স্বাধীনতার পর থেকে মানুষ স্বাবলম্বী হওয়ার নানা উপায় বা পথ খুঁজেছে এবং সে অনুযায়ী সফল হয়েছে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলার মানুষ যার পেছনে আজ পর্যন্ত গ্রামীণ মানুষের অবদান সবচেয়ে বেশি।
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। আর কৃষি খাতের অবদানে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব মানচিত্রে একটি শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশের সাফল্য অন্য যে কোনো দেশের জন্য ঈর্ষণীয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধান, পাট চাষের পাশাপাশি রকমারি ফল-ফসল, হাঁস-মুরগি লালন-পালন করে আর মাছ চাষ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে মানুষ। নতুন প্রজন্ম, তরুণ কৃষক ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশে। সেখান থেকেই বহু কৃষক আজ লাখপতি, কোটিপতি। আধুনিক হাইটেক কৃষির বাতাসও এখন বাংলাদেশের গায়ে লেগেছে। যার দ্রুত এবং কার্যকর ফলও আমরা পাব। বলছি মধ্য আশির দশকের কথা। সে সময় গ্রামের সাধারণ কৃষক গরুকে সারা বছর প্রাকৃতিক খাবার খাইয়ে বড় করে তোলার চেষ্টা করত। এসব গরু ছিল তাদের সর্বস্ব; যা তারা বড় করত কোরবানির বাজার মাথায় রেখে। তবে ক্রমেই মাংসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃত্রিমভাবে গরু মোটাতাজাকরণের বিষয়টি আসে। সে সময় এসব বিষয় আমি তুলে ধরি বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিসম্পদ বিভাগের প্রধান ড. সাদউল্লাহ তখন বন্যার সময় গরুর খাদ্যের কথা বলেন, ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক; যা আকারে একটি ইটের মতো এবং গরু চেটে খেতে পারত আপদকালে। এরও চার-পাঁচ বছর পর আসে ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র। চিটাগুড়, পানি আর সামান্য ইউরিয়া খড়ের সঙ্গে মিশিয়ে গরুকে খাওয়ালে দ্রুতই মোটাতাজা হয়। এ প্রসঙ্গে একটি মজার ঘটনা বলছি। গরু মোটাতাজাকরণের এই নানা দিক যখন প্রচার করছিলাম মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে, তখন একটি চিঠি আসে আমার কাছে। লিখেছিল একটি কম বয়সী ছেলে। চিঠিতে সে আক্ষেপের সঙ্গে লেখে, ‘স্যার আমি অনেক হ্যাংলা-পাতলা। আমি ইউরিয়া খেলে কি স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হবে?’ চিঠি পেয়ে আমি কোনো উত্তর না দিয়ে সরাসরি ঢাকার মিরপুরে তার ঠিকানায় পৌঁছে যাই এবং তার অভিভাবককে জানাই তাদের সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখতে যেন ভুলেও এ রকম কোনো কিছু সে না করে বসে। গল্পটি টানলাম শুধু আপনাদের জানাতে বাংলাদেশে গরু মোটাতাজাকরণের ইতিহাসের পেছনে কতই না ঘটনা আর গল্প ছিল।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাবে সারা দেশে এবার গড়ে উঠেছে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ খামার। সব মিলিয়ে এসব খামারে কোরবানির উপযোগী গরু রয়েছে ৪০ লাখ। আশার কথা হচ্ছে, ভোক্তা ও ক্রেতার মধ্যে গরুর মান সম্পর্কে ইতিবাচক সচেতনতা তৈরি হয়েছে। স্টেরয়েড বা ক্ষতিকর রাসায়নিক খাইয়ে গরু মোটাতাজাকরণের কুফল সম্পর্কে ইতিমধ্যে ধারণা পেয়ে গেছেন খামারি, ভোক্তা, ব্যবসায়ী সবাই। শুধু টাকার লোভে অসাধু পন্থা অবলম্বন করতে গিয়ে গত কয়েক বছরে বহু খামারি ও ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কারণ, স্টেরয়েড খাওয়ানো গরুর স্বভাব