কৃষকরা সেই ধান কেটে আঁঁটি বেঁধে সিড়িঁর মতো করে সাজিয়ে রাখতো। আর সেখান থেকেই নদীর নাম ধানসিঁড়ি। স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা বলেন, সেসময় বিশাল এ নদীতে সুপারির হাট বসতো। নদীপথেই মাইলের পর মাইল ছেয়ে যেত হাজার হাজার নৌকায়। দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সুপারির হাট বসতো ধানসিঁড়ি নদীতে। এই নদীর সঙ্গে কবি জীবনানন্দের মিতালী যেন এক জন্মে শেষ হওয়ার নয়, তাই তো তিনি আবারো ফিরে আসতে চেয়েছেন এই ধানসিঁড়িটির তীরে।
‘হায় চিল /সোনালি ডানায় চিল/ এই ভিজে মেঘের দুপুরে/ তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে।’ জীবনানন্দের সোনালি ডানার চিল কিংবা বুনোহাঁস, শালিক অথবা ভোরের কাক আজো আছে। কিন্তু কবিতার সেই কালজয়ী ধানসিঁড়ি আজ মরে যাচ্ছে। এককালের জাহাজ চলা নদীটি আজ নাব্যতা হারিয়ে স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার পথে। মৃত্যুর পরেও কবি যে নদীটির তীরে ফিরে আসতে চেয়েছেন (আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়, হয়তো মানুষ নয় শঙ্খচিল শালিকের বেশে...) সে নদীটি হারিয়ে যাওয়ার তীব্র বেদনায় কবির সেই সোনালি ডানায় চিলগুলো যেন কেঁদে মরছে।
ঝালকাঠির সুগন্ধা, বিশখালি আর সুয়েজ খাল গবাখন চ্যানেলের মোহনা থেকে কবিতার সেই ধানসিঁড়ি নদীটি প্রবাহিত হয়েছে। এরপর ঝালকাঠি সদর উপজেলার ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের মধ্য থেকে প্রবাহিত হয়ে নদীর অপরপ্রান্ত গিয়ে বাগড়ি বাজারের তীরবর্তী জাঙ্গালিয়া নদীতে পড়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে, এককালে নদীটি এমন প্রশস্থ ছিল যে, এক ডোঙা ধান সিদ্ধের জন্য যতক্ষণ সময় লাগতো, নদী পার হতেও ততোক্ষণ সময় লাগতো। তাই সেসময় নদীটিকে ধান সিদ্ধের বাঁকও বলা হতো। আবার কারো কারো মতে, এ নদীর বিশাল চরে আগে ধান চাষ হতো। কৃষকরা সেই ধান কেটে আঁঁটি বেঁধে সিঁড়ির মতো করে সাজিয়ে রাখতো। আর সেখান থেকেই নদীর নাম ধানসিঁড়ি। স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা বলেন, সেসময় বিশাল এ নদীতে সুপারির হাট বসতো। নদীপথেই মাইলের পর মাইল ছেয়ে যেত হাজার হাজার নৌকায়। দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সুপারির হাট বসতো ধানসিঁড়ি নদীতে। আর এ নদী দিয়েই ভেঁপু (স্টমারের সাইরেন) বাঁজিয়ে বড় বড় সব স্টিমার যেত খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে।
ঝালকাঠির রাজাপুরে স্থানীয়ভাবে কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে গবেষণা করা অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক সোহরাব হোসেন বলেন, ‘বরিশাল ব্রজমোহন স্কুল শিক্ষক ও ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রবন্ধকার সত্যানন্দ দাশ এবং নারী কবি কুশুম কুমারী দাশের ছেলে জীবনানন্দ ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার বামনকাঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের ১০ বছর পর বাবার শিক্ষকতার সুবাদে বরিশালে বসবাস শুরু করে কবি পরিবার। এরপর বেড়ে ওঠা শিক্ষাজীবন সবই বরিশালে। কবির পৈত্রিক বাস ছিল বিক্রমপুর জেলায়। নদী ভাঙনের কারণে কবির জন্মের আগেই তারা ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার বামনকাঠিতে চলে আসেন। কবি মাতা নারী কবি কুসুম কুমারী দাশ জন্ম একই গ্রামে। সে আত্মীয়তার সুবাদেই কবি পিতা স্বপরিবারে ঝালকাঠি চলে আসেন। জমি কিনে বামনকাঠি গ্রামে বসবাস শুরু করেন। পরে কবি পিতা বরিশালে বসবাস শুরু করলেও কবির চাচার পরিবার বামনকাঠিতেই ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বসবাস করেন। কবি পরিবার বরিশাল থেকে গ্রামে আসা যাওয়া করতেন নানা উত্সব আয়োজনে। সেসময় কলতাকার লেখক-কবিদের নিয়েও নানা উত্সব বসতো ঝালকাঠির ওই গ্রামে।
