রাসূল (সা.) তাঁর জীবনের একাংশ কাটিয়েছেন মক্কায়, এবং অন্য অংশ কাটিয়েছেন মদীনায়। নবুওতপ্রাপ্তির পর তাঁর মক্কী ও মাদানী উভয় জীবনপর্বেই বিভিন্ন জায়গায় ও সময়ে আল কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। শহরে, গ্রামে, পাহাড়ে, পাহাড়েরর পাদদেশে, উপত্যকায়, রাতে ও দিনে, শীত ও গ্রীষ্মে, ঘরে ও সফরে, যুদ্ধকালীন ও শান্তিকালীন অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর কোরআন নাজিল হয়েছে।
নবুয়ত ঊষাকাল মক্কায় যখন কুরআন নাজিল হয়েছে, তখন মুসলমানদের সংখ্যা ছিল অতি অল্প, আর মুশরিকরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। আল কোরআন এ পর্যায়ে মুমিনদের অন্তরাত্মা সংশোধন , তাদের ঈমানে দৃঢ়তা সৃষ্টি, তাদের চিন্তাচেতনা পরিশুদ্ধকরণের জন্য যে পদ্ধতি খেতাব অধিক উপযোগী, তা ব্যবহার করে তাদের খেতাব করেছে। এর বিপরীতে সত্য গ্রহণের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মুশরিকদের আহ্বান জানানো, তাদের বাতিল বিশ্বাসসমূহের অসারতা তুলে ধরা, যুক্তির মাধ্যমে তাদের নানা সন্দেহ ও অলীক ধারণাগুলো রদ করা, পরকালীন আযাব ও ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কে তদের হুঁশিয়ার করে দেয়ার জন্য মুশরিকদের খেতাবের জন্য যে ধরনের পদ্ধতির প্রয়োজন আল কুরআন তার ভাষায় ও বিষয়বস্তু চয়নে তা সর্বশীষ পর্যায়ে ব্যবহার করেছে।
এরপর যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় হিজরত করে গেলেন মুহাজির ও আনসারগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব-বন্ধন কায়েম করলেন, তখন শুরু হলো নতুন এক পর্ব, যা মাদানী পর্ব থেকে ভিন্ন। এবার আল-কোরআনের সম্ভোধনের প্রাথমিক পাত্র হলো মুসলিম সম্প্রদায় যারা স্বাধীন পরিবেশে ইতোমধ্যেই বসবাস করতে শুরু করেছেন, যাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈত জীবনকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালনার জন্য প্রয়োজন রয়েছে সুসংহত বিধানাবলির। অতএব মাদানী কোরআনের খেতাব পদ্ধতি ও বিষয়বস্তুতে আনা হয়েছে পরিবর্তন তাওহীদ, আখেরাত ও রিসালতের প্রতি পূর্বের ন্যায় গুরুত্বারোপ অব্যাহত রেখে। আল কোরআনের বাণীর মর্ম উদ্ধারের ক্ষেত্রে যেহেতু নুযূলে কুরআনের স্থান ও কাল-বিষয়ক জ্ঞানের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, অতএব আলেমগণ বিষয়টিকে খুব গুরুত্বসহ নিয়েছেন এবং জ্ঞানগবেষণার সর্বোচ্চ মানদ- প্রয়োগ করে তাঁরা, কুরানিক খেতাবের নির্দেশ বিষয়ে সঠিক সঠিক জ্ঞান লাভের েেত্র যেহেতু আল কোরআন নাজিল হওয়ার স্থান ও কাল সম্পর্কে ধারণা থাকাটা উপকারি আল কুরআন বিশেষজ্ঞগণ মক্কী ও মাদানী নির্ধারণে অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁরা প্রতিটি আয়াত ও সূরার ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। উদ্দেশ্য ছিল আল কুরআন নাজিল হওয়ার ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে তা বোঝার চেষ্টা করা। এ ক্ষেত্রে তাঁরা নাজিল হওয়ার স্থান বা কালের বিচারেই কেবল তাঁরা অনুসন্ধানকর্ম চালাননি, এর সঙ্গে বরং যোগ করেছেন নাজিল হওয়ার স্থান-কাল ও বক্তব্যের ধরণ-ধারণ নিরীা করে দেখার প্রক্রিয়া। মক্কী ও মাদানী নির্ধারণে, বলতে হবে, এটা ছিল জ্ঞান গবেষণাগত নিখুঁত মানদ-ের অনুসরণ।
মক্কী ও মাদানী সুরা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মুফাসসিরগণ বা কোরআন গবেষকগণ যেসব আলোচ্য বিষয়গুলোকে নির্ণিত কেরেছেন সেগুলো হলো- ১- যা মক্কায় নাজিল হয়েছে। ২- যা মদীনায় নাজিল হয়েছে। ৩- যেসব আয়াতের মক্কী ও মাদানী নির্ধারণের ক্ষেত্রে মতানৈক্য রয়েছে। ৪- মাদানী সূরাসমূহে মক্কী আয়াত। ৫- মক্কী সূরাসমূহে মাদানী আয়াত। ৬-যা মক্কায় নাজিল হয়েছে অথচ তা মাদানীর হুকুমভুক্ত। ৭-যা মদীনায় নাজিল হয়েছে অথচ তা মক্কীর হুকুমভুক্ত। ৮-মাদানী কোরআন-অংশে যা মক্কী কোরআন-অংশের সদৃশ। ৯-মক্কী কোরআন-অংশে যা মাদানী কোরআন-অংশের সদৃশ। ১০- যা মক্কা থেকে মদীনায় বহন করে নেয়া হয়েছে। ১১- যা মদীনা থেকে মক্কায় বহন করে নেয়া হয়েছে। ১২-যা রাতে নাজিল হয়েছে এবং যা দিনে নাজিল হয়েছে। ১৩-যা গ্রীষ্মে এবং যা শীতে নাজিল হয়েছে। ১৪-যা মুকীম অবস্থায় নাজিল হয়েছে এবং যা মুসাফির অবস্থায় নাজিল হয়েছে।
মদীনায় নাজিল হওয়া সূরাসমূহ : এ ক্ষেত্রে অধিক বিশুদ্ধ অভিমত হলো যে মাদানী সূরার সংখ্যা ২০টি। আর তা হলো নিম্নরূপ ১-আল-বাকারা। ২-আলে-ইমরান। ৩-আন-নিসা। ৪-আল-মায়েদা । ৫-আল-আনফাল । ৬-আত-তাওবা । ৭-আন-নূর। ৮-আল-আহযাব। ৯-মুহাম্মদ। ১০- আল-ফাতহ। ১১-আল-হুজুরাত। ১২-আল-হাদীদ। ১৩-আল-মুজাদালা। ১৪-আল-হাশর। ১৫-আল-মুমতাহিনা। ১৬-আল-জুমআ। ১৭-আল-মুনাফিকুন। ১৮-আত-তালাক। ১৯-আত-তাহরীম।২০-আন-নাসর যেসব সূরার ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে
১-আল-ফাতিহা। ২-আর-রাদ। ৩-আর-রাহমান। ৪-আস-সাফ। ৫-আত-তাগাবুন। ৬-আত-তাৎফীফ। ৭-আল-কাদর। ৮-আল-বাইয়িনাহ। ৯-আয্-যালযালাহ। ১০-আল-ইখলাস। ১১-আল-ফালাক। ১২-আন-নাস এ ছাড়া অন্য যে-সব সূরা রয়েছে তা মক্কী। মক্কী সূরার সংখ্যা হলো ৮২টি। অতএব আল কুরআনের মোট সূরা সংখ্যা হলো ১১৪টি।