরে ১৪ মিলিয়ন টনেরও বেশি রপ্তানির পর ভারত সরকার অগ্রাধিকারভিত্তিতে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে চিনি উৎপাদনের ওপর নজর দিয়েছে।