কংক্রিটময় নগর প্রকৃতির ভিড়ে ভাটি-বাংলার ফসল তোলার ‘নবান্ন উৎসব’ উদযাপন করেছে লোকজ সংস্কৃতিপ্রেমী রাজধানীবাসী। শহুরে জীবনের ব্যস্ততায় শিকড়কে ভুলতে বসা তরুণদের দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ও লোকজ উপাদানগুলোকে নাগরিক জীবনে আরো বেশি আপন করে নেওয়ার প্রত্যয় এসেছে এবারের জাতীয় নবান্নোৎসবে। গতকাল বুধবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় এই জাতীয় নবান্নোৎসব উদযাপন পর্ষদ আয়োজন করে ২০তম নবান্ন উৎসব। ভোর ৭টায় গাজী আবদুল হাকিমের বাঁশিতে লোকজ গানের সুরে এবারের উৎসবের শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান উৎসবের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পর ‘নবান্ন কথন’ শিরোনামের আলোচনা পর্ব শেষে শুরু হয় উৎসবের সাংস্কৃতিক পর্ব।
সাংস্কৃতিক পর্বে লোকগানের সঙ্গে নৃত্যের পাশাপাশি অগ্রহায়ণে বাংলার প্রধান ফসল ধান কাটা নিয়ে ছিল বিভিন্ন গান। পটগান, ধামাইয়া গানসহ বিভিন্ন ধরনের লোকগানের সঙ্গে শিল্পীরা গেয়ে শোনান দেশের গান ও লালনগীতি আর রবীন্দ্র সংগীত। ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’ গানের সঙ্গে সম্মেলক নৃত্য পরিবেশন করে নটরাজ ও নৃত্যজন। এদিন ‘চল যাই ধান কাইটা আনিতে’ ও ‘দিন যায় দিন আসে’-গান দুটির সঙ্গে সম্মেলক নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যম। ‘চাষি ভাই আয় রে’ গানের সঙ্গে নৃত্যজন, লোকজ গানের কম্পোজিশনের সঙ্গে কাদামাটি ও স্পন্দন সম্মেলক নৃত্য পরিবেশন করে। সম্মেলক গান পর্বে ‘কাটি ধান কাটি ধান আয় রে’ গান পরিবেশন করে বহ্নিশিখা, ‘মাঠে মাঠে সোনালি ধান’ পরিবেশন করেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী পরিবেশন করে ‘আমার জমবে মেলা বটতলা হাট’ গানটি।
একক গান পর্বে ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি’ লালনগীতি পরিবেশন করেন ফরিদা পারভীন, শাহীন সামাদ শোনান কাজী নজরুল ইসলামের ‘এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায়’, সুমা রায় শোনান ‘আমি তোমারই মাটির কন্যা’, শামা রহমান শোনান ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।
আবৃত্তি পর্বে নায়লা তারান্নুম কাকলী আবৃত্তি করেন কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাংলাদেশ’ কবিতাটি, শিমুল মুস্তাফা আবৃত্তি করেন সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন। শেষে গারোদের নবান্ন উৎসব ‘ওয়ানগালা’র ঐতিহ্য পরিবেশন করে নৃত্য সংগঠন পরিবেশন করেন আচিকের শিল্পীরা। পরে চারুকলা অনুষদ থেকে বিভিন্ন লোকজ অনুষঙ্গ নিয়ে এক শোভাযাত্রা বের করে নবান্নোৎসব উদযাপন পর্ষদ। শোভাযাত্রাটি টিএসসি মোড় ঘুরে আবার চারুকলায় এসে শেষ হয়।
শোভাযাত্রা শেষে চারুকলার বকুলতলায় চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণের শুরু হয় নবান্নের আর্ট ক্যাম্প। এতে অংশ নেন সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবদুস শাকুর শাহ, আবুল মান্নান, রেজাউন নবী, কামাল পাশা চৌধুরী, জাহিদ মোস্তফা, অশোক কর্মকার, নাসিমা তুহিনী, হিরণ¥য় দাশ, রাশেদুল হুদাসহ ২২ জন চিত্রশিল্পী। জলরং আর অ্যাক্রেলিকের ক্যানভাসে উঠে আসে গ্রামবাংলার লোকজ ঐতিহ্যের গল্প।
