বজ্রপাতের শিকার হয়েও অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশ বিমানের একটি উড়োজাহাজ। ওই সময় এয়ারবাস এ-৩৩০ নামের উড়োজাহাজটিতে ২০০ জনের ওপরে যাত্রী ছিল।
বিমানের প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা গেছে, আকাশে ১০ হাজার ফুট ওপরে থাকা অবস্থায় হঠাৎ বজ্রপাতের আঘাতে অচল হয়ে পড়ে উড়োজাহাজটির একটি ইঞ্জিন। এ অবস্থায় চরম ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাইলট এক ইঞ্জিনের ওপর ভর করে হযরত শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দরে উড়োজাহাজাটি অবতরণ করান।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও রিজেন্ট এয়ারলাইন্সের উপদেষ্টা আশিষ রায় চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘এটি বিরল এক ঘটনা। কারণ বজ্রপাত এয়ারক্রাফটকে আঘাত হানতে পারে না।
উড়োজাহাজ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো আকাশে বজ্রপাতের আঘাতকে মাথায় রেখেই মূলত এয়ারক্রাফট প্রস্তুত করে থাকে। যদি বিমানের এয়ারবাসটির ইঞ্জিন বজ্রপাতের আঘাতে নষ্ট হয়ে থাকে তাহলে বিষয়টি প্রস্তুতকারী কোম্পানিকে দ্রুত জানানো উচিত।
এ নিয়ে দ্রুত আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি গঠন করাও উচিত। ঘটনাটিতে কোনোভাবেই হালকা করে দেখা ঠিক হবে না। কারণ প্রতিনিয়ত যে কোনো এয়ারক্রাফটকে বজ্রপাত মাথায় নিয়ে আকাশে চলাফেরা করতে হয়।’
এদিকে বজ্রপাতের শিকার হয়ে এয়ারবাস-৩৩০ এর একটি ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে পড়ায় বিমানের রিয়াদ ফ্লাইট ২০ ঘণ্টা বিলম্বের শিকার হয়। কারণ ওই ফ্লাইটটি ঢাকায় ফিরে রিয়াদ যাওয়ার জন্য সিডিউল তৈরি করা ছিল।
সে হিসাবে সকাল ৭টা থেকে রিয়াদগামী যাত্রীরা হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে আটকা পড়েন। পরে তাদের রাত ৮টায় বোয়িং ৭৭৭-৩০০ উড়োজাহাজ দিয়ে রিয়াদ পাঠানো হয়।
এ ঘটনা বিমানে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। বিমান সূত্রে জানা গেছে, রোববার সিলেট থেকে ঢাকায় আসার পথে বজ্রপাতের শিকার হয় উড়োজাহাজটি। অচল উড়োজাহাজটি বর্তমানে বিমানের হ্যাঙ্গারে রাখা হয়েছে। এটি ৮ মাস আগে স্পেন থেকে লিজে আনা এয়ারবাস ৩৩০। হজযাত্রী পাঠানোর নামে বিমান কর্তৃপক্ষ চড়া দামে উড়োজাহাজটি স্পেন থেকে লিজ নেয়। যদিও পরে হজযাত্রী বহনে এ উড়োজাহাজ ব্যবহার করা হয়নি।
জানা গেছে, শনিবার সকালে উড়োজাহাজটি সিলেট থেকে ঢাকায় ফিরছিল। হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সকাল পৌনে ১০টায় অবতরণ করার আগ মুহূর্তেই প্রায় দশ হাজার ফুট ওপরে থাকাবস্থায় দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কবলে পড়ে এটি। একপর্যায়ে বজ্রপাত আঘাত হানে উড়োজাহাজটিতে। এতে উড়োজাহাজে চরম ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়।
তাৎক্ষণিকভাবে পাইলট মনিটরে একটি ইঞ্জিন অকেজো হয়ে পড়ার সংকেত পান। এরপর চরম ঝুঁকি নিয়ে ফ্লাইটটি সিলেটে অবতরণ না করে এক ইঞ্জিনে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। অবতরণের পর ক্যাপ্টেন দেখতে পান ইঞ্জিনটির বেশ ক্ষতি হয়েছে। তাৎক্ষণিক এটাকে নেয়া হয় বিমানের হ্যাঙ্গারে।
সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ইঞ্জিন মেরামত করার চেষ্টা চলে। প্রকৌশলীদের ধারণা ছিল ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মেরামত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। কিন্তু তা সারা দিনেও সম্ভব হয়নি।
বজ্রপাতে কোনো উড়োজাহাজের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা এ প্রথম বলে জানা যায়। এটি লিজের উড়োজাহাজ হওয়ায় বিমান কর্তৃপক্ষ এককভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারেনি। তবে আজকালের মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলে বিমানের জনসংযোগ শাখা সূত্রে জানা গেছে।
উড়োহাজটির কি ধরনের ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে প্রকৌশল শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘একটা ইঞ্জিন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।’
বিমান জানিয়েছে, স্পেন থেকে উড়োজাহাজটি লিজে আনায় এর রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্বও লিজ কোম্পানির। বিমান চাইলেও একক সিদ্ধান্তে এটি মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ করাতে পারবে না।
এদিকে বজ্রপাতে এয়ারবাস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনায় বিস্মিত বিমানের পাইলটরা। এ বিষয়ে রোববার সন্ধ্যায় একজন পাইলট যুগান্তরকে বলেন, ‘সাধারণত বজ্রপাতে কোনো উড়োজাহাজের ক্ষতি হওয়ার নজির খুব একটা নেই। কারণ প্রতিটি উড়োজাহাজেই বজ্রপাত নিরোধ স্ট্যাটিক ডিসচার্জ সিস্টেম থাকে।
যার কাজই হচ্ছে আকাশে বড় ধরনের ঝড়, বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ চমকানোর মতো বিপর্যয় নিরোধ করা। এ চার্জারই বজ্রপাতের বিদ্যুৎ নিষ্ক্রিয় করে। এতে উড়োজাহাজটি বড় ধরনের ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা পায়। উড়োজাহাজটিতে এ সিস্টেম ছিল কিনা তা দেখতে হবে।’
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘দুই যুগ ধরে এভিয়েশন জগতে কাজ করছি। কোনোদিন দেখিনি বজ্রপাতে এভাবে উড়োজাহাজের ইঞ্জিন নষ্ট হয়। সব উড়োজাহাজেই তো বজ্রপাত নিরোধক থাকে। এ এয়ারবাসটিতে থাকলে তো এমন সমস্যা হতো না। এছাড়া পাইলট সিলেট থেকে মাত্র ২৫ মিনিটের পথ পাড়ি দেয়ার আগে আবহাওয়া রিপোর্ট না দেখেই ফ্লাই করেছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।
বজ্রপাত এড়ানোর মতো দক্ষতা থাকলেও এভাবে ইঞ্জিন বন্ধ হতো না। কারণ আকাশে বজ্রপাত হওয়াই স্বাভাবিক। তার মধ্যে দিয়েই সব উড়োজাহাজকে ফ্লাই করতে হয়। এজন্য নির্মাতা কোম্পানিগুলো প্রতিটি জাহাজেই বিশেষ সেফটি সিস্টেম রাখে। এ এয়ারবাসটিতে কেন তা ছিল না সেটা দেখতে হবে।’