বিকেল শেষের রাঙা মুকুল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সারা গাঁয়ের শরীরে। শানুর মনেও সুখের শিশির। ঘরের দাওয়ায় বসে পাতা ছিঁড়ে দিচ্ছে ছাগলছানা দুটিকে। এমন সুখের ছবি তার শাশুড়ির কাছে মনমরা। রেগে বলে, শানু ‘পিঁড়ায় ছাগল লাফালে বংশ লোপ পায়। বাতি দেওয়ার কেউ থাকে না।’ অসহায় চোখে ভয়ের প্রচ্ছায়ায় ভারী পেটটায় হাত বুলায় শানু। পাতার ডালটা দূরে ছুড়ে ফেলে হাঁপানো গলায় বলে, আমি মরব তবু পেটেরটাকে মারব না কিছুতেই। শাশুড়ি শাহানার হাত ধরে, বুঝলি শানু-মেয়ে মানুষের জীবন সে তো একটা গাছ। ফুল-ফল না এলে কী তার দাম?
বিয়ের দেড় বছর পর শাহানা প্রথম সন্তান ধারণ করে এবং বাড়িতে বহু কষ্টে একটি মৃতসন্তান প্রসব করে। এ ঘটনার এক বছর পর সে আবার সন্তান ধারণ করে। আজ সন্ধ্যায় বাড়ি এসেছে শানুর স্বামী আজিজ। তার সব সময় মনের ভেতর একটা অস্থিরতা ঘুরপাক খায় ঘূর্ণিবায়ুর মতো। বউটা দশ মাসের পোয়াতি, কখন কী হয়! রাতে সবাই ঘুমিয়ে। ঘরের চালে আনন্দে ছোটাছুটি করছে ইঁদুরগুলো। কিন্তু তীব্র ব্যথায় আড়ষ্ট হয়ে আসছে শাহানার কণ্ঠ। দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে হাত-পায়ের কাঁপন, সব শক্তি দিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসার চেষ্টা করছে, পারছে না। শেষরাতে বউ-শাশুড়ির গোপন কথায় ঘুম ছুটে যায় আজিজের। সন্তান প্রসবের উদ্দেশ্যে তার মা অভিজ্ঞ দাইকে নিয়ে এলেন। তারপর সারাদিন কী এক যন্ত্রণা উত্তেজনার টানাপড়েন। কিন্তু বিকেল থেকে শুরু হলো খিঁচুনি। এ অবস্থা দেখে দাইমা বলছেন, ‘তোমার বউয়ের আলগা বাতাস লাগছে। বড় হুজুর থ্যাইকা পানি পড়া নিয়া আহো।’ আর খবর পেয়ে শাহানার বাবা তার গাঁয়ের অভিজ্ঞ কিসমত কবিরাজকে নিয়ে এলেন। কবিরাজ রোগীর অবস্থা দেখে বললেন, ‘ঝাল পোড়া দিতে হবে। ঘরের বাতি নিবাইয়া দেন। মোটা দড়ি, আগুন, সরিষার তেল আর লাল শুকনো মরিচ আনেন।’ এরপর শুরু হলো দড়ির মাথায় আগুন জ্বেলে মরিচ পুড়ে শানুর নাকের ডগায় ধরা। এভাবে ঘণ্টাখানেক চলার পরই নাকে-মুখে বমি শুরু হলো তার। বমি করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।—এভাবেই আজিজ ডাক্তার আপাকে বলল কবিরাজের হাতুড়ে চিকিৎসার কথা।
কুমিল্লা সদর হাসপাতালের দারোয়ান জব্বার মুন্সি তার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন, ‘শহর থেকে ১৯ কিমি পথ রসুলপুর গ্রাম। ধানখেতের আইল ধরে ফিরছি। কান্নার শব্দে উৎসুকতায় দাঁড়াতে হলো। শব্দ ধরে এগিয়ে বাড়িতে ঢুকে চোখে পড়ল উঠানের কোনায় একজন ষাটোর্ধ্ব নারী বসে কাঁদছেন আর ওইখানটায় নানা বয়সী মহিলা তাকে ঘিরে আছে। ধীরে ধীরে তার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করতেই প্রথমে বলতে কিছুটা যেন সংকোচবোধ করছিল। পরে হাসপাতালের কর্মচারী জানাতেই বলল, ‘আমার পুতের (ছেলের) পোয়াতি বউডারে নাকি জিনে ধরছে। জব্বার মুন্সি মুহূর্তেই পরামর্শ দেন—যদি বউ এবং বাচ্চা বাঁচাতে চান তাহলে ডাক্তারের কাছে নেওয়া জরুরি। সবাই নিশ্চুপ। একে-অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। একটু বিব্রত হয়েই জব্বার মুন্সি বললেন, ‘আমার মেয়েরও এমন হয়েছিল হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার আপা বলল তোমার মেয়ের রক্তশূন্যতায় এ-অবস্থা হয়েছে। জিন-ভূত ওসব কিছু নয়।’ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রোকসানা হোসেন বলেন, ‘প্রথম সন্তান প্রসবের পর থেকেই শানুর অনবরত প্রস্রাব ঝরা এবং মাঝে মাঝে মলদ্বারের পরিবর্তে যোনিপথে মল এসে যেত। বাধাপ্রাপ্ত প্রসবের কারণে ‘ভ্যাসাইকো ভ্যাজাইনাল ফিস্টুলা এবং রেকটো ভ্যাজাইনাল ফিস্টুলায় ভুগছিল সে। এই জটিল অবস্থায় অপারেশন ছাড়া ভালো হওয়ার কোনো উপায় নেই। আমাদের গ্রামের মহিলারা এভাবে তিলে তিলে চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সে শুরুতেই জীবনের ইতি টানছে। এ ছাড়া প্রতি একজন মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে প্রতি বছর প্রায় ১০০ মহিলা প্রসবজনিত জটিলতায় ভোগেন। ২০০ মহিলা যৌনরোগে আক্রান্ত হন এবং প্রায় এক হাজার মহিলা অপুষ্টিতে ভোগেন।
