কুমিল্লা জেলার ১৯ বছরের মাসুদা আক্তারকে তার খালাত ভাই বাণিজ্য মেলা দেখানোর কথা বলে ভারতে বিক্রির উদ্দেশ্যে সীমান্তবর্তী গ্রামে নিয়ে গেলে পাচারকারী খালাত ভাই জগলুকে জনগণ ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। তার স্বীকারোক্তিতে সে কথা প্রকাশিত হয়।
ফেনী জেলার আলতাপুর গ্রামের আকলিমা বানুর পিতার অভাবের সংসার। দারিদ্র্যে সঙ্গে নিত্যদিনের বাঁচা-মরার যুদ্ধ তাদের। একই গ্রামের অধিবাসী আবু বকর জেলা সদরে বাসাবাড়িতে আকলিমাকে মোটা অঙ্কের বেতনে কাজ দেওয়ার কথা বললে আকলিমার পিতা-মাতা মেয়েকে তুলে দেন তার হাতে। কিছুদিন পর মেয়েটিকে ভারতে বিক্রি করে দেয় আবু বকর।
প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ময়না, তাসলিমা ও ফরিদার মতো শত শত নারী-শিশু পাচারের শিকার হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে নারী-শিশু পাচার হওয়ার মূল কারণ—দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নারীর নিম্নমানের পেশা, চাকরির সুযোগের অভাব, মাথাপিছু নিম্ন আয়, সম্পদে নারীর অনধিকার, চাকরির ক্ষেত্রে সমান সুযোগের অভাব ইত্যাদি। বাংলাদেশে বিভিন্ন গবেষণা ও সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে এলাকার নারী-পুরুষরা পাচারের শিকার হয় সে এলাকার লোকজন অত্যন্ত দরিদ্র, সেখানে ভূমিহীনদের সংখ্যাধিক্য, খাদ্যাভাব এবং চরম বেকারত্ব বিরাজমান। এ পরিস্থিতিতে এসব এলাকার পিতা-মাতারা নগদ অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়—এমন কারো নিকট থেকে পরিবারের নারী ও শিশুদের জন্য বিবাহ বা চাকরির প্রস্তাব পেলে তা গ্রহণ করতে বিলম্ব করে না। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং ভোগ্যপণ্য পাওয়ার লোভে পাচারকারীরা নিজেদেরও নিপুণভাবে পরিচালনা করে থাকে।
রাজশাহী মহানগরী ও আশপাশের এলাকার সীমান্তবর্তী ঘাটগুলো দিয়ে গত ১৭ মাসে ১৪টি পাচারের ঘটনায় উদ্ধার করা হয় ৮০ নারী ও শিশুকে। আটক করা হয় ছয় পাচারকারীকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে পাচার আইনে কোনো মামলা হয়নি। মামলা হয়েছে পাসপোর্ট আইনে। এ কারণে সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রটি বারবার আইনের হাত থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে। শান্তিতে নোবেলজয়ী কৈলাশ সত্যার্থীর প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল মার্চ অ্যাগেইনস্ট চাইল্ড লেবারের প্রকাশিত সমীক্ষায় বলা হয়, যেসব নারী ও শিশু সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পাচার হচ্ছে তাদের বেশিরভাগই দেশটিতে যৌনকর্মে বাধ্য হচ্ছে। ভারতে প্রায় ৩ হাজার ৪০ কোটি ডলারের যৌন বাণিজ্যে প্রতিবছর প্রায় ৩০ লাখ কম বয়সী নারীকে জোরপূর্বক এই ঘৃণ্য ব্যবসায় নামানো হচ্ছে।
কৈলাশ সত্যার্থীর প্রতিষ্ঠানের ‘বাধ্যমূলক শ্রম ব্যবসার পেছনের অর্থনীতি’ সমীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া নারী ও শিশু সম্পর্কিত সংবাদ এবং তথ্য প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ভুক্তভোগীরা উদ্ধার ও দালালরা আটক হচ্ছে। কিন্তু পাচার রোধের সব ব্যবস্থা উপেক্ষা করে দিন দিন পাচার বেড়েই চলছে। যৌন ব্যবসায় শিশুদের পাচার করার জেরে যে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়, পাচারকারী ছাড়াও তার ভাগ পায় পতিতালয়ের মালিক, মহাজন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, আইনজীবী ও বিচারব্যবস্থায় জড়িত ব্যক্তিরাসহ অনেকে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৪ হাজার ২২২ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ২৮৮ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা রয়েছে। বাংলাদেশে ১৮টি রুট দিয়ে প্রতিবছর হাজার হাজার নারী-শিশু পাচার হচ্ছে। যশোর জেলা মানবপাচার প্রতিরোধ কমিটির এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়, ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯১ জনকে পাচারকালে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩২ শিশু, ৪৫ নারী ও ১৪ পুরুষ রয়েছে। এছাড়া গেল এক বছরে ভারতে পাচার হওয়া ৬৯ শিশু, ১৩২ নারী ও ৬৪ পুরুষকে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন সরকারের সহযোগিতায় উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে এনেছে। এ বিষয়ে ঢাকার আহছানিয়া মিশনের মিচিং চাইল্ড অ্যালার্ট প্রকল্পের যশোর এলাকা সমন্বয়কারী রফিকুল ইসলাম জানান, উদ্ধার হওয়া এসব নারী, শিশু ও পুরুষের আইনি সহায়তা দেওয়াসহ তাদের আশ্রয় কেন্দ্রে রেখে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতে পরবর্তী সময়ে কাজের সন্ধানে ভারতে যাওয়ার ইচ্ছা কিংবা কোনো প্রলোভনে তাদের