একদিনের জন্যও থামছে না রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের সঙ্গে সরকারের চুক্তি হলেও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এখনো ঢুকছে রোহিঙ্গারা।
প্রতিদিন দু-চারশ নারী-পুরুষ ও শিশু এপারে এসে আশ্রয় নিচ্ছে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে। টেকনাফের হাড়িয়াখালী ও শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে গতকালও ১৪৫ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। মাছ ধরার ট্রলারে করে মিয়ানমারের ধংখালী ও নাইক্ষ্যংদিয়া হতে আসা এই রোহিঙ্গাদেরও সন্ধ্যায় যথারীতি ক্যাম্পে পাঠিয়েছে বিজিবি। অনুপ্রবেশ বন্ধ না হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির বাস্তবায়ন কতটুকু কার্যকর হবে—তা নিয়ে সংশয় দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। মিয়ানমার সরকার নতুন আসা রোহিঙ্গাদের ধাপে ধাপে ফেরত নিতে রাজি হলেও পুরনো রোহিঙ্গার কী হবে তা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি। গত ২৩ নভেম্বর দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ও এ বছরের ২৫ আগস্টের পরে যারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে তাদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে। মিয়ানমারের হিসাবে তা হবে ৭ লাখের মতো। প্রকৃতপক্ষে গত বছর ও চলতি বছরের ঘটনায় প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এর আগের আরও দেড় থেকে দুই লাখ রোহিঙ্গাসহ মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ লাখের ওপরে। সম্পাদিত চুক্তির আলোকে ৭ লাখ নিয়ে গেলে বাকি ৮ লাখ রোহিঙ্গার কী হবে, সে ব্যাপারে বর্তমান চুক্তি শেষ হওয়ার পরে পৃথকভাবে ভাবার কথা বলছে মিয়ানমার। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উখিয়ার কুতুপালং রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ (যুগ্ম সচিব) মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘এই চুক্তিটি ইতিবাচক। তবে তা দ্রুত বাস্তবায়ন হতে হবে। উভয়পক্ষ আন্তরিক হলে তা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার যে সংখ্যাটি বা পরিমাণটি উল্লেখ বা স্বীকার করে নিচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে এটা তার চেয়ে অনেক বেশি। এটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
জানা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রথমবার পালিয়ে আসে ১৯৭৮ সালে। তখন তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি চুক্তিস্বাক্ষর হয়। এর অধীনে ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ফিরে গিয়েছিল। ১৯৯২ সালে আবার রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ওই সময় তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে আরেকটি সমঝোতা স্বাক্ষর হয়। এর অধীনে ১৯৯৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দুই লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা ফিরে যায় মিয়ানমারে। কিন্তু প্রতিবারই যে পরিমাণ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে, ফিরে গেছে তার চেয়ে কম। বাকিরা বাংলাদেশেই অনেকটা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এবারও যেন সে রকম কোনো পরিস্থিতি তৈরি না হয়, আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ সরকারের সে ব্যাপারে সহযোগিতা চাওয়া উচিত বলে মনে করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হওয়ার পরও রোহিঙ্গা স্রোত অব্যাহত রয়েছে। গতকাল আসা ১৪৫ জন রোহিঙ্গার বরাত দিয়ে শাহপরীর দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দা জাকারিয়া আলফাজ বলেন, এখন যারা এপারে আসছে তারা মূলত অনেক আগেই তাদের বাড়িঘর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। দুর্গম পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে গত প্রায় এক মাস ধরে এসব রোহিঙ্গা মিয়ানমারের মংডু অঞ্চলের ধংখালী, নাইক্ষ্যংদিয়ায় উদ্বাস্তু জীবন কাটাচ্ছে। চুক্তি বা কোথায় কী হচ্ছে এসবের এরা কিছুই জানে না। তারা এখন খাদ্যসংকট মোকাবিলা করতেই ঝুঁকি নিয়ে এপারে আসছে।