রাজনৈতিক কিংবদন্তি, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের ৭৫তম জন্মদিন আজ। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী তোফায়েল ১৯৪৩ সালের ২২ অক্টোবর ভোলার কোড়ালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৌলভী আজহার আলী ও মাতা ফাতেমা বেগম ছিলেন এলাকার সম্মানিত ব্যক্তি। ১৯৬৪ সালে ধনিয়ার মফিজুল হক তালুকদারের জ্যেষ্ঠ কন্যা আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তারা এক কন্যা সন্তানের জনক-জননী।
জননেতা তোফায়েল আহমেদ ভোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে আইএসসি এবং বিএসসি পাস করেন যথাক্রমে ১৯৬২ এবং ১৯৬৪ সালে। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৃত্তিকা বিজ্ঞানে এমএসসি পাস করেন। কলেজ জীবন থেকেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। বজ্রমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক পদে এবং কলেজ হোস্টেল অশ্বিনী কুমার হলের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন ১৯৬২ সনে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ১৯৬৪ সালে ইকবাল (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) হল ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক, ১৯৬৫ সালে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের সহ-সভাপতি এবং ১৯৬৬-৬৭ সালে ইকবাল হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ডাকসুর ভিপির দায়িত্ব পালনকালে চারটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে বঙ্গবন্ধু মুজিব প্রদত্ত ছয় দফাকে হুবহু ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন।
১৯৬৬-এর ৮ মে থেকে ১৯৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৩৩ মাস কারাগারে আটক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সব রাজবন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তিদানে তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সারা বাংলায় তৃণমূল পর্যন্ত তুমুল গণআন্দোলন গড়ে তোলে। ৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দিকে মুক্তিদানে স্বৈরশাসককে বাধ্য করেন। আর ৬৯-এর ২৫ মার্চের মধ্যে তথাকথিত প্রবল পরাক্রমশালী লৌহমানব আইয়ুব খানকে পদত্যাগে বাধ্য করে গৌরবের যে ইতিহাস সৃষ্টি করেন তা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সেল।
১৯৬৯ সালে তোফায়েল ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭০-এর ৭ জুন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। বস্তুত এরপর সংগ্রামী জননেতা তোফায়েল আহমেদ জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের একজন বলিষ্ঠ সংগঠকে পরিণত হন।
স্বাধীনতা যুদ্ধপূর্ব ছাত্র ও গণআন্দোলনে সফল নেতৃত্ব প্রদান করায় তোফায়েল আহমেদ দেশবাসীর অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও আস্থা অর্জন করেন। আবাসিক হল ও ডাকসুর ভিপি থাকাকালেই তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সাহচর্যে আসেন। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে ভোলার দৌলত খান-তজুমদ্দিন-মনপুরা আসন থেকে মাত্র ২৭ বছর বয়সে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং ‘মুজিব বাহিনী’র অঞ্চলভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত চার অধিনায়কের অন্যতম। বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া ও পাবনা সমন্বয়ে গঠিত মুজিব বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার সংগ্রামে তোফায়েল আহমেদের ভূমিকা অতুলনীয়। ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১০ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে বাংলাদেশ গণপরিষদ প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক এবং ১৯৭২-এ বাংলাদেশ গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত ও বলবৎকৃত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭২-এর ১৪ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তাকে রাজনৈতিক সচিব নিয়োগ করেন। ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন। ১৯৭৩-এ নিজ জেলা ভোলা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫-এ দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ঘোষণার পর প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী নিযুক্ত হন। তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সফরে তার সফরসঙ্গী হন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, অটোয়াতে কমনওয়েলথ সম্মেলন, লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলন, আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন এবং জ্যামাইকায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগদান। এছাড়াও যুগোশ্লাভিয়া এবং ইরাক সফর করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর তোফায়েল আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘ ৩৩ মাস তিনি কারান্তরালে ছিলেন। ১৯৭৮-এ কুষ্টিয়া কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। দীর্ঘদিন তিনি সাফল্যের সঙ্গে এই পদ অলঙ্কৃত করে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করে সামরিক শাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৮৬, ৯১, ৯৬, ২০০৮, ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। বর্তমানে বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।