উম্মুল মুমিনীন হজরত সাওদা বিনতে জামআ (রা.) এর জীবনগল্প
5, November, 2017, 4:31:31:PM
হজরত খাদিজা (রা.) এর মৃত্যুতে রাসুল (সা.) খুবই ভেঙ্গে পড়েন। সবসময় তিনি ভারাক্রান্ত মনে দিন যাপন করতেন। এই অবস্থা দেখে নবীজির আত্মীয়-স্বজন খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। এই সময় হজরত উসমান ইবনে মাযউন (রা.) এর স্ত্রী হজরত খাওলা বিনতে হাকীম (রা.) নবীজির খেদমতে হাজির হন। রাসুল (সা.) হজরত খাদিজা (রা.) এর বিয়োগে অত্যন্ত ব্যথিত ছিলেন। তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে হজরত খাওলা বিনতে হাকীম (রা.) নবীজিকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করার পরামর্শ দেন। হজরত খাদিজা (রা.) সংসারের যাবতীয় কাজ ও ছেলে-মেয়েদের দেখাশুনা করতেন। সুখে-দুঃখে সকল কাজে রাসুল (সা.) এর সহযোগিতা করতেন। তাই হজরত খাদিজা ( রা.) এর ইন্তেকালে সংসারটা যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো। এদিকে ছেলে-মেয়েদের দেখাশুনা করার মতো কেউ নেই। তাই হুজুর ( সা.) সম্মতি দিলেন। প্রিয়নবীর সম্মতি পেয়ে হজরত খাওলা বিনতে হাকীম হজরত সাওদা (রা.) এর পিতার কাছে গিয়ে জানালেন, তিনি নবীজির সঙ্গে হজরত সাওদা (রা.) এর বিয়ের পয়গাম নিয়ে এসেছেন। সব কথা শুনে সাওদার পিতা খুশি হলেন। কারণ, রাসুল (সা.) শুধু নিজেই শ্রেষ্ঠ মানুষ, শ্রেষ্ঠ পয়গম্বর ছিলেন না বরং তার বংশও ছিলো আরবের শ্রেষ্ঠ বংশ। তিনি কন্যার মতামত নিয়ে রাজি হয়ে গেলেন। বিবাহের পূর্বের কাজ ঠিক হলে নবুয়তের দশম বছর শাওয়াল মাসে নবীজির সঙ্গে হজরত সাওদা (রা.) এর বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই বিয়ে চারশত দিরহাম মোহরানা ধার্য করে বিবাহ কার্য শেষ হয়। উম্মুল মুমিনীন হজরত সাওদা (রা.) এর পিতার নাম হজরত জামআ ইবনে কায়েস ইবনে আবদে শামস (রা.)। আর মাতার নাম হজরত শমুস বিনতে কায়েস ইবনে জায়েদ (রা.)। হজরত সাওদা (রা.)- এর মাতা-পিতা মক্কার অধিবাসী ছিলেন। রাসুল (সা.)- এর সঙ্গে বিবাহের পূর্বে হজরত সাওদা বিনতে জামআ (রা.) ছিলেন বিধবা। তার প্রথম বিবাহ হয় চাচাত ভাই হজরত সাকরান ইবনে আমর (রা.)- এর সঙ্গে। ইসলামের প্রাথমিক যুগেই হজরত সাওদা (রা.) এবং হজরত সাকরান (রা) একই সঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারপর তা পৌত্তলিকদের নির্যাতন থেকে বাঁচবার জন্য আবিসিনিয়ায় পালিয়ে যান। আবিসিনিয়া থেকে ফিরে এসে হজরত সাকরান (রা.) ইন্তেকাল করেন। আর স্ত্রীকের রেখে যান অত্যন্ত অসহায় অবস্থায়।
রাসুল (সা.)- এর সঙ্গে বিবাহের পর হজরত সাওদা বিনতে জামআ (রা.) নবীজির সংসার অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে দেখাশুনা করতেন। হজরত খাদিজা (রা.)- এর ইন্তেকালে নবী সংসারে যে এলোমেলো অবস্থা সৃষ্টি হয়, তিনি তা আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসেন। পুরো সংসারটা তিনি একাই দেখাশুনা করতেন। হজরত খাদিজা (রা.) এবং নবীজির চাচা আবু তালেবের মৃত্যুতে মক্কার কাফেররা রাসুল (সা.) এর সঙ্গে খুবই নিষ্ঠুর ব্যবহার করতো। হজরত সাওদা (রা.) তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতেন এবং নবীজির দুঃখ মোচনে সবসময় যতœবান হতেন। তিনি নবী কন্যা হজরত উম্মে কুলসুম (রা.) ও হজরত ফাতেমা (রা.) কে সর্বদা হাসি আনন্দে রাখার চেষ্টা করতেন। কারণ, তারা ছিলেন বয়সে খুব ছোট। মা হারা হয়ে তারা কান্নাকাটি করে মন খারাপ করে এক কোণে বসে থাকতেন। তাই তিনি সবসময় তাদের দেখাশুনা করতেন। রাসুল (সা.)- এর দুই পুত্র আবুল কাশেম ও আবদুল্লাহ ছোটকালেই ইন্তেকাল করেন। আর হজরত জয়নব (রা.) এবং হজরত রুকাইয়া (রা.) বিয়ের পর স্বামীগৃহে চলে যান।