দেখে অনেক ক্রেতা এখন চিনতে পারেন। ওই গরুর মধ্যে চাঞ্চল্য কম। কোনো গরুর মুখ দিয়ে অবিরাম লালা বের হতে থাকে। এ রকম অনেক বৈশিষ্ট্য বুঝে যাওয়ার কারণেই খামারিরা সতর্ক হয়ে উঠেছেন। গত তিন বছর দেখা গেছে, কোরবানির সময় রাসায়নিক প্রয়োগের সন্দেহে যেসব গরু বিক্রি হয়নি, সেগুলোর মধ্যে অনেক গরুই কিছু দিন পর মারা যায়। কারণ, রাসায়নিক প্রয়োগের কারণে গরুর শরীরে যে বাড়তি পানি জমে, তা একটি নির্দিষ্ট সময় পরে বিষক্রিয়া করে; যা গরুর বেঁচে থাকার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। বিষয়গুলো এখন সচেতন খামারিদের কাছে পরিষ্কার। যারা বেশি বিনিয়োগ করে খামার গড়ছেন তাদের কাছে বিষয়টি বেশি চ্যালেঞ্জিং। তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন বিশুদ্ধ খাদ্য দিয়ে গরু মোটাতাজাকরণ করতে। প্রিয় পাঠক! কোরবানি সামনে রেখে প্রতি বছরই গরুর খামারের সংখ্যা বাড়ছে। এর সুফল হিসেবে ঠিক কোরবানির এই মৌসুমে গরু বা ছাগলের যা চাহিদা তা আমাদের দেশে বড় করা গরু-ছাগল দিয়েই পূরণ করা সম্ভব বলে দাবি করছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর।
গাজীপুরের কোনাবাড়ীর সুবেদ আলী অ্যাগ্রো ফার্মে লালন-পালন করা হয়েছে ২০০ গরু। আছে ২০টি গাভী। এমনকি মহিষও রয়েছে। ১০ মাস আগে গরুগুলো যখন তিনি কিনেছিলেন তখন সেগুলো ছিল ছোট ও লিকলিকে চিকন, হাড় জিরজিরে। সম্পূর্ণ দেশীয় খাদ্য দেওয়া হচ্ছে গরুগুলোকে। খাদ্য প্রয়োগের নিয়ম, হজমের সুবিধা-অসুবিধাসহ সব দিক খেয়াল রাখার কারণে গরুগুলো অত্যন্ত সুস্থ এবং দর্শনদারি। এই খামারের উদ্যোক্তা হাজী মনছুর আলী পেশায় ব্যবসায়ী। রয়েছে গার্মেন্ট, কেমিক্যালের ব্যবসা। প্রতি ঈদুল আজহায় নিজেদের ও আত্মীয়স্বজনের কোরবানির জন্য প্রয়োজন পড়ে ২০-২৫টি গরুর। হাট থেকে ভালো গরু বাছাই করা কঠিন দেখে উদ্যোগ নিয়েছিলেন নিজেই গরু মোটাতাজা করবেন জৈবিক উপায়ে। এ ছাড়া সুস্থ ও সুন্দর কোরবানির গরু ক্রেতাদের হাতে তুলে দেওয়াও তার আরেকটি লক্ষ্য। সঙ্গে ছিল চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের প্রেরণা। এসবের যোগফলই আজ তিনি একজন গরুর খামারি।
২ একর জায়গাজুড়ে মনছুর আলীর বিশালাকার গরুর খামার গড়ে উঠেছে। ভিতরের কার্যক্রম চলছে কয়েক স্তরে। একদিকের শেডে বড় বড় আকারের গরু, আরেকদিকে বেশ কয়েকটি গাভী। আরেকটি শেডে চলছে এসব গরুর প্রতিদিনের খাবারের আয়োজন। এর বাইরের অংশে সবুজ ঘাস উৎপাদন করা হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে একটি পরিকল্পিত গরুর খামার। প্রায় বছরখানেক আগে কেনা গরু এখন একেকটি তরতাজা ষাঁড়ে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি গরুর প্রতিই রয়েছে হাজী মনছুর আলীর যত্ন। তিনি বলেন, শুধু সুষম খাবার প্রদানই নয়, প্রতি সপ্তায় দুবার শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করান গরুগুলোকে। এর প্রমাণও মেলে গরুগুলো দেখে। গরুগুলো দেখতেও বেশ উজ্জ্বল। ২ কোটি টাকার গরু কিনেছেন মনছুর আলী। প্রথম বছরে প্রত্যাশা কম। আশা করছেন সব বাদ দিয়ে হলেও কমপক্ষে ৪০ লাখ টাকা মুনাফা ঘরে তুলতে পারবেন। এ তো গেল টাকার হিসাবে মুনাফার কথা। কিন্তু তিনি জানালেন, টাকার চেয়েও বেশি মুনাফা হলো মনের আনন্দ। এ কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে মিলছে তার মানসিক প্রশান্তি। প্রতিটি গরুর প্রতি তার মমতা আর বন্ধন যেন অন্যরকম এক শ