উৎসবে সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তির পাশাপাশি ছিল মানিকগঞ্জের চান মিয়ার দলের লাঠি খেলা, নড়াইলের নিখিল চন্দ্রের দলের পটগান, নেত্রকোনার দিলু বয়াতি ও তার দলের মহুয়ার পালা, খুলনার ধামাইল গান। ‘নবান্ন কথন’ পর্বের আলোচনায় অগ্রহায়ণের নবান্নসহ আবহমান বাংলার বিভিন্ন উৎসব যেন নগরায়ণের প্রভাবে হারিয়ে না যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান সংস্কৃতিকর্মীরা।
পহেলা অগ্রহায়ণের নবান্ন উৎসবকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আহ্বান জানিয়ে এই দিনটিতে সরকারি ছুটি ঘোষণার দাবি জানান নবান্ন উৎসবের আহ্বায়ক শাহরিয়ার সালাম। তিনি বলেন, ‘বাংলা তারিখকে কেন্দ্র করে এ উৎসব রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যাপন করা গেলে কৃষি, কৃষকের পাশাপাশি বাংলার অর্থনীতি আরো বেশি উপকৃত হবে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, হাজার বছরের চিরায়ত এই উৎসবটি নগরায়ণের প্রভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। নাগরিক তরুণরা আমাদের এই সার্বজনীন উৎসবের সঙ্গে পরিচিত নয়। গ্রামীণ পিঠাপুলি তো তারা অনেকেই চিনে না। তরুণদের শেকড়ে ফেরাতে হলে আমাদের এই গ্রামীণ উপাদানগুলো নগরে আরো বেশি করে তুলে ধরতে হবে।’ জাতীয় নবান্নোৎসব উদযাপন পর্ষদের সভাপতি লায়লা হাসান বলেন, ‘শেকড়ের উৎসবে আমরা লোকজ সংস্কৃতি উপস্থাপনের পাশাপাশি এই অস্থির সময়ে বাঙালিকে আমরা সম্প্রীতির বন্ধনে বাঁধতে চাই।’
উৎসব উদ্বোধন করে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘এই নবান্ন উৎসব একটি উদার, সার্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক উৎসব। গ্রামীণ সম্প্রদায়ের মানুষের এই উৎসব গণমানুষের উৎসব, খেটে খাওয়া মানুষের উৎসব। বাংলার দক্ষিণাঞ্চল থেকে উঠে আসা এই শিক্ষক নবান্নোৎসবে এসে শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করেন। আশ্বিন মাসকে আমাদের এলাকায় বলা হতো দারুণ আশ্বিন, এ মাসে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। গুটিকয়েক ধনাঢ্য পরিবার ছাড়া আর কারো ঘরে ধানই থাকত না। পরে আসত অগ্রহায়ণ। সবার ঘরে সোনালি আমন ধান। সে ধান সার্বজনীন।’
‘নবান্ন কথন’ পর্বে অন্যদের মধ্যে উৎসবের পৃষ্ঠপোষক ল্যাবএইড ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এ এম শামীম আলোচনায় অংশ নেন। চারুকলা অনুষদ ছাড়াও ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরেও ছিল নবান্নোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।
শিল্পকলায় নবান্নোৎসব : নবান্ন উৎসব উপলক্ষে বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির নন্দনমঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে শিল্পকলা একাডেমি। অনুষ্ঠানে সমবেত নৃত্য পর্বে দীপা খন্দকার, অনিক বোস, ফারহানা চৌধুরী বেবী, ও এম আরওয়াসেকের পরিচালনায় সমবেত নৃত্য পরিবেশন করবে শিল্পকলা একাডেমির নৃত্য দল। একক সংগীত পরিবেশন করবেন শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল, ফকির শাহাবুদ্দীন, অনিমা মুক্তি গোমেজ, অনুপমা মুক্তি ও সমীর বাউল।