পড়তে না হয় আর এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, বিগত আড়াই বছরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ২,৬৫৫ শিশু নিখোঁজ হয়েছে। এর মাঝে ২ শতাংশ অর্থাৎ ৩৫ শিশুকে পুলিশ, বিডিআর এবং স্থানীয় লোকজন কর্তৃক উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। একই সময়ে ১,২১৯ শিশু অপহৃত এবং ১,০০৭ শিশু পাচার হয়েছে। এসব শিশুর বয়স ১০ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। এ গবেষণা দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে করা হয়েছে। বাস্তবে এ সংখ্যা আরো ভয়াবহ, কারণ পাচারের সব খবর পত্রিকায় আসে না। গত বছর ৩৭৭টি পাচারের ঘটনার মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ৮৩টির।
ইদানীং পাচারকারীদের টার্গেট হচ্ছে মফস্বলের কলেজ পড়ুয়া উঠতি বয়সী মেয়েরা। অল্পবসয়ী গৃহবধূও টার্গেটের মধ্যে আছে। দেশের অভ্যন্তরে নারী পাচারকারী দালালরা কোনো একটি মেয়েকে প্রথমে টার্গেট করে। এরপর ওই মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে মেয়েটিকে প্রলুব্ধ করতে বা তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে বেশ টাকা খরচ করে তারা। মেয়েটি প্রেমের ফাঁদে পুরোপুরি পা দিলে তাকে বিয়ের কথা বলে বাড়ি থেকে বের করা হয়। পরে মেয়েটিকে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দালালের হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রতি নারীর জন্য ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। শিশু সংগ্রহের পদ্ধতি বড় বিস্ময়কর। চক্রের সদস্যারা দীর্ঘ সময় ধরে এই কাজ করে অতিগোপনে এবং সতর্কতার সঙ্গে। প্রথমে তারা শিশুটির অভিভাবকের সঙ্গে জমিয়ে তোলে ঘনিষ্ঠতা, বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়ানোর ঘটনাও ঘটে। এরপর সময়-সুযোগ বুঝে বিদেশে শিশু পাঠিয়ে মোটা টাকা রোজগারের লোভ দেখানো হয়। শিশুটির অভিভাবকের মনে বিশ্বাস জন্মাতে তাদেরও সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কোনো মতে একবার রাজি করাতে পারলেই শিকার চলে আসে হাতের মুঠোয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, তালিকায় থাকা মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা গ্রামাঞ্চলের অশিক্ষিত, দরিদ্র নারী-পুরুষ ও শিশুদের অধিক উপার্জনের আশায় চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ভারত, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে পাচার করে থাকে। তারা প্রথমে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে নারী, কিশোরীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ সংগ্রহ করে। পরে বিভিন্ন কায়দায় স্থল, সীমান্ত ও বিমানবন্দর দিয়ে তাদের পাচার করে।
দেশের বিভিন্ন আদালতে বর্তমানে মানবপাচার বিশেষ করে নারী ও শিশুপাচারসংক্রান্ত ৭৮৬টি মামলা বিচারাধীন। যার সংখ্যা গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে ছিল ৭৭৮। বর্তমানে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে ঝুলে থাকা অর্থাৎ পেন্ডিং মামলার সংখ্যা ২৫৪, দুই বছরের বেশি ১৩৯ ও পাঁচ বছরের বেশি ২০৫টি। এছাড়া ১০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে পেন্ডিং মামলার সংখ্যা হচ্ছে ১৪টি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলের মতে, ‘বাংলাদেশের ২৮টি জেলাসংলগ্ন সীমান্ত পথগুলোকেই পাচারের প্রধান রুট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এসব পথেই প্রতিবছর ১০ হাজারেরও বেশি (মোট পাচারের ৫০ শতাংশের বেশি) নারী ও শিশু পাচার হয়ে থাকে। বিদেশে জনশক্তি প্রেরণকারী কিছু প্রতিষ্ঠান ও তাদের সহযোগী হোটেল, ও বারের মালিক, পতিতালয় ও বস্তি পরিচালনাকারী, আগে পাচার হওয়া ব্যক্তি এবং আন্তর্জাতিক চক্রের সদস্যরা দেশে পাচারের কাজে সক্রিয় রয়েছে। পাচার করা শিশু ও নারীদের দূর-সম্পর্কের আত্মীয়, আত্মীয়ের বন্ধুবান্ধব, স্বল্পসময়ের পরিচিত ব্যক্তি প্রতিবেশী বহুবিবাহকারী ব্যক্তিদের মাধ্যমে তারা মূল ভূমিকা রাখছে।’
পাচারের একটি বড় কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা আন্তর্জাতিক অভিবাসন পলিসিকে দায়ী করেছেন। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার মিডিয়া ফোকাল পয়েন্ট নাহরিন ফারজানার মতে, ‘প্রত্যেক দেশের আলাদা অভিবাসন নীতিমালা আছে। সারা পৃথিবীর জন্য একক কোনো নীতিমালা নেই। তবে সার্ক একটি কনভেনশন করেছে, যেটি নেপাল ছাড়া সার্কভুক্ত দেশগুলো সমর্থন করেছে। নেপাল সমর্থন করলে পাচারের বিরুদ্ধে অন্তত একটা আঞ্চলিক ব্যবস্থা তৈরি হবে। তখন ভারত ও পাকিস্তানে পাচার করা বাংলাদেশি নারী ও শিশুদের সহজেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।’
|