যুগ যুগ সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় ইসলামের বিধিবিধান পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তাবলীগ জামাত অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। আমজনগণকে কুরআন হাদিসের সঠিক বানী শিক্ষা দিচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বিভক্ত করার চেষ্টা চলছে। তাবলীগ জামাতের সংকট সম্পর্কে বিশিষ্ট আলেমরা বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। মতামত তুলে ধরেছেন, মাহমুদুল হক জালীস।
তাবলীগের নেতৃত্বকে ইলিয়াস রহ. এর প্রক্রিয়ায় ফিরে যেতে হবে : মুসা আল হাফিজ
বিশিষ্ট আলেম ও লেখক মুসা আল হাফিজ বলেন, তাবলিগে চলমান সঙ্কটের জন্য দায়ী সেখানকার এক দৃষ্টিভঙ্গি। প্রচলিত তাবলিগই দ্বীনী কাজ, দাওয়াতটাই আসল, তাকে কেন্দ্র করেই সবকিছুর বিচার করার একটি প্রবণতা ইদানীং শক্তি লাভ করেছে। তা যদি সাধারণ পর্যায়ে হতো, সমস্যা গুরুতর হতো না। তা বরং নেতৃপর্যায়ে লক্ষ্য করা গেছে। সে দৃষ্টিভঙ্গির অনুকূলে বিভিন্ন বক্তব্য এসেছে উচ্চপর্যায় থেকে। ফলত দেওবন্দ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। সঙ্কট ছোট নয়। কোটি কোটি মানুষ এ তাবলিগের প্রক্রিয়ায় জড়িত। তারা যদি কোনো ভিন্নরকম কোনো দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত বা চালিত হয়, তাহলে মূলধারার আলেমদের সাথে দূরত্ব বাড়বে। বিভ্রান্তির জায়গা প্রশস্ত হবে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এক সময় তা নতুন ফেরকার রূপ নিতে পারে। এমতাবস্থায় দাওয়াতের যে প্রয়াস চলমান, তা ব্যাহত হবে, নেতিয়ে পড়বে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তাবলিগী নেতৃত্বকে ইলিয়াস রহ, এর প্রক্রিয়ায় ফিরে যেতে হবে। আপন পদ্ধতি নয়, দ্বীনের নির্দেশনাই ছিলো তার মূলনীতি। তিনি পরামর্শ ও উলামার নির্দেশনাকে অবলম্বন করতেন। এর কমতি বা অনুপস্থিতি সমস্যা বাড়াবে, কমাবে না।
অপরদিকে কোনো কোনো আলেম হুংকারের মতো করে প্রতিবাদী আওয়াজ তুলেছেন। সামাজিক মাধ্যমে তাবলিগের সমালোচনা চলছে তীব্রভাবে। এটা সমাধানের কোনো পথ নয়। তাবলিগে একটি অংশ যদি নিজেদের মতকেই অবলম্বন করে, সেটা থাকতে পারে। কিন্তু বড় একটি অংশ এর সাথে নেই। সে অংশটা প্রতিনিধিত্বশীল আলেমদের সাথে পেলে সমস্যাগুলো সমাধানে আরো শক্তিমান হতো। যে সব জায়গায় আপত্তি উঠেছে, তা নিরসনে তাবলিগের ভেতরে ও বাইরে ইতিবাচকভাবে আলেমদের সক্রিয় হতে হবে। অংশগ্রহণ, সংলাপ ও আলোচনা হুমকি ও বিভক্তির চেয়ে অধিক ফলপ্রসূ হবে, মনে করি।
তাবলীগ নিয়ে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে : ওয়ালি উল্লাহ আরমান
