গত ২৬ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার। উদ্বোধনের পর মাসাধিককাল পার হলেও নানা অজুহাতে কোনো সংস্থাই এই স্থাপনাটির দায়িত্ব নেয়নি। এখন দায়িত্ব নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এই দীর্ঘ সময় দায়িত্ব বুঝে না নেওয়ায় পুরো ফ্লাইওভার পরিণত হয়েছে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে। চারদিকে ধুলোবালিতে একাকার হয়ে যায়। ফ্লাইওভারটি চালু হওয়ার পরও যানজট দূর হয়নি। আগে যেখানে শুধু নিচে যানজট লাগত, এখন সেখানে উপর-নিচজুড়ে ভয়াবহ যানজট লেগে থাকছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফ্লাইওভাটির একাংশ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি), আরেকাংশ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) পড়েছে। প্রথমে ফ্লাইওভারটি দক্ষিণ সিটিকেই বুঝিয়ে দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। পরে নিজ নিজ অংশ দুই সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলছেন প্রকল্প পরিচালক।
প্রকল্প পরিচালক ও এলজিইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুশান্ত কুমার পাল জানিয়েছেন, উদ্বোধনের পর থেকেই ফ্লাইওভারটি দুই সিটি করপোরেশনের কাছে দ্রুত হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখন শুধু ফ্লাইওভার ব্যবহারের ম্যানুয়েল তৈরির কাজ চলছে। এরপর মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এলাকা অনুযায়ী দুই সিটি করপোরেশনের কাছে ফ্লাইওভারের দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হবে।
এদিকে ফ্লাইওভারটি তিন ভাগে ভাগ করে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথম অংশ সাতরাস্তা-মগবাজার-হলি ফ্যামিলি পর্যন্ত। দ্বিতীয় অংশ বাংলামোটর-মগবাজার-মৌচাক পর্যন্ত। তৃতীয়াংশ শান্তিনগর-মালিবাগ-কাকরাইল-রাজারবাগ পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়। তিন দফায় খুললেও প্রথম ও দ্বিতীয় অংশের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। ময়লা-আবর্জনা ও বালুকণাতে একাকার হয়ে গেছে। একই অবস্থায় রূপ নিচ্ছে সর্বশেষ খুলে দেওয়া শান্তিনগর-মালিবাগ-কাকরাইল-রাজরবাগ অংশেও। তবে রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস বাংলাদেশ সফরে আসায় গত শনিবার ফ্লাইওভারটি পরিস্কার করা হয়।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারটির দায়িত্ব বুঝে না নেওয়ায় ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। শুধু গাড়ি চলাচলের জায়গাটুকু ছাড়া দুই পাশের বাকি অংশে চিপস ও বিস্কুটের প্যাকেট, পলিথিন, কলার খোসাসহ নানা ধরনের প্যাকেট পড়ে আছে। এ ছাড়া ধুলাবালিতে একাকার হয়ে আছে। প্রাইভেট গাড়ি ও গণপরিবহন দ্রুত যাতায়াতের ফলে বালিকণা উড়তে থাকে।
ফ্লাইওভারের ওপরে কথা হয় পথচারী শাকিল আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, এক মাস পার হয়েছে, কিন্তু এখনো কেউ দায়িত্ব না নেওয়ায় ফ্লাইওভারটি ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। দিন দিন যে অবস্থায় পরিণত হচ্ছে, কয়দিন পর চলাচলা করা দুষ্কর হয়ে যাবে।
জানা গেছে, এর মধ্যে ফ্লাইওভারে ট্রাফিক সিগন্যাল, বাম দিকে স্টিয়ারিং, যানজট লেগে থাকা, ওঠানামার র্যাম্প জটিলতাসহ নামার লুপে যানজট লেগেই থাকছে। নকশা অনুমোদনের পর থেকেই মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নিয়ে নানা ত্রুটি দেখা দেয়। ফলে এই ফ্লাইওভার যানজট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার চালু হওয়ার আগে আশা ছিল ওই এলাকায় চলাচলের ক্ষেত্রে যানজটের ভোগান্তি থেকে এটি মুক্তি দেবে মানুষকে। কিন্তু ফ্লাইওভার চালু হওয়ার পর প্রতিনিয়ত এর উপরে-নিচে যানজট লেগে থাকায় সেই আশা হতাশায় রূপ নিচ্ছে।
গাড়িচালক, যাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান—ফ্লাইওভারে উঠলেও যানজটের কবলে পড়তে হচ্ছে, আবার নিচেও যানজট বেড়েছে। গতকাল নিউ ইস্কাটনে এসপিআরসি হাসপাতালের সামনে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে বসে ছিলেন ফার্মগেটমুখী আয়াত পরিবহনের একটি বাসের চালক আবদুুল হাই। বাসভর্তি যাত্রী নিয়ে এক জায়গায় তিনি প্রায় ২৫ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছিলেন—কখন যানজট ছাড়বে। আয়াত পরিবহনের ওই বাসের মতো আরো শত শত যানবাহন বাংলামোটর থেকে নিউ ইস্কাটন পর্যন্ত অপেক্ষা করছিল। চালক আবদুল হাই বলেন, বাংলামোটর সিগন্যাল থেকে ইস্কাটনের এসপিআরসি হাসপাতালের দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। এই রাস্তায় আমার গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা প্রায় আট বছরের। বাংলামোটর থেকে কোনো দিন এ পর্যন্ত জ্যামে পড়তে হয়নি। কিন্তু এ সপ্তাহে প্রায় দিনই এ রকম জ্যামে পড়তে হচ্ছে। আগে বাংলামোটর সিগন্যাল থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ গজ পর্যন্ত জ্যাম লাগত। কিন্তু ফ্লাইওভার চালু হওয়ার পর থেকে এই জট প্রায়ই এ রকম আকার ধারণ করে।
এই বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মো. বিলাল বলেন, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের এখনো মিডিয়ান, পার্কিং ও ট্রাফিক সিগন্যালের কিছু কাজ বাকি রয়েছে। এগুলো শেষ হলে আমরা বুঝে নেব। যানজটের বিষয়ে এই কর্মকর্তা আরো বলেন, ফ্লাইওভারে যানজট লাগে না। শুধু নামতে গিয়ে বা কোথাও সিগন্যালে পড়লে একটু যানজট লাগে। গাড়ির সংখ্যা বেশি হওয়ায় এই সমস্যাটুকু হচ্ছে। তবে এই সমস্যাটাও সমাধান হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তিনতলাবিশিষ্ট চার লেনের এই ফ্লাইওভারটির দৈর্ঘ্য ৮ দশমিক ৭ কিলোমিটার। এটি ১০ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল। ১২১৮ কোটি ৮৯ হাজার ৬৯ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এর প্রতি মিটারে খরচ হয়েছে ১৩ লাখ টাকা।
ফ্লাইওভারটির নির্মাণকাজ করা হয়েছে তিন ভাগে। প্রথম অংশ সাতরাস্তা-মগবাজার-হলি ফ্যামিলি পর্যন্ত। এই অংশটি ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ফ্লাইওভারটি উদ্বোধন করেন। এই ফ্লাইওভারটির দ্বিতীয় অংশ হলো বাংলামোটর-মগবাজার-মৌচাক পর্যন্ত। এই অংশটি যান চলাচলের জন্য গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর উন্মুক্ত করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ফ্লাইওভারটির তৃতীয় অংশ শান্তিনগর-মালিবাগ-কাকরাইল-রাজারবাগ অংশ গত ২৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করেন।