দরিদ্র এবং অচ্ছল পরিবারের গর্ভবতী নারীরা অপুষ্টি এবং রক্তহীনতায় ভোগেন, পরিণামে তারা রুগ্ণ সন্তান জন্ম দেন। প্রসবকালীন জটিলতায় প্রসূতির মৃত্যু-সংক্রান্ত এ দেশে অত্যন্ত বেশি। এ ছাড়া বাংলাদেশে প্রসূতি মৃত্যুর আরো একটি কারণ হচ্ছে অশিক্ষিত ধাত্রী বা দাই। সেকেলে ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী ও পুরনো আমলের সরঞ্জাম এবং যন্ত্রপাতি সজ্জিত ধাত্রী বা দাই প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ঠিক কী করা উচিত তা বিবেচনায় আনতে সক্ষম হন না। ফলে দেখা যায়, উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা পেলে যেখানে প্রসূতি মা ও সন্তান দুজনই সুস্থ থাকত, তাদের কেউ একজন বা দুজনই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এতে পৃথিবীতে প্রতিমিনিটে প্রসবজনিত জটিলতায় একজন করে নারী মারা যাচ্ছে। এসব হতভাগ্য নারীর দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার অন্যতম কারণ দক্ষ ধাত্রী বা চিকিৎসকরা তাদের প্রসব করায় না। উন্নয়নশীল দেশে মাত্র ৫৩ ভাগ মায়ের প্রসব হয় চিকিৎসকের হাতে। পৃথিবীতে প্রতিবছর ৬০ মিলিয়ন শিশু ধাত্রীর হাতে জন্মায়। আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ২৯ হাজার মা গর্ভ ও প্রসবজনিত নানা কারণে মারা যান। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা প্রসূতি মৃত্যুর পাঁচটি মূল কারণ নির্র্ণয় করেছেন—১. প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ-৩৬, ২. অনিরাপদ গর্ভপাত-৩০, ৩. একলামশিয়া বা উচ্চচাপ-২৬, ৪. বাধাগ্রস্ত প্রসব-০৯, ৫. প্রসবজনিত সংক্রমণ-১১ এবং ৬. বিবিধ-১৮ শতাংশ।
ডা. তারেক মাহমুদ হুসেইন এবং ধামালিনগাম ও জন এফ স্মিথের এক গবেষণা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা যাদের আছে এ ধরনের গর্ভবতী নারীদের ধনুষ্টকার প্রতিরোধ ইনজেকশন নেওয়ার প্রবণতা নিরক্ষর গর্ভবতী নারীদের চেয়ে দুই দশমিক আট গুণ বেশি। অজ্ঞতা ও অশিক্ষা ছাড়াও নারীরা স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ পায় না। ফলে তারা মৃত্যুর মুখে পতিত হতে পারে সহজে। ছোটবেলা থেকে পারিবারিক বৈষম্যের শিকার মেয়েদের পুষ্টির জোগান দেওয়া হয় না ঠিকমতো, তাই প্রসবকালীন ধকল তারা সইতে পারে না অনেক ক্ষেত্রে। এ ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিজবাড়ি থেকে দূরে থাকায় সেখানে নিয়মিত নিয়ে যাওয়া হয় না গর্ভবতী নারীদের। গ্রামের দরিদ্র পরিবারে এ-ও দেখা গেছে, চিকিৎসাকেন্দ্রে আনা-নেওয়ার ফলে সংসারের কাজে ব্যাঘাত ঘটায় গর্ভবতী নারীকে
পরিবারের লোকজন চিকিৎসাকেন্দ্রে নেয় না। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিকটাও বিবেচনা করে পরিবারের লোকজন। একে আদিম মূর্খতা এবং বর্বরতা ছাড়া আর কোনো বিশেষণে আখ্যায়িত করা সম্ভব নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যান রিপোর্টে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লাখ প্রসূতির মৃত্যু হয়ে থাকে। আর এদের মধ্যে ৯৯ শতাংশ মারা যায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। বাংলাদেশে প্রসূতি মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ছয়জন। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় এটি ৫০ থেকে ১০০ গুণ বেশি। সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক এক সমীক্ষা রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, গর্ভধারণ ও সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত কারণে বাংলাদেশে প্রতিদিন ৬৩ জন বা বছরে ২৩ হাজার মা মৃত্যুবরণ করেন। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করা একটি সামাজিক দায়িত্ব। মা ও শিশুর সুস্থাভাবে বেড়ে ওঠা পারিবারিক সম্প্রীতি ও সামাজিক উন্নয়নের সহায়ক। তাই মাতৃত্বের সুরক্ষায় এগিয়ে আসা আমাদের সবার কাম্য।