বিশিষ্ট ইসলামি রাজনীতিবিদ মাওলানা ওয়ালি উল্লাহ আরমান বলেন, তাবলীগ জামাত দ্বীনের কল্যাণে নিঃস্বার্থ কাজ করছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু ইতোপূর্বে কাকরাইল মারকাজ কিংবা টঙ্গী ময়দানে কখনো কর্তৃত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। কয়েকবছর ধরে তাদের মধ্যে থেকেই এর প্রতিবাদ উঠেছে। মারামারি, মারকাজ এবং বিভিন্ন মহল্লার মসজিদ থেকে বের করে দেয়ার পাশাপাশি পুলিশে ধরিয়েও দেয়া হয়েছে। কাকরাইলে আহলে শুরাদের ডিঙ্গিয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাবলীগের উসূল পরিপন্থি অনেকটা চরদখল পদ্ধতিতে মারকাজে কর্তৃত্ব করেছেন। কয়েকবছর যাবত ওলামায়ে কেরাম এটা নিরসনে বারবার বৈঠকে বসেছেন। কিন্তু মারকাজে ঘাপটি মেরে থাকা চিহ্নিত মহল থোড়াই পরোয়া করেছে। সুতরাং এটা তো দিবালোকের মতো পরিস্কার যে, গুটিকয় ব্যক্তির কারণেই এই সমস্যার উৎপত্তি। এর প্রভাব এখনো ঢালাওভাবে সাধারণ তাবলীগিদের উপর না পড়লেও তরুণদের মধ্যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তাদের অনেককে বিদ্যমান সংকট নিরসনে এগিয়ে আসা ওলামায়ে কেরামের ব্যাপারে এমন মেসেজ দেয়া হচ্ছে যে, আলেমরা তাবলীগের কর্তৃত্ব নিতে চায়। বিভ্রান্তি ছড়াতে ম্যান টু ম্যান এবং অনলাইনে নামে-বেনামে ঘৃণা-বিদ্বেষে ভরা বক্তব্য প্রচারের মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। এতে অনেকেই বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে। এর ক্ষতি সুদূরপ্রসারী। সবচে বড় ক্ষতি হচ্ছে, ওলামায়ে কেরাম দ্বীন তথা কুরআন-হাদীসের ধারকবাহক। দ্বীনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দায়িত্ব একমাত্র তাদের, যারা দ্বীনের সঠিক জ্ঞান রাখে। বলাইবাহুল্য সেই জ্ঞান আলেমরাই রাখেন। এখন আলেমদেরকে তাবলীগ থেকে দূরে সরানোর মানেই হলো, সাধারণ মুসলমানের ঈমান, আমল, আকীদাকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া।
এই সংকট থেকে উত্তরণে নিজামুদ্দীন মারকাজ পরিচালনায় দারুল উলূম দেওবন্দের সিদ্ধান্ত, মতামত এবং রায়ের পরিপূর্ণ অনুসরণ ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই। তথা যাদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং হঠকারিতায় এই সংকট জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে তাদের নিজেদের পক্ষ থেকেই কর্তৃত্ববাদী মনোবৃত্তি ছেড়ে শুরা এবং ওলামায়ে কেরামের পরামর্শ পরিপূর্ণরূপে অনুসরণ করা।
তাবলীগে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে : মুহাম্মদ মুহিউদ্দিন কাসেমী
আলেম লেখক মুহাম্মদ মুহিউদ্দিন কাসেমী বলেন, তাবলিগ জামাতের সঙ্কটের মূল কারণ মাওলানা সা’দ সাহেবকে কেন্দ্র করে। একটি পক্ষ তাঁর পক্ষ নিয়েছে। তাঁর বিতর্কিত সব বক্তব্য মেনে নিচ্ছে। প্রতিবাদ করছে না। সাদ সাহেবের বয়ানের যেসব বিষয় দারুল উলুম দেওবন্দসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মেনে নিতে পারেনি, সেগুলো নিয়েই মূলত ঝামেলা শুরু হয়। যদিও আরও