উম্মুল মুমিনীন হজরত সাওদা (রা.) কে বিবাহ করার মাত্র পনের দিন পর প্রিয় নবীজি (সা.) হজরত আয়শা (রা.) কে বিবাহ করেন। তখন তাঁর বিয়স ছিল ছয়। বিবাহের পর হজরত আয়শা (রা.) রাসুল (সা.)- এর ঘরে আসার পূর্বে তিন বছর পিতৃগৃহে ছিলেন। এই তিন বছর হজরত সাওদা (রা.) রাসুল (সা.)- এর একমাত্র স্ত্রী হিসেবে সংসার দেখাশুনা করেন। হজরত আয়শা (রা.)- এর বয়স ছিলো খুবই অল্প, তাই তিনি নবীজির সংসারে আসার পর সংসার্র কাজকর্ম কিছুই বুঝতেন না। হজরত সাওদা (রা.) তাকে সাংসারিক ব্যাপারে অনেক পরামর্শ ও সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। হজরত সাওদা (রা.) ও হজরত আয়শা (রা.) এর বয়সের মধ্যে বলতে গেলে আকাশ-পাতাল তফাৎ ছিলো। তবুও সপতœী সুলভ সম্পর্কের কারণে তাদের মধ্যে সরস মধুর ব্যবহার ও হাসি-ঠাট্টার অবতারণা হত। যাতে রাসুল (সা.)- এর সংসারে অনাবিল বেহেশতি খুশির ধারা নেমে আসতো। তাই হজরত সাওদা (রা.) সম্পর্কে হজরত আয়শা বলেছেন, ‘আমি কেবল একজন মহিলার কথাই জানি, যার অন্তরে হিংসার ছোঁয়া মোটেই পড়েনি। আর তিনি হলেন, সাওদা। কতই না ভালো হত যদি আমার অন্তর তার দেহে স্থান লাভ করতো।’ নবীজির পবিত্র সহচর্য লাভের ফলে হজরত সাওদা (রা.)- এর মাঝে উদারতা এবং দানশীলতার অপরূপ সমন্বয় ঘটেছিলো। নবীজি (সা.)- এর মত হজরত সাওদা (রা.)- এর মনও দয়ায় ভরপুর ছিলো।
রাসুল (সা.)- এর ওফাতের পর, তখন হজরত ওমর (রা.)- এর শাসনকাল। একদিন হজরত ওমর (রা.) এক বাহককে দিয়ে হজরত সাওদা (রা.)- এর জন্য একটি থলে পাঠালেন। থলেতে ছিলো দিরহামে ভরা। তিনি বাহককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘থলেতে কি আছে?’ উত্তরে বাহক বললেন, ‘দিরহাম’। হজরত সাওদা (রা.) বললেন, থলেটি দেখতে ঠিক খেজুরের থলের মতো। খেজুরের থলেতে কি দিরহাম থাকতে পারে? এ কথা বলে তিনি দিরহামগুলো খেজুরের মতো সব দিরহাম অভাবগ্রস্তদের মাঝে বিলিয়ে দিলেন। তিনি নবীজির খুব অনুগত ছিলেন এবং তার কথামত সব কাজ করতেন। হজরত সাওদা (রা.) অল্প কথা বলতেন, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি-সম্পন্না ছিলেন। তবে তার মেজাজ ছিলো একটু কড়া। কোনোকোনো সময় মামুলি ব্যাপারে রাগ করে বসতেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবার তার মধ্যে হাসি কৌতুকের পবিত্র ফোয়ারা বয়ে যেতো। অনেক সময় তিনি বিভিন্ন কথা দিয়ে নবীজিকে হাসাতেন। একবার তিনি রাসুল (সা.) কে বলেন, গতরাতে আমি আপনার পেছনে নামাজ পড়েছি, কিন্তু আপনি রুকুতে এতো দেরী করেছেন যে আমার নাক ফেটে যেনো রক্ত না বের হয়, সে জন্য আমি নাক চেপে ধরেছিলাম। হুজুর (সা.) তার কথা শুনে মৃদু হাসলেন।
হজরত সাওদা (রা.)- এর পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত এক পুত্রসন্তান ছিলেন। নাম তার আবদুর রহমান। হজরত ওমর (রা.)- এর শাসনামলে সালাতার যুদ্ধে কাফেরদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহিদ হন। হজরত সাওদা (রা.) পাঁচটি হাদিস বর্ণনা করেন। উম্মুল মুমিনীন হজরত সাওদা বিনতে জামআ (রা.) ২২ হিজরী সনে হজরত ওমর (রা.)- এর খেলাফতের শেষের দিকে ইন্তেকাল করেন। তাকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়। লেখক: শিক্ষক, মাদরাসা বাইতুন নূর ঢাকা।