যদিও বই-পুস্তকে কবির জন্মস্থান বরিশালে উল্লেখ করা হয়েছে।’ কেবল ঝালকাঠির গবেষক শিক্ষক সোহবার হোসেনই নয়, গত কয়েকবছর ধরে দেশের অনেক কবি-লেখকই ঝালকাঠির বামনকাঠি গ্রামকেই কবির জন্মস্থান দাবি করে আসছেন। এদিকে, এক সময় একমাত্র নদীপথ ধানসিঁড়ি হয়েই বারবার কবি ঝালকাঠি আসেন নিজবাড়ি কিংবা মামা বাড়িতে। সেই সুবাদেই ধানসিঁড়ি নদীটির রূপ ছুঁয়ে যায় তার কবিতায় বারবার। কবির বিখ্যাত ও সুপরিচিত কবিতা ‘আবার আসিব ফিরে’ ছাড়াও ধানসিঁড়ির নৈসর্গিক রূপ কিংবা চির সত্য মৃত্যুকে কবি তুলে ধরেছেন এভাবেই ‘একদিন জলসিঁড়ি নদীটির পাড়ে এই বাংলার মাঠে বিশীর্ণ বটের নিচে শুয়ে রব, পশমের মত লাল ফল ঝরিবে বিজন ঘাসে, বাঁকা চাঁদ জেগে রবে, নদীটির জল বাঙালির মেয়ের মত বিশালাক্ষী মন্দিরে ধূসর কপাটে।’ আবার আসিব ফিরে কবিতার আরেক পংক্তিতে ধানসিঁড়ি নদীর শাখা রূপসা খালটি উঠে এসেছে কবিতার চরণে এভাবে ‘রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে/ ডিঙ্গা বায়; রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে।’ ভৌগলিকভাবে যারা ঝালকাঠির এ রূপসা খালটিকে চিনবেন না তারা হয়তো মনে করবেন, কবি খুলনার রূপসা নদীর কথা বলেছেন। ঝালকাঠির এ রূপসা খালটি ধানসিঁড়ি নদীর একটি শাখা খাল। ঝালকাঠির গাবখান ব্রিজ থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে বৈদারাপুর গ্রামের ভেতর থেকে চলে গেছে খালটি। কবির গ্রাম বামনকাঠি থেকে তত্কালীন ধানসিঁড়ি নদীতে নৌকায় কবিও যৌবন কিংবা কৈশোরে ঘুরে বেড়িয়েছেন অনেকবার। রূপসার সাদা ছেঁড়া পালে ডিঙ্গা বাওয়া কিশোরটি হয়তো কবি নিজেই। আর সেই রূপেই মৃত্যুর পরে কবি আরো ফিরে আসতে চেয়েছেন ধানসিঁড়ির তীরে।
কবির হায়চিল কবিতায়্ত‘হায়চিল সোনালি ডানার চিল/ এই ভিজে মেঘের দুপুরে তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানর্সিড়ি নদীটির পাশে/ তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মত তার ম্লান চোখ মনে আসে/ পৃথিবীর রাঙা রাজ কন্যাদের মত সেজে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে/ আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হূদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’ কবিতার সোনালি ডানায় চিলেরা আজো কেঁদে মরে। তবে এ কান্না ধানসিঁড়ি নদীটির অস্তিত্ব হারিয়ে বিলিন হতে চলার বেদনায়। এককালের জাহাজ চলা নদীতে আজ যেন নৌকা চলতে ও বাঁধা পায়। নাব্যতা হারিয়ে নদীটি এখন সর্বোচ্চ গভীরতায় ৫ ফুট আর চওড়ায় ৭ ফুটের বেশি নয়। তাই ধান সিদ্ধের বাঁকের কাহিনি আজ আষাঢ়ে গল্পের মতো। এভাবেই আরো কিছুদিন কাটলে হয়তো নদীটির অস্তিত্ব কেবল বইয়ের পাতাতেই থাকবে। স্থানীয়রা জানায়, গাবখান সেতুর পূর্ব ঢাল থেকে দক্ষিণ দিকে উত্স মুখ পর্যন্ত নদীর চরে লোকজন এখন ধান চাষ করেছে। আর সেতু থেকে পূর্বদিকে রবি শষ্য চাষ করা হয়। রাজাপুর উপজেলার পিংড়ি থেকে ধানসিঁড়ি গ্রামে নদীর মিলিত স্থান পর্যন্ত পিংড়ি সেতুর দু-পাশে প্রায় ১ কিলোমিটারজুড়ে ছোট-বড় অসংখ্য চর। উত্স মুখ খনন না করেই এর প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার ভাটিতে নাব্যতার জন্য প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে খনন কাজ করা হয়েছে ২০১১ সালে। আর তারপর কেটে গেছে আরো কয়েকবছর। পলি পড়তে পড়তে নদীর নব্যতা একেবারেই হারাতে বসেছে। তবে এখনো বিভিন্ন সময় অনেক পর্যটক আসেন কবিতার সেই ধানসিঁড়ি দেখতে। এমনকি কলকাতা থেকেও কবি কিংবা সাধারণ পর্যটকও আসেন। তবে যতটা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তারা আসেন, নদী দেখে ততোটাই হতাশ হন। তবুও ঐতিহ্য রক্ষার লড়াইয়ে কোনোমতে বয়ে চলা এই ধানসিঁড়ি নদীতে আজো পড়ন্ত বেলায় সূযের্র খেলা চলে। ভিজে মেঘের দুপুরে সোনালি ডানায় এখনো চিল উড়ে বেড়ায়। আর নদীর দু-ধারে গড়ে ওঠা বেড়ি বাঁধে সারি সারি গাছের ছায়ায় দীর্ঘ মেঠোপথ পর্যটকদের কিছুটা হলেও মন কাড়ছে। সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলে কবি জীবনানন্দের স্মৃতি রক্ষায় নদীটি যথাযথ খনন করে পুরোনো ঐতিহ্য অনেকটা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তাহলে হয়তো জীবনানন্দের কালজয়ী কবিতার ধানসিঁড়ি নদীটি বেঁচে থাকবে জীবন্ত বাস্তবে।