‘‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে। অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে...। ধরায় যখন দাও না ধরা হৃদয় তখন তোমায় ভরা, এখন তোমার আপন আলোয় তোমায় চাহি রে...।’’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছিলেন বিখ্যাত গানটি। সেই গান বাস্তবে রূপ পেয়েছে জন্মান্ধ সুবোধ বর্মণের পথ চলায়।
জন্মান্ধ সুবোধ বর্মণ হলেন টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার কাকড়াজান ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের মৃত নিশিকান্ত বর্মনের ছেলে।
দোতারায় সেরা বাদক সুবোধ বর্মন (৪৮)। তিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। জন্মগতভাবেই তার দু’টি চোখই অন্ধ। জন্মান্ধ আর প্রতিবন্ধী দুনিয়ায় জন্মের পর থেকে পৃথিবীর আলো, রঙরূপ তার চর্ম চোখে ধরা পড়েনি কখনও। পরিচিতদের কণ্ঠশুনে চিনতে পারেন। গ্রামের বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি অসংখ্য জারি-সারি, পালা ও বাউল গান রপ্ত করেছেন। একটি গান ২/১ একবার শুনেই চেষ্টা করেন গুণগুণ করে গাইতে পারে। পরে নির্দিষ্ট সুরে গেয়ে থাকেন সেসব গানগুলো। আশপাশের হাট-বাজারগুলোতে দোতারা বাজিয়ে সেই গান পরিবেশন করেন। গানের আসরের শুরুতেই সুবোধ বর্মণের প্রথমেই উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশ্যে বয়ান থাকে বাবারা-আমি ক্যানভাসর না, কোনো ওষুধ-পাতি, তাবিজ-কবজ বেচি না, আমি গান গাই...। তার সুরেলা কণ্ঠে শোভা পাওয়া বাউল ও লালন সঙ্গীতের মন মাতানো গানগুলো। তার সুরে বিমুগ্ধ দর্শক-শ্রোতাদের দেওয়া টাকায় চলে সংসার। দোতারাই তার জীবনের সঙ্গী হয়েছে। প্রখ্যাত বয়াতী সুনিল সরকার ছিলেন তার গানের ওস্তাদ। সুখ-দুঃখ, আনন্দ, বিনোদন ও জীবিকার সঙ্গী হলো তার এ দোতারা। হারমোনিয়াম বাদকেও সেরা সুবোধ। গান গাওয়ার সামান্য আয়ে চলে তার সংসার। জন্মের পর থেকে জন্মান্ধ সুবোধকে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ এমন অভাবের তাড়নায় প্রতিনিয়ত মানবেতর দিন কাটাতে হচ্ছে। এক সন্তানের জনক জন্মান্ধ সুবোধের এভাবেই চলছে ৪৮ বছর। ছেলে সিন্ধু বর্মন (১৩) স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে লেখাপড়া করলেও বাবাকে সহযোগিতা করতে গিয়ে তা এখন বন্ধ হওয়ার পথে। অভাবের তাড়নায় স্ত্রী কাঞ্চনমালা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। মা-বাবা একসঙ্গে দু’জনই অসুস্থ হয়ে পড়লে ছেলে সিন্ধু বর্মনকে অন্যের কাছে হাত পাততে (ভিক্ষা) হয়।
সুবোধ বর্তমানে টিবি (যক্ষ্মা) রোগে আক্রান্ত হওয়ায় এখন আগের মতো গান গাইতে পারেন না। সামান্য পরিশ্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। দূরের কোনো হাট-বাজারেও যাইতে পারে না। মাসে ৬০০ টাকা প্রতিবন্ধী ভাতা পেলেও কষ্টে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন জন্মান্ধ সুবোধ ও তার পরিবার। এ প্রসঙ্গে কাকড়াজান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তারিকুল ইসলাম বিদ্যুৎ বলেন, ‘সুবোধ বর্মণের বিষয়টি আমার জানা ছিল না। খোঁজ নিয়ে ওই পরিবারকে ব্যক্তিগতভাবে ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে বলেও যোগ করেন তিনি।’
স্থানীয় কৃষ্ণ কলি মন্দিরের সভাপতি হিরেন্দ্র বর্মন বলেন, সুবোধ পৈত্রিক সূত্রে কিছু জমি প্রাপ্ত হলেও অভাবের তাড়নায় তা বিভিন্ন সময়ে বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন তার শুধু একটি বসতভিটা রয়েছে।
সুবোধের ভাতিজা হেমন্ত বর্মন সুইট জানান, ছেলে সিন্ধুকে নিয়েই তার বিভিন্ন হাট-বাজারে যেতে হয়। ছেলে সিন্ধু ও লাঠিই তার চলাচলের একমাত্র ভরসা। সিন্ধু তার বাবাকে সহযোগিতা করলে উপার্জন বাড়ে, চলে সংসার।
স্ত্রী কাঞ্চনমালা জানান, সুবোধ অসুস্থ হয়ে পড়লে বাড়িতে চুলা জ্বলে না। তখন অর্ধাহারে কাটে দিন। বাধ্য হয়ে সংসার চালাতে অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে হয়।
সুবোধ বর্মণ ইত্তেফাকের এ প্রতিনিধিকে জানান, ‘বিভিন্ন হাট-বাজারে গান গাই; গান শুনে লোকেরা খুশী হয়ে ৫/১০ টাকা দেন। তা দিয়ে সংসার চালাই। আমি পৃথিবীর আলো থেকে বঞ্চিত হলেও ছেলেটাকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা আমার এই অন্ধ জীবনের বড় স্বপ্ন আছে বাবা...।’ বলতেই... তার গলা থেকে মৃদু স্বরে গানের সুর ভেসে আসে... অন্ধজনে দেহ আলো মৃতজনে দেহ প্রাণ...।