আগে থেকেই আমির ও শুরাকে কেন্দ্র করেও সমস্যার সূত্রপাত হয়। কিন্তু সেগুলো আমার দৃষ্টিকোণ থেকে তেমন মারাত্মক কিছু না। কারণ, তাবলিগে তো আমির হওয়ার প্রথা আগে ছিল। এখনও যদি পরামর্শ সাপেক্ষে আবার আমিরি পদ্ধতি চালু হয়, তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু কোনো পরামর্শ ছাড়া কেউ যদি নিজেকে আমির হিসেবে ঘোষণা করে তাহলে এটি দুঃখজনক ও নিন্দনীয় বিষয়। বাংলাদেশের তাবলীগে ঝামেলা হওয়ার এটিই মূল উৎস। আরেকটি কারণ সম্ভবত এই, তাবলিগের আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছ কোনো হিসাব নেই। দেখুন একসময় হিসাবপত্রের তেমন কোনো দরকার ছিল না। রাসূল সা. ও সাহাবায়ে কেরামও মানুষের কাছ থেকে চাঁদা নিয়েছে, কালেকশন করেছেন; কিন্তু রসিদবই ও ভাউচারের কোনো বিষয় ছিল না। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে সব প্রতিষ্ঠানে টাকা উত্তোলনের জন্য রসিদ ও ব্যয়ের জন্য ভাউচারের ব্যবস্থা রয়েছে। দুর্নীতি দূর করার ও স্বচ্ছতা আনয়নের এটি একটি বাহ্যিক ব্যবস্থা। জবাবদিহিতার একটি মাধ্যম। এই ব্যবস্থা তাবলিগে নেই। কোটি কোটি টাকার কোনো হিসাব নেই। কানকথা শুনেছি, অনেকে টাকা আত্মসাৎ করে।
তৃতীয় আরেকটি কারণ হল, শরীয়তের উসুল, মেজাজ ও মাকাসিদ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখে এমন আলেমদের সম্পৃক্ততা না থাকা। শুধু বয়ান ও বক্তৃতা করলেই ভালো আলেম না। বয়ান করতে করতে অধ্যয়ন ও গবেষণার সময় পাওয়া মুশকিল। তাই তারা অনেক সময় শরীয়তের ভুল ব্যাখ্যা করে বসেন, ভুল ফতোয়া দিয়ে দেন। আমাদের দেশের শুরায় উসুলবিদ বিজ্ঞ আলেমগণ থাকলে ঝামেলা হতো না বা কম হতো। শুধু আলেমদের নামকাওয়াস্তে রাখলেই হবে না, তাঁদেও সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। স্বাধীনভাবে মত দেওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এই সঙ্কট ও সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান না হলে আমজনতার ওপর প্রভাব পড়বে নিশ্চিত। এখন মিডিয়ার যুগ। নেটের যুগ। কোনো খবর চেপে যাওয়া যায় না। দিল্লি ও দেওবন্দে কী হচ্ছে আমরা সাথে সাথেই জানতে পারছি। আফ্রিকার বয়ানও লাইভ শুনতে পাচ্ছি। তবে একদম সাধারণ জনগণ যারা, তারা এসব বিষয় জানবে না হয়তো। তাদের জানানোও উচিত না। উসুলবিদ ও প্রাজ্ঞ আলেমদের নিয়ে শুরা গঠন করা। কেবল বয়ানে পারদর্শী আলেমদের রাখলে হবে না। মানুষের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারে। একই সঙ্গে থাকলে মনোমালিন্য ও মতের মিল হওয়াই স্বাভাবিক। সংসারেও তো ঝামেলা হয়। তবে সবকিছুর সমাধান মাশওয়ারার মাধ্যমে হওয়া চাই। তাবলিগওয়ালারাই তো মাশওয়ারার গুরুত্ব বর্ণনা করে থাকে; সুতরাং নিজেরা এর ওপর আমল করা দরকার। অস্ত্র ও ক্ষমতা দিয়ে সমাধান হবে না। যারা এমন কিছু করতে চায় তাদেরকে চরম বয়কট করতে হবে।