১৯৯৪ সালে তিন দিন বয়সী এক কন্যা শিশুকে বাজারে ফেলে গিয়েছিল চীনের এক দম্পতি। দেশটিতে তৎকালীন এক সন্তান নীতিমালা আর দারিদ্র্য তাদের বাধ্য করেছিল। কিন্তু শিশুটির সাথে তারা রেখে গিয়েছিলেন একটি চিঠি। এতে লেখা ছিল হাংঝু শহরের একটি ব্রিজের ওপর কবে এবং কখন তারা অপেক্ষা করবেন। এই চিঠির বদৌলতে এত বছর পর সেই কন্যা শিশুটি ফিরে পেল তার আসল বাবা মাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের হাডসন বিল থেকে শুধুর চীনের হাংঝু শহর ভ্রমণ করছেন কাটি পোলার । শহরের একটি ব্রিজে বছরের একটি নির্দিষ্ট দিন, নির্দিষ্ট সময়ের অপেক্ষা করেন এক দম্পতি লিডা ও পিংসিয়াম। তাদের সেই অপেক্ষা অবশেষে অবসান হয়েছে।
চীনে বহুদিন এক সন্তান নীতিমালা বলবৎ ছিল। একটি সন্তানের বেশি হলে দম্পতিদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। জোরপূর্বক গর্ভপাত, সন্তান নেওয়ার ক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া অথবা জরিমানা করা হত। তাই অনেক দম্পতি একের অধিক সন্তান হয়ে গেলে ভয়ে সেটা গোপন রাখতেন। অথবা কোনো উপায় না থাকলে সেই সন্তানকে পরিত্যাগ করবেন। তেমনটাই হয়েছিল ১৯৯৪ সালে জন্ম নেওয়া কাটি পোলারের বেলায়, বলছিলেন তার জন্মদাতা বাবা।
তিনি বলেন, কাটির জন্মের তিন দিন পর আমি সকালে উঠে ওর জন্য দুধ বানালাম, অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলাম। তারপর বাজারের দিকে হেঁটে গেলাম। ও ঘুমাচ্ছে তাই ওই দিন সে কাঁদেনি। আমি ওর কপালে আলতো করে চির বিদায় জানালাম।
তারপর একটি অনাথ আশ্রম থেকে কাটিকে দত্তক নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হাডসন বিল শহরের কেইন ও রুথ পোলার দম্পতি। সেতাঙ্গ পরিবারে বড় হওয়া চীনা শিশুটি প্রায় জিজ্ঞেস করে সে কোথা থেকে এসেছে।
রুথ পোলার বলেন, সে আমাকে প্রায়ই বলতো আমি কার পেট থেকে এসেছি? আমি কি তোমার পেট থেকে এসেছি? আমি ওকে বলেছিলাম তুমি চীন দেশের এক নারীর পেট থেকে এসেছ। কিন্তু আমার হৃদয়ে তােমার জন্ম। কথাটা শুনে সে খেলতে চলে গেল। আমার এই জবাবে সে যেন সন্তুষ্ট হয়ে ছিল।
সন্তুষ্ট হলেও কৌতূহল মেটেনি তার। যে অনাথ আশ্রম থেকে কাটিকে দত্তক নিয়ে ছিলেন কেইন ও রুথ পোলার। তাদের সাথে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিল, দারিদ্র্য ও অন্য কিছু সমস্যার কারণে আমরা তোমাকে ফেলে যাচ্ছি। তোমাকে রাস্তায় ফেলে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না। তোমার মনে যদি কখনো বাবা-মায়ের প্রতি অনুকম্পার জন্ম হয়। তাহলে ১০ থেকে ২০ বছর পর হাংঝু শহরের ভাঙা ব্রিজের ওপর এসো।
২০০৪ সাল থেকে প্রতি বছর ওই নির্দিষ্ট দিনটাতে আমি সেই ভাঙা ব্রিজটাতে অপেক্ষা করতাম। আমি জানতাম হয়ত এতে কোনো আশা নেই। তবুও আমি অপেক্ষা করতাম। যখন ওর সাথে দেখা হবে তখন ওকে কী বলব? ওর কাছে যদি আমি হাজারো বার ক্ষমা চাই সেটা কি যথেষ্ঠ হবে?
সম্প্রতি কাটিলের হাতে এই চিঠিটা দিয়েছেন তার দত্তক বাবা-মা। সেই সূত্র ধরেই কাটি মিলিত হয়েছেন তাকে জন্ম দেওয়া আসল বাবা-মায়ের কাছে।
কাটি বালেন, আমি বড় হওয়ার সময় তেমন কোন প্রশ্ন করিনি। তবে মাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম আমার জন্মদাতা বাবা-মা সম্পর্কে সে কত টুকু জানে? মা বলেছিল একটা জিনিস অনেক আগেই তোমাকে দেওয়ার দরকার ছিল।
‘আমার আসল বাবা-মায়ের সাথে দেখা হওয়া নিয়ে আমার একটি ভয় ছিল। আমার মনে হতো আমি যদি কোনোভাবে তাদের হতাশ করি। আমাকে রাস্তায় ফেলে যাওয়া নিয়ে ওরা হয়তো নিজেকে অপরাধী মনে করছে। আমি বুঝতে পারি ওরা কতটা কষ্টের মধ্য দিয়ে জীবন কাটিয়েছে। অবসান হলো!
হাংঝু শহরের সেই ভাঙা ব্রিজটা এখন আর ভাঙা নেই। কিন্তু সেটির ওপর ২৩ বছর পর মিলিত হলো কাটি ও তার জন্মদাতা বাবা-মা। সূত্র